বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি আজো বাংলাদেশে সমানভাবে প্রাসঙ্গিক, সেই পররাষ্ট্রনীতিতেই এগিয়ে যাচ্ছে দেশ

বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি আজো বাংলাদেশে সমানভাবে প্রাসঙ্গিক, সেই পররাষ্ট্রনীতিতেই এগিয়ে যাচ্ছে দেশ
বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি আজো বাংলাদেশে সমানভাবে প্রাসঙ্গিক, সেই পররাষ্ট্রনীতিতেই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক ।।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পররাষ্ট্রনীতি আজো বাংলাদেশে সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। জাতির জনকের ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’ এই নীতি অনুসরণ করেই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের কুটনৈতিক সম্পর্ককে আরও জোরদার করেছেন।

প্রবীণ কূটনীতিবিদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এমপি এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক মোহাম্মদ জমির দুজনই সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি নির্দেশে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। আব্দুল মোমেন সে সময়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করেন। আর মোহাম্মদ জমির সে সময়টায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এমপি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করছেন। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির মূল কথা হচ্ছে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়। এই যে একটা মতাদর্শ, এটি এত ভালো একটি উদ্যোগ যে আমি এটা এখন আরও বেশি করে উপলব্ধি করি। বঙ্গবন্ধুর এই নীতির কারণে কারো সঙ্গে আমার দেশের শত্রæতা নেই। তাই আমি আমার কর্মকাÐেও এই নীতি অনুসরণ করি।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির মধ্যে কয়েকটি প্রিন্সিপাল ছিল। প্রথমত; কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব। দ্বিতীয়ত; দুনিয়ার নির্যাতিতদের বন্ধু বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত। শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে। তিনি সবসময় নির্যাতিতের পক্ষে কাজ করেছেন। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত প্রায় সাড়ে ১১ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে তারই ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন।

আব্দুল মোমেন বলেন, বঙ্গবন্ধুর এ নীতির কারণে পৃথিবীর অনেক দেশের সম্মান আমরা পেয়েছি। কোন কোন দেশ রাজনৈতিক কারণে হয়তো আমাদের অপছন্দ করতে পারে। কিন্তু আমাদের মরাল অ্যান্ড এথিক্যাল স্টান্ডার্ডের কারণে আমাদের খুব পছন্দ করে।

মোহাম্মদ জমির বলেন, বাংলাদেশ সবসময়ই নির্যাতিতদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। আজ যে বাংলাদেশে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে এর পেছনে রয়েছে বাংলাদেশের সহমর্মিতার মনোভাব। দেশব্যাপী ডেঙ্গু, বন্যাসহ নানাবিধ সমস্যা থাকা সত্তে¡ও বাংলাদেশ সরকার আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা বন্ধ করেনি। তাদের ওপর এসব দুর্যোগের কোনো প্রভাব পড়েনি।

বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ করে জমির বলেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি অংশগ্রহণ আমাদের সঙ্গে রাশিয়া, পূর্ব-ইউরোপ, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনভুক্ত ও কমনওয়েলথভুক্ত অন্যান্য দেশের মধ্যেকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নতি ঘটিয়েছিল। তাঁর এ কর্মকাÐের ফলে ১৯৭৩ সালে ইসরাইলের সঙ্গে সিরিয়া ও মিসরের যুদ্ধে বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। সে সময় বঙ্গবন্ধুর সরাসরি নির্দেশে অল্প সময়ের মধ্যে সিনাইয়ে অবস্থানরত মিসরীয় সৈন্যদের সাহায্যের জন্য বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর একটি মেডিকেল টিম ও চা উপহার হিসেবে পাঠানো হয়।

এখানে উল্লেখ্য যে, মিসরীয় সৈন্যদের এই সহায়তার ব্যাপারে মোহাম্মদ জমির নিজে সরাসরি যুক্ত ছিলেন এবং তার পরামর্শেই চিকিৎসক দল ও ওষুধের সঙ্গে চা পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। সে সময় চিকিৎসক দলের সঙ্গে তিনিও মিসর যান। জমির বলেন, বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টি ও বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবের জন্যই পরবর্তীতে সৌদি আরব, কুয়েত, মিসর, আলজেরিয়া ও সিরিয়া বাংলাদেশকে অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্সের (ওআইসির) সদস্যপদ লাভে সহায়তা করেছিল। ১৯৭৪ সালের ফেব্রæয়ারিতে লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসির শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশকে আলাদা স্বাধীন দেশ হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোর জন্যও তারা জোর দিয়েছিল।

মোহাম্মদ জমিরের মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পররাষ্ট্র নীতি একই পথ ধরেই হাঁটছে। সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার কারণে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।

আব্দুল মোমেন মনে করেন, বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির তৃতীয় প্রিন্সিপাল ছিল নেইবারহুড। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন এশিয়ার সবগুলো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকবে। বাংলাদেশ এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রতিভ‚ হয়ে উঠবে। বর্তমান বাংলদেশ সরকার, বিশেষ করে রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা একই প্রিন্সিপাল মেনে চলেন। সেটিও হচ্ছে, প্রতিবেশির সঙ্গে বন্ধুত্ব। এটার ফল আমাদের জন্য ভালো হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু দৃঢ়ভাবে প্রতিটি জাতির সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার সময় মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশে অবস্থান করছিল। বঙ্গবন্ধু ফেব্রুয়ারির শুরুতে ভারত সফরে গেলে তিনি ভারতের সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সৈন্য ফিরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর কথায় ইন্দিরা গান্ধী-এর কারণ জানতে চান।

জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমরা স্বাধীন রাষ্ট্র। পাকিস্তান আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে যে, কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশ ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য হয়ে যাবে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ভারতীয় সৈন্যরা থাকলে এই অপপ্রচার লোকজন বিশ^াস করবে।

এরপর ইন্দিরা গান্ধী নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে বঙ্গবন্ধুকে বলেন, ‘দিস উইল বি মাই গিফট অন ইয়োর বার্থ ডে।’ ১৭ মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। ইন্দিরা গান্ধী মার্চে ঢাকায় এসেছিলেন। তার আগেই ভারতীয় সৈন্যদের ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর অল্প সময়ের মধ্যেই অনেক দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।

মোহাম্মদ জমির বলেন, বঙ্গবন্ধুর এ দৃঢ়চেতা মনোভাব বাংলাদেশকে দ্রæতই আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ক নির্মাণে সাহায্য করেছিল। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রথম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময়েই বিশে^র ৫৪টি দেশ বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে দেয়। ’৭২-এর শেষ দিকে এসে সংখ্যাটি বেড়ে যায়। এরপর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ কমনওয়েলথ, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) প্রভৃতির সদস্য হয়ে কুটনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক। এর পেছনে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা। আলোচনার মাধ্যমে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে আমরা সীমান্ত সমস্যা, গঙ্গার পানি চুক্তি একং বিশাল সমুদ্র সীমা সমস্যার সমাধান করেছি। একইভাবে আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের বিঢ়াট সমুদ্রসীমায় সমঝোতার জন্য কাজ করছি। বিশ্বে বাংলাদেশ এখন শান্তির একটি মডেল। এজন্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শান্তির জন্য পুরস্কার পেয়েছেন।