প্রধানমন্ত্রী হার্ড লাইনে , এবার শুরু হবে এমপি-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন

ইয়াছিন রানা ।।

প্রধানমন্ত্রী হার্ড লাইনে , এবার শুরু হবে এমপি-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন
প্রধানমন্ত্রী হার্ড লাইনে , এবার এমপি-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধেও অ্যাকশন শুরু হবে

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোভন-রাব্বানীর অপকান্ড প্রকাশের পর দলের বিশৃঙ্খলা ও সরকারের নানা দুর্নীতি রোধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন । আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা কার্যত দুর্নীতি রোধে এখন হার্ড লাইনে গেছেন। তিনি চান উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেই পরিচ্ছন্ন ইমেজে প্রশাসন পরিচালনা করতে। কিন্তু উপজেলা নির্বাচন ও ছাত্রলীগের বিশৃঙ্খলা এবং হাসপাতালের পর্দা ক্রয়, পাবনায় বালিশ কান্ডসহ নানান দুর্নীতিতে বেশ অস্বস্তিতে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

এ ছাড়া দেশের কিছু ব্যবসায়ী ও নিরাপদ খাদ্য সঙ্কট নিয়ে বেশ চিন্তিত প্রধানমন্ত্রী। এর মধ্যে ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ দলের কিছু নেতার বিরুদ্ধে তার কাছে বিস্তর অভিযোগ দেয়া হয়। তাই দুর্নীতি ও দলের শৃঙ্খলা রক্ষায় হার্ড লাইনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে জঙ্গি দমনের মতো দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজদের দমন করতে বদ্ধপরিকর। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান ইনকিলাবকে বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন। সরকারের নীতি জিরো টলারেন্স, তাই দুদক বা আইনশৃঙ্খলা প্রশাসনের মাধ্যমে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে।

জানা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দল ও সরকারের কোনো বিশৃঙ্খলা সহ্য করছেন না প্রধানমন্ত্রী। বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ বুকে নিয়ে দেশ ও জনগণের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। নেতাকর্মীদের সৎভাবে জীবনযাপন ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মতো দেশ ও জনগণের জন্য কাজ করার নিয়মিত তাগিদও দিচ্ছেন। পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়িয়েছেন কয়েকবার। এরপরও দলের শৃঙ্খলা ঠিক থাকছে না এবং সরকারি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে জনগণ উপকৃত হচ্ছে না। প্রকল্পগুলোতে গুরুতর দুর্নীতি চলছে।

জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর শক্ত অবস্থানের বড় পদক্ষেপ ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতা সভাপতি রেজওয়ানুল হক শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে পদ থেকে সরিয়ে দেয়া ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ১৫৭ বিদ্রোহী প্রার্থীকে শোকজ করা। শোভন ও রাব্বানীর সম্পদের তদন্তে ইতোমধ্যে দুদক মাঠেও নেমেছে বলে জানা গেছে। এটা ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের জন্য বিশাল একটি বার্তা বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা। কারণ ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, মহিলা লীগ এবং মূল দলের কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃর্ণমূল পর্যায়ের কিছু নেতার কর্মকান্ডে সরকারের উন্নয়ন এবং সকল অর্জন ম্লান হওয়ার উপক্রম হয়েছে। প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা বেপরোয়া ভাব দেখাচ্ছেন। এ জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ধরা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতিতে জিরো টলারেন্স নীতির বাইরে কেউ থাকছেন না। সাবেক ও বর্তমান প্রায় ৯০ জন এমপি-মন্ত্রীর বায়োডাটা দুদকের কাছে রয়েছে। তাদের যেকোনো সময় ডাকবে দুদক। ইতোমধ্যে কয়েকজন এমপিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। দুর্নীতি প্রমাণ হলে দলীয় শাস্তিও পাবেন সেসব এমপি ও মন্ত্রী।

গত শনিবার আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে দায়িত্ব থেকে বাদ দেয়া ছাড়া আরো নানা বিষয়ে আলোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের শোকজের বিষয়ে ছাড়াও দলের বাইরে অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের যারা বিদ্রোহী হয়ে নির্বাচন করেছেন; তাদের ভবিষ্যতে পদ না দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর যেসব কেন্দ্রীয় নেতা, এমপি ও মন্ত্রী উপজেলায় দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করেছেন, তাদেরকেও শাস্তির আওতায় আনা হবে। আগামী সম্মেলনে পদ হারাবেন অভিযুক্ত নেতারা; আর মন্ত্রিসভার পুনর্গঠন হলে মন্ত্রিত্ব হারাতে পারেন নৌকার বিরোধিতাকারীরা।
আগামী ২০ ও ২১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সম্মেলনের সিদ্ধান্তও হয়েছে কার্যনির্বাহী বৈঠকে। জাতীয় সম্মেলনের আগে সবগুলো জেলা ও উপজেলায় সম্মেলন করা হবে বলে গতকাল জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। দীর্ঘদিন ধরে নানা জটিলতা, নেতাদের মেরুকরণের কারণে জেলা-উপজেলায় সম্মেলন না হলেও এবার আর কোনো বাধাই যেন টিকবে না। দলের যে যে পর্যায়ে অনুপ্রবেশ ঘটেছে, তাদেরও দল থেকে ছেঁটে ফেলা হবে।

তৃণমূলে যাদের নামে চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দলেও জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। গত শনিবারের আওয়ামী লীগের বৈঠকে ছাত্রলীগের সদ্য অব্যাহতি পাওয়া সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর সঙ্গে তুলনা করে যুবলীগের কিছু নেতার উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, চাঁদাবাজির টাকা বৈধ করতে মিলাদ মাহফিল করা হয়েছে (যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণ মিলাদ)। নিজের জন্য এমন মিলাদ মাহফিল তিনি চান না। এরপর যুবলীগ নিয়ে তার কাছে আসা নানা অভিযোগ তুলে ধরেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ছাত্রলীগের শোভন-রাব্বানীর চেয়েও ওরা (যুবলীগ) ভয়ঙ্কর। যুবলীগের ঢাকা মহানগরের একজন নেতা (ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট) ক্রসফায়ার থেকে বেঁচে গেছে। আরেকজন (মহানগর দক্ষিণের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া) এখন দিনের বেলায় প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে চলেন। সদলবলে অস্ত্র নিয়ে ঘোরেন। এসব বন্ধ করতে হবে। যখন বঙ্গববন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে তখন কেউ অস্ত্র নিয়ে বের হয়নি, অস্ত্র উঁচিয়ে প্রতিবাদ করেনি। যখন দলের দুঃসময় ছিল তখন কেউ অস্ত্র নিয়ে দলের পক্ষে অবস্থান নেয়নি। এখন টানা তিনবার সরকারে আছি। অনেকের অনেক কিছু হয়েছে। কিন্তু আমার সেই দুর্দিনের কর্মীদের অবস্থা একই আছে। যারা অস্ত্রবাজি করেন, যারা ক্যাডার পোষেন, তারা সাবধান হয়ে যান, এসব বন্ধ করুন। তা না হলে, যেভাবে জঙ্গি দমন করা হয়েছে, একইভাবে তাদেরকেও দমন করা হবে।

এদিকে ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সকল টেন্ডার যুবলীগ দক্ষিণের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির বিস্তর অভিযোগ গেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের কাকরাইলের কার্যালয়ে জুয়ার আসর অর্থাৎ ক্যাসিনো বসে বলেও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অভিযোগ পাঠিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা।

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদের নামেও চাঁদাবাজির ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা সিটি দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকনের দুর্নীতিতে অস্বস্তি বিরাজ করছে আওয়ামী লীগে। আগামী নির্বাচনে সাঈদ খোকন মনোনয়ন পাচ্ছেন না, এমনটা নিশ্চিত হয়ে আছে। ঢাকা উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ফরিদুর রহমান ইরানের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে অনেক। ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলমের বিরুদ্ধেও অভিযোগের পাহাড়। তিনি ছাত্রলীগ থেকে বিদায়ের পর থেকে ইংল্যান্ড অবস্থান করছেন। যেকোনো সময় ফেঁসে যেতে পারেন এসব নেতা। এসব নেতা ছাড়াও অসংখ্য নেতার নামে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।

এদিকে দুদক, ভোক্তা অধিকার অধিদফতর, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি দুর্নীতি রোধের চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগ সরকার। মন্ত্রিপরিষদের সদস্য থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের আমলাদের পর্যবেক্ষণে রাখছেন প্রধানমন্ত্রী। বিভিন্ন সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, শিক্ষা অধিদফতরের নানা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য অধিদফতর, কারাগারের কার্যক্রম নজরে রাখা হচ্ছে। বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ আসার কারণে সেখানে কর্মরত সব কর্মকর্তার বায়োডাটা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। দুর্নীতিকালে গ্রেফতার করা হয়েছে অনেক কর্মকর্তাকে। পুলিশের ডিআইজি মিজানকে গ্রেফতার, জামালপুরের ডিসি আহমেদ কবীরকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়া গত বছর চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার সোহেল রানা বিশ্বাসকে ফেনসিডিল, কয়েক লাখ অবৈধ টাকা ও কয়েক কোটি টাকার চেক-এফডিআরসহ কিশোরগঞ্জের ভৈরবে গ্রেফতার করা হয়। এ বছর ২৮ জুলাই সিলেট কারাগারের ডিআইজি (প্রিজন) পার্থ গোপাল বণিককে বাসা থেকে ৮০ লাখ টাকাসহ গ্রেফতার করে দুদক। কিছুদিন আগে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজের পর্দা দুর্নীতি মন্ত্রণালয়ের তদন্তে ধরা পড়ে। এ নিয়ে ব্যবস্থা নেবে মন্ত্রণালয়। এছাড়া রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের বালিশ দুর্নীতিতে ৩৪ জনকে অভিযুক্ত করে, এর মধ্যে ১৬ জনকে বরখাস্ত করে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। ভোক্তা অধিকার ও র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে নিয়মিত ভেজাল পণ্যের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে সরকার, যা ইতোমধ্যে জনগণের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান ইনকিলাবকে বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন। সরকারের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি হলেও তা আগের চেয়ে অনেকাংশে কমে এসেছে। কিন্তু সরকারের নীতি জিরো টলারেন্স, তাই দুদক বা আইনশৃঙ্খলা প্রশাসনের মাধ্যমে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। আবার দুদক বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে দুর্নীতি যেন না হয়, সেজন্যও আলাদা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

দুর্নীতিতে জিরো টলারেন্স ও দলের শৃঙ্খলার বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে। রাজনীতি করে তার অপব্যবহার করলে কেউ ছাড় পাবে না। কেউ দুর্নীতি বা অপরাধ করলে সে রেহাই পাবে না। আওয়ামী লীগের সকল স্তরের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে এমন বার্তা দিয়েছেন শেখ হাসিনা।