২৫ হাজার পাটকল শ্রমিককে স্বেচ্ছায় অবসরে পাঠানো হচ্ছে, চট্টগ্রামে রয়েছেন ১০ হাজার

২৫ হাজার পাটকল শ্রমিককে স্বেচ্ছায় অবসরে পাঠানো হচ্ছে, চট্টগ্রামে রয়েছেন ১০ হাজার
২৫ হাজার পাটকল শ্রমিককে স্বেচ্ছায় অবসরে পাঠানো হচ্ছে, চট্টগ্রামে রয়েছেন ১০ হাজার

নিজস্ব প্রতিবেদক ।।

দেশের ধারাবাহিকভাবে লোকসানে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর প্রায় পঁচিশ হাজার স্থায়ী শ্রমিককে স্বেচ্ছা অবসরে (গোল্ডেন হ্যান্ডশেক) পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার, যার মধ্যে চট্টগ্রামের ৭ পাটকলের ১০ হাজারেরও বেশি শ্রমিক রয়েছেন।

আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে তাদের যাবতীয় পাওনা পরিশোধ করে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের আওতায় অবসর দেয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর বিরোধিতায় সারা দেশের ২৬টি পাটকলের শ্রমিকদের আন্দোলনের ঘোষণার মধ্যেই বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী গতকাল এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি জানান। তিনি বলেন, পাটকলগুলোতে লোকসান হচ্ছে, এজন্য সরকার চিন্তা করেছে শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দিয়ে এই খাতকে এগিয়ে নিতে।

বস্ত্র ও পাট সচিব লোকমান হোসেন মিয়া বলেন, পাটকলগুলোতে ২৪ হাজার ৮৮৬ জন স্থায়ী কর্মচারী রয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন, গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে শ্রমিকদের চাকরির অবসান করতে। পাটকল শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দেওয়ার পর পিপিপির (সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব) আওতায় পাটকলগুলোর আধুনিকায়ন করে উৎপাদনমুখী করা হবে। তখন এসব শ্রমিক সেখানে চাকরি করার সুযোগ পাবেন। ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৮ হাজার ৯৫৪ জন পাটকল শ্রমিক অবসরে গেছেন জানিয়ে সচিব বলেন, অর্থ সঙ্কটে তাদের অবসর ভাতা দেওয়া এখনো সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) অধীনে থাকা ২৬টি পাটকলের মধ্যে মনোয়ার জুট মিল বন্ধ রয়েছে। এসব কারখানায় ২৪ হাজার ৮৬৬ জন স্থায়ী শ্রমিকের বাইরে তালিকাভুক্ত ও দৈনিক মজুরিভিত্তিক শ্রমিক আছে প্রায় ২৬ হাজার। বেসরকারি খাতের পাটকলগুলো লাভ দেখাতে পারলেও বিজেএমসির আওতাধীন মিলগুলো বছরের পর বছর লোকসান করে যাচ্ছে, যার পেছনে অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

চট্টগ্রামে রয়েছেন ১০ হাজার :

চট্টগ্রামের সাতটি পাটকলের ১০ হাজারেরও বেশি শ্রমিক গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে অবসর দেয়া হচ্ছে। চট্টগ্রামের সাতটি পাটকলে স্থায়ী শ্রমিকের পাশাপাশি কিছু বদলি শ্রমিকও রয়েছেন। বদলি শ্রমিকদের সরকারি সুযোগ সুবিধা দেয়ার কোনো সুযোগ নেই বলেও সূত্র জানিয়েছে।

সূত্র বলেছে, চট্টগ্রামের আমিন জুট মিল, হাফিজ জুট মিল এবং গুল আহমদ জুট মিলে ছয় হাজারেরও বেশি শ্রমিক রয়েছেন। এর বাইরে এম এম জুট মিল, আর আর জুট মিল, কর্ণফুলী জুট মিল, মিল ফার্নেসিং এবং বিডিসিএফ নামের অপর চারটি মিলে চার হাজারের মতো শ্রমিক রয়েছেন। সাতটি মিলে কর্মরত ১০ হাজারেরও বেশি শ্রমিকের মধ্যে কিছু শ্রমিক চাকরির একেবারে শেষ সীমায় থাকলেও অনেকেরই আরো বেশ কয়েক বছর চাকরি রয়েছে। এদের সকলকে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের আওতায় এনে অবসর দেয়া হচ্ছে। অবসরকালীন যাবতীয় সুুযোগ সুবিধা এসব শ্রমিকদের এককালীন দিয়ে দেয়া হবে। তবে পরবর্তীতে মিলগুলো পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে চালু করার সময় নিয়োগের ক্ষেত্রে এদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে।

চট্টগ্রামের বিজেএমসির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, প্রতিটি মিলই নানা সংকটে রয়েছে। চট্টগ্রামের মিলগুলোও লোকসান গুনছে। কোটি কোটি টাকার মিলগুলোর বহু সক্ষমতা নানা সীমাবদ্ধতায় ব্যবহৃত হচ্ছে না। এখন নতুন করে চালু করা হলে অনেকেই উপকৃত হবেন।

এদিকে বিডিনিউজের খবরে বলা হয়, স্থায়ী শ্রমিকদের অবসরে পাঠানোর উদ্যোগের প্রতিবাদে যৌথভাবে আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে পাটকল শ্রমিক লীগ এবং রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ ও নন-সিবিএ সংগ্রাম পরিষদ। শনিবার খুলনা অঞ্চলের পাটকলগুলোর গেটে শ্রমিক সমাবেশ করে আজ সোমবার রাজপথে অবস্থান, কাল মঙ্গলবার মিলগেটে অবস্থানের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে স্মারকলিপিও দেওয়া হবে বলে শ্রমিক নেতারা জানিয়েছেন।

তবে গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের সিদ্ধান্ত জানিয়ে পাটমন্ত্রী ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রধানমন্ত্রী বকেয়সহ সব টাকা একসঙ্গে শ্রমিকদের দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। আগে যারা অবসরে গেছেন, তাদের সব টাকাও একই সঙ্গে পরিশোধ করতে বলেছেন। নতুন বাজেটের টাকা হাতে পাওয়ার পরই শ্রমিকদের সব টাকা দিয়ে দেওয়া হবে। আগামী সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে শ্রমিকদের সব টাকা এক সাথে দেওয়া হবে। এজন্য ৪ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা লাগবে।

আগামী ছয় মাসের মধ্যে এসব পাটকল পিপিপির মাধ্যমে চালু করা হবে জানিয়ে গোলাম দস্তগীর বলেন, তখন মিলগুলোতে এসব শ্রমিক চাকরি করতে পারবেন। মিলগুলোকে লোকসান থেকে বাঁচাতে গিয়ে পিপিপির মাধ্যমে চালু করা হবে।

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোকে লাভজনক করতে ২০১৮ সালে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছিল বিজেএমসি। পাটকলের জমি লিজ দেওয়া, কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে পাট কিনতে ১ হাজার কোটি টাকার ঘূর্ণমান তহবিল গঠন, বহুমুখী পাটপণ্যের কারখানা স্থাপনসহ বিভিন্ন উদ্যোগের কথা ছিল সেখানে। সেই পরিকল্পনা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে পাটমন্ত্রী বলেন, আমরা ব্যর্থ না। ব্যবসা করার দায়িত্ব সরকারের না, কিন্তু আমাদের উপর এই দায়িত্ব পড়ে গিয়েছিল। সরকারিভাবে ব্যবসা সেবাখাতই করে। প্রতিযোগিতামূলক বাজারেই ব্যবসা হয়, এটা ব্যর্থতা না।

বস্ত্র ও পাট সচিব বলেন, ১৯৭২ সালে পাটকলগুলো জাতীয়করণ হয়। পরে বিভিন্ন সময় সরকারি-বেসরকারিকরণ করা হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো গত ৪৪ বছরের মধ্যে মাত্র ৪ বছর লাভ করেছে। এরপর কখনো লাভ করতে পারেনি। ৪৮ বছরে এই খাতে সরকারকে ১০ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে। প্রতি বছর শ্রমিকের মজুরিসহ খরচ মেটাতে সরকারের ওপর নির্ভর করতে হয়। শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দেওয়ার পর এসব কারখানাকে উৎপাদন ও মুনাফামুখী করতে সরকার ‘বিশেষ ব্যবস্থা’ নেবে বলে মন্তব্য করেন পাট সচিব।