মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র , এমপিওর নামে প্রতারণার ফাঁদ

এম মামুন হোসেন ।।

মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে  নিচ্ছে একটি চক্র  , এমপিওর নামে প্রতারণার ফাঁদ
মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র , এমপিওর নামে প্রতারণার ফাঁদ
ল্যান্ড লাইন থেকে ফোন দিয়ে বগুড়ার একটি স্কুলকে বলা হয়, ‘আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব স্যারের পিএ। আপনার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির জন্য বিভিন্ন তথ্য প্রয়োজন।’ প্রতিষ্ঠানটির প্রধান ফোনেই জানতে চাওয়া বিভিন্ন তথ্য দেন। এরপর আরও কয়েকদিন এভাবে ফোন আসে। এরপর জানানো হয়, আপনার প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্তির জন্য শর্ট লিস্টে পাঠানো হবে। এজন্য কিছু খরচাপাতি দরকার। এভাবেই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির নামে শুরু হয়েছে প্রতারক চক্রের বাণিজ্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। হাজার হাজার শিক্ষক ঋণ ও ধারকর্জ করে তদবিরের জন্য শিক্ষাপ্রধানের মাধ্যমে প্রতারকদের টাকা-পয়সা দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। এমন বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর আগে এ ধরনের প্রতারকের হাত থেকে সাবধান করে সতর্কবার্তা জারি করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

জানা গেছে, বেসরকারি স্কুল-কলেজ জাতীয়করণ ও নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির কথা বলে প্রতারকচক্র মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নামে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। এর আগে গত বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জাতীয়করণ এবং নতুন ভবন নির্মাণের জন্য তালিকাভুক্ত করার কথা বলে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয় একটি চক্র।
সেবারও শিক্ষা মন্ত্রণালয় কেবল সতর্কবার্তা দিয়েই দায় সারে।

প্রতারকরা এতটাই কৌশলী যে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নামে একের পর এক জাল চিঠি ও আদেশ-নির্দেশ পাঠানো হচ্ছে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। ভুয়া নির্দেশ যাচ্ছে মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছেও। ভুয়া স্মারক নম্বর ও কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জাল করে এসব নির্দেশ পাঠানো হচ্ছে। আবার ক্ষেত্রবিশেষে অস্তিত্বহীন কর্মকর্তার নাম ব্যবহার করেও চিঠি পাঠানো হচ্ছে। কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়ে প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রেশন, সরকারিকরণ, এমপিওভুক্তিসহ পাঠদানের অনুমতি, একাডেমিক স্বীকৃতি, অতিরিক্ত শ্রেণি শাখা খোলা, বিষয় বিভাগ খোলা ও শিক্ষকদের বদলির কাজ করিয়ে দেওয়ার নামে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে টাকা দাবি করে। টেলিফোন ও এসএমএস করে এমনকি ভুয়া চিঠি পাঠিয়ে ও সরাসরি যোগাযোগ করে এসব কাজ করিয়ে দিতে টাকা দাবি করে।

শিক্ষায় এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নতুন এমপিওভুক্তি। তাই প্রতারকচক্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির লোভ দেখিয়ে টাকা দাবি করছে। কয়েকজন শিক্ষক জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আদ্যোপান্ত জেনেই প্রতারকচক্র ফোন করে। এতে করে তারাও বিভ্রান্ত হয়ে যান। তারা অভিযোগ করেন, মন্ত্রণালয় কিংবা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) ভেতরের কেউ না থাকলে এটি সম্ভব নয়।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, প্রতিদিন এ সংক্রান্ত অনেক ফাইল ওপর-নিচ হচ্ছে। এ ধরনের তথ্য জানিয়েও অনেকেই টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। সবকিছু ঠিক থাকলে যে কাজটি এমনিই হয়, সেখানেও মোটা অঙ্কের টাকার লেনদেনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতারকরা সবসময় ফাঁদ পাতে। সেসব ফাঁদে পা না দিতে পরামর্শ দেন ওই কর্মকর্তা। তিনি আরও বলেন, বেসরকারি স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসা এমপিওভুক্তির জন্য মন্ত্রণালয় থেকে কাউকে ফোন করা হয় না। প্রতারকদের পুলিশে সোপর্দ করার অনুরোধ জানান তিনি।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি ও ১৩ মার্চ দু’দফা প্রতারকের বিষয়ে সতর্ক করে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়, একাধিক প্রতারকচক্র শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এর অধীনস্থ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়ে সরকারিকরণ ও এমপিওভুক্তিসহ নানা কাজ করে দেওয়ার নামে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে টাকা দাবি করছে। এসব বিষয়ে কেউ টাকা দাবি করলে তাদের পুলিশে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের তালিকা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। কতগুলো স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা এবং কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থান পাচ্ছে তা নির্ধারিত হয়নি। তবে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সঙ্গে প্রতিনিয়ত এ বিষয়ে সমন্বয় করা হচ্ছে। এবার শর্তসাপেক্ষে এমপিওভুক্ত করা হচ্ছে বেসরকারি নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে। পরিপত্র যেদিনই জারি করা হোক, তালিকায় থাকা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা গত ১ জুলাই থেকে এমপিও সুবিধা ভোগ করবেন।

এমপিও নীতিমালা অনুসারে যোগ্য হিসেবে ২ হাজার ৭৬২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বাছাই করেছে। এর মধ্যে স্কুল ও কলেজ ১ হাজার ৬২৯টি এবং মাদ্রাসা ৫৫১টি ও কারিগরি প্রতিষ্ঠান ৫৮২টি। এমপিওভুক্তির জন্য ছয় হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবেদন করেছিল।

অভিযোগ আছে, এমপিও একবার হতে পারলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মধ্যে পাঠদানের ব্যাপারে এক ধরনের গাছাড়া ভাব চলে আসে। সে কারণে এবার শর্তসাপেক্ষে এমপিওভুক্তি দেওয়া হবে। এখন থেকে প্রতিবছর এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মিত পর্যালোচনায় মধ্যে রাখা হবে। শর্তাবলির অন্যতম হলো, এমপিওভুক্ত হওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিটিকে পাবলিক পরীক্ষায় মোট শিক্ষার্থীর কমপক্ষে ৭০ শতাংশ পাস করতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে ওই বছরই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি স্থগিত হয়ে যাবে। তবে ভবিষ্যতে ভালো ফল করতে পারলে ফের তা চালু হবে। এ ছাড়া পরিপত্রে আরও কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কমপক্ষে একটি ক্লাসরুমকে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম হিসেবে তৈরি করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানাগার ভালোমানের হতে হবে।

বর্তমানে দেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ২৬ হাজারের বেশি। এগুলোতে কর্মরত প্রায় ৫ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী প্রতি মাসে বেতন ও কিছু ভাতা দিয়ে থাকে সরকার। এমপিওভুক্তি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি কর্মসূচি। এর বাইরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা বোর্ড স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠান রয়েছে সাড়ে ৫ হাজার। এখানে কর্মরত প্রায় ৮০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী। - সময়ের আলো ।