সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় চিকিৎসার নামে চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতালে চলছে গলাকাটা বাণিজ্য 

সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় চিকিৎসার নামে চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতালে চলছে গলাকাটা বাণিজ্য 
সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় চিকিৎসার নামে চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতালে চলছে গলাকাটা বাণিজ্য 

ফারুক আবদুল্লাহ ।।

বেসরকারি হাসপাতালের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় কোনোধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার নামে চলছে ‘গলাকাটা’ ভয়াবহ বাণিজ্য। সেবার আশায় এসব হাসপাতালে শরণাপন্ন হলেও রোগী ও তাদের স্বজনদের গুণতে হয় অতিরিক্ত কয়েকগুণ বিল। তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে অসামঞ্জ্যপূর্ণ, বাড়তি ও ভূতুডে বিল ধরিয়ে দেয়ার অভিযোগ।

ভুক্তভোগী রোগী ও স্বজন এবং হাসপাতাল সূত্রে পাওয়া তথ্য মতে, গত ২৯ জুন দুপুর সাড়ে ৩ টায় শ্বাসকষ্ট নিয়ে ম্যাক্স হাসপাতালে ভর্তি হন ৬৬ বছর বয়সী সাইফুদৌল্লাহ খাঁন। তাকে হাই ফ্লো অক্সিজেন না দিয়েও তারা বিল করেছে। তারা প্রথমে ১ লাখ ৯৩ হাজার ৯৪ টাকার বিলের রসিদ দেয়। এরপর রোগীর স্বজনরা হাইফ্লো সম্বন্ধে তাদের জিজ্ঞাসা করে এবং তথ্য প্রমাণ দিয়ে উপস্থাপন করে প্রতিবাদ করলে তারা হাই ফ্লো অক্সিজেনের টাকা বাদ দেয়। এরপর বিলটা সংশোধন করে ১ লাখ ৫১ হাজার ৮১৪ টাকার তৈরি করে দেয়। কিন্তু উক্ত সংশোধনী বিলেও কিছু ভুল থাকার কথা জানালে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আবারও সংশোধন করে ১ লাখ দশ হাজার টাকার একটা বিল দেয়। তাদের ৮৩ হাজার টাকার ভূতুড়ে বিলের হিসাব দেখায় ম্যাক্স হাসপাতাল। সর্বশেষ ১ লাখ ১০ হাজার টাকার বিল দেয়া হয়েছে, এখানেও অনেক টাকা বেশি রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ। তারা কিছু টেস্ট করেছে যা রোগ সংশ্লিষ্ট নয় বলেও জানান।

গত জুন মাসের শুরুর দিকে প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট নিয়ে চট্টগ্রামের ম্যাক্স হাসপাতালে ভর্তি হন জান্নাতুল ফেরদৌস। ৪৫ বছর বয়সী এই নারীকে ১০ দিন অক্সিজেন দিতে হয়েছিল। সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে যাওয়ার সময় তার পরিবারের হাতে ছয় লাখ টাকারও বেশি অঙ্কের বিল ধরিয়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যে শুধুমাত্র অক্সিজেনের বিল তিন লাখ পাঁচ হাজার টাকা।

একইভাবে শুধুমাত্র ঘুমের ওষুধ আর স্যালাইন দিয়েই ৯৪ হাজার টাকা বিল করেছে চট্টগ্রাম নগরীর বেসরকারি মেট্রোপলিটন হাসপাতাল। ভুক্তভোগীরা বলেন, মাত্র ৭ দিনে ১ লাখ ১৫ হাজার টাকার বিল এসেছে।

সর্বশেষ বাড়তি বিল নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে পার্কভিউ হাসপাতালের বিরুদ্ধে। এখানে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মো. সেলিম গত ৪ জুলাই ভর্তি হন। ভর্তির ১৩ দিনে বিল ৬ লাখ ৯৭ হাজার ৫১৯ টাকা ধার্য করে পার্কভিউ হাসপাতাল। সেই হিসেবে একদিনে করোনা রোগীর বিল এসেছে ৫৩ হাজার ৬৫৫ টাকা। ১ লাখের বেশি মেডিসিন বিল ধরা হয়েছে। অথচ রোগীর পরিবার সমস্ত ওষুধ সরবরাহ করেছে বলে দাবি করেছে।

গত ১৭ জুলাই মো. সেলিম নামে এক রোগীর মৃত্যু হয়। স্বজনদের দেওয়া বিল থেকে জানা যায়, চিকিৎসার জন্য যে বিল দেখিয়েছে তা সম্পূর্ণ বানোয়াট। বিলে একেক অংকে অক্সিজেন, কনসালটেন্ট ও সার্ভিস চার্জ দুই বার ধরা হয়েছে। অক্সিজেন বিল একটা হলো ৭৭ হাজার ৮০০ ও আরেকটি ১ লাখ ৩০ হাজার ৫০০ টাকা। একইভাবে কনসালটেন্ট ফি এক জায়গায় ধরেছে ১৮ হাজার টাকা, আবার ডাক্তার বাসা থেকে ওদের সাথে কথা বলার কারণে হোম কনসালটেন্ট ফি ধরেছে ২৮ হাজার টাকা। সার্ভিস চার্জ এক জায়গায় ৩৪ হাজার ২০০ টাকা ধরেছে। আবার ১ লাখ ১৬ হাজার ২৫৩ টাকা সাভিস চার্জ ধরেছে।

একই ধরনের অভিযোগ নগরীর অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে। কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কাই করছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কোন রোগী এসব বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ পেলেও চিকিৎসার নামে গলার কাটা বিলের বোঝায় জর্জরিত হচ্ছে রোগী ও তাদের স্বজনরা।

করোনা মোকাবেলায় গঠিত স্বাধীনতা চিকিৎসা পরিষদের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমন্বয়ক আ ন ম মিনহাজুর রহমান বলেন, বেসরকারি হাসপাতালে সেবার নামে অরাজকতা চলছে এবং জেলা প্রশাসনের মনিটরিং টিম ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’। তাদের কার্যকর ভূমিকা না থাকার কারণে আগেও রোগী কষ্ট পেয়েছে এখনও পাচ্ছে। জেলা প্রশাসন বা মনিটরিং সেল কিংবা স্বাস্থ্য প্রশাসন আগে যে সমস্ত উদ্যোগ নিয়েছে তাতে বড় বড় অসাধু ক্লিনিক মালিকদের উৎসাহিত করা হয়েছে।

ভুক্তভোগীরা বলেন, সর্বশেষ পার্কভিউ হাসপাতালে অক্সিজেন বিল একবার ড়ীুমবস দিয়ে নিয়েছে, আবার ড়ীুুবস দিয়ে বিল নিয়েছে আরেকবার। এ অনিয়মের কারণে সেদিন হাসপাতাল বন্ধ হওয়া দরকার ছিল। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

ডা. মিনহাজ বলেন, সরকার যাদেরকে নিয়ে হসপিটাল ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করেছে তারা ‘ঠুঁটো জগন্নাথে’ পরিণত হয়েছে। তারা গত ৪ মাস ধরে অসাধু ক্লিনিক মালিদেরকে’ লালন-পালন ভরণপোষণ দিয়েছে, এখনো দিয়ে যাচ্ছে। তাদের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে হাসপাতালে রোগী যেতে ভয় পাচ্ছে। সরকারের ৪০ লাখ টাকা, ২৬ জন চিকিৎসক, ৩০ জন নার্সসহ এতগুলো স্টাফ অহেতুক সেখানে বসিয়ে রাখছে। এসব কিন্তু তাদের ব্যর্থতা।

বিশেষ করে ম্যাক্স ও পার্কভিউ হাসপাতাল করোনাকালে সবাইকে বিভ্রান্ত করে এসব করেছে। এখন ক্ষতি পুষিয়ে নিতে জনগণের উপর ছুরি বসিয়ে দিচ্ছে। আর এসব তো ফাইভ স্টার হোটেল না যে দিনে রুম ভাড়া ১২ হাজার টাকা নিতে হবে।

ডা. মিনহাজ বলেন, এদের কারণে কোভিডকালে সাধারণ জনগণ কষ্ট পেয়েছে। এসব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ তারা। এখনো নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ। এই ক্লিনিক মাফিয়া ম্যাক্স, পার্কভিউ এবং ন্যাশনাল হাসপাতাল, যাদেরকে নিয়ে হাসপাতাল মনিটরিং কমিটি সবসময় ডানে-বামে বসায় মিটিং করে। আজ তাদের ক্লিনিকে জনগণ ডাকাতির শিকার হচ্ছে। এরা প্রকাশ্য ও প্রমাণিত ডাকাত।

গত শনিবার পার্কভিউ হাসপাতালে রোগীর স্বজনদের দেওয়া বিল প্রসঙ্গে বলেন, একজন রোগীকে বিল দেয় ৬ লাখ ২৩ হাজার টাকা। ৩ লাখ ১৩ হাজার টাকা হলো অক্সিজেন বিল। আমারও ক্লিনিক আছে। সিলিন্ডার অক্সিজেন ঘন্টায় ১০০ টাকা নিলে ১০ দিনে বিল হবে ২৪ হাজার টাকা। সেই জায়গায় ৩ লাখ ১৩ হাজার বিল কেমনে আসে? এখন যে বিল দেওয়া হয়েছে তা সর্বোচ্চ বিল আসতে পারে দেড় লাখ থেকে ২ লাখ টাকা। তাদের হাসপাতাল অনুযায়ী। অন্য হাসপাতাল হলে ১০ দিনের বিল আসবে ১ লাখ ১০ হাজার মত। কিন্তু গতকালের বিলের প্রেক্ষিতে ১ লাখ টাকা ওষুধের বিল আসে এটা কেমনে সম্ভব? হয়ত ৯৬ হাজার কিংবা ১ লাখ ৩ হাজার হতে পারে। ১ লাখ কেমনে সম্ভব। ১০ দিন হিসেবে ১ দিনে রোগী ওষুধ খেয়েছে ১০ হাজার টাকা করে। অথচ ১০ দিনে ওষুধের বিল আসার কথা সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা সেখানে ১ লাখ টাকা বিল করা হয়েছে। তা কোন মতে সম্ভব নয়। কিন্তু এসব অনিয়ম দেখার মত কেউ নেই।

গণঅধিকার ফোরামের মহাসচিব এমএ হাশেম রাজু বলেন, বেসরকারি হাসপাতালে গলাকাটা বাণিজ্যের কারণে অসহায় রোগী ও তাদের স্বজনদের কান্না শোনার মত চট্টগ্রামে কেউ নেই। জনগণের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অনিয়ম দূর করতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

বিএমএ কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ডা. শেখ শফিউল আজম বলেন, করোনা মারামারির মধ্যেও এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী জনগণকে জিম্মি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঠিক দায়িত্ব পালন ও তদারকি না করার কারণে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে চলছে। তাদের লাগাম টেনে ধরা না গেলে জনগণ কষ্ট পাবে। চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা বেড়ে যাবে। সেখান থেকে আমি, আপনি কেউ রেহাই পাবো না। এখনই সময় চট্টগ্রামের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার অফিসের অতিরিক্ত কমিশনার (উন্নয়ন) এবং কোভিড-১৯ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ দলের আহবায়ক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, আমিও এদেশের নাগরিক হিসেবে ভুক্তভোগী। স্বাস্থ্যখাতে বেসরকারিকরণ হচ্ছে দেশে। আর স্বাস্থ্যখাতে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মত প্রতিযোগিতা আছে। মধ্যবিত্ত, নিন্ম মধ্যবিত্ত মানুষদের সেবা দিতে বেসরকারি হাসপাতালগুলো সুযোগ নিচ্ছে। দেশের নাগরিক হিসেবে বলতে পারি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাপ কমাতে হবে। যখন তারা প্রতিযোগিতায় পড়বে তখন তারা দর কমাতে বাধ্য হবে। এটাতে একটা রেগুলেটরি বডি থাকা দরকার। তারপরও এসব অভিযোগ নিয়ে কেউ আমাদেরকে জানালে আমি সিভিল সার্জনের কাছে রেফার করি। তারা এটি দেখেন।

তিনি বলেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলো কক্সবাজারের বিলাসবহুল হোটেলের মত ভাড়া আদায় করে। এটি কি ক্লিনিক নাকি হোটেল সেটাতে মুশকিলে পড়েন। প্রথমদিকে যেসব হাসপাতালগুলো কোন রোগীই ভর্তি করাচ্ছিলেন না, তারা নন কোভিড কিনা তা পরীক্ষার রিপোর্ট আনতে বলছিলেন। আমরা উদ্যোগ নেওয়ার পর সেখান থেকে উত্তরণ হয়ে এসেছি।