৭১-এ বর্বর পাক সেনাদের নৃশংসতা ,শান্তি কমিটি গঠনের কথা বলে ডেকে নিয়ে নির্বিচারে গনহত্যা

রাহাদ সুমন, বানারীপাড়া ।।

৭১-এ বর্বর পাক সেনাদের নৃশংসতা ,শান্তি কমিটি গঠনের কথা বলে ডেকে নিয়ে নির্বিচারে গনহত্যা
৭১-এ বর্বর পাক সেনাদের নৃশংসতা ,শান্তি কমিটি গঠনের কথা বলে ডেকে নিয়ে নির্বিচারে গনহত্যা
আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ নয় স্বাধীনতা , রূপকথা কিংবা গল্প গাঁথাও নয়, স্বাধীনতা মানে শোষণ-তোষণ আর পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে বিশ্বের দরবারে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম ভূ-খন্ড। আর সেই স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনতে নাম জানা-অজানা কত মানুষ যে প্রাণ উৎসর্গ করেছে তার ইয়ত্তা নেই। তাইতো স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরেও দেশের বিভিন্ন স্থানে পাক হানাদারদের বর্বরতার শিকার নিহতদের গণ-কবরের সন্ধ্যান পাওয়া যাচ্ছে। তেমনি ২০১০ সালে বানারীপাড়ায় পাওয়া গেছে দু’টি বধ্য ভুমির সন্ধান।
একটি বানারীপাড়ার  সদর ইউনিয়নের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত দক্ষিন গাভা-নরেরকাঠী ও অপরটি সৈয়দকাঠী ইউনিয়নের তালা প্রসাদ গ্রামে।
এ দুটি গণ কবরে রাজাকারদের সহায়তায় পাক বাহিনীর হাতে নৃশংস ভাবে নিহত ৯৮ জন শিশু, নারী ও পুরুষের লাশ মাটি চাপা দেয়া হয়। যার মধ্যে বধ্য ভূমি অনুসন্ধানে নিয়োজিত তদন্তকারী পুলিশ প্রশাসন এ পর্যন্ত ৪৫ জনের নাম পরিচয় সনাক্ত করতে পেরেছে।
২০১০ সালে গাভা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক ও সমাজ হিতৈষী সুখরঞ্জন সরকার বরিশাল জেলা প্রশাসকের কাছে গণ-হত্যার শিকার ওই সব লাশের স্মৃতি রক্ষার্থে আবেদন করেন। জেলা প্রশাসন বিষয়টি তদন্তের জন্য পুলিশকে দায়িত্ব দেন। আজও এ বধ্য ভূমি দুটি সংরক্ষন করে স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়নি। বধ্য ভূমি দুটি অযত্ন অবহেলায় অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে।
২০১২ সালের ১৩ মে তৎকালীণ আওয়ামীলীগের স্থাণীয় সংসদ সদস্য  মুক্তিযোদ্ধা মোঃ মনিরুল ইসলাম মনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে বধ্যভূমি সংরক্ষনের উদ্যোগ নিয়ে গাভা-নরেকাঠি বধ্যভূমিতে স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণের ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করেন। তিনি ওই সময় বধ্য ভূমিতে চার দিক থেকে নির্বিঘ্নে যাওয়া-আসার জন্য উপজেলার সদর ইউনিয়নের আলতা-রায়েরহাট ও গাভা বাজার সড়ক পাকা করণের কাজ শুরু করেন। তখন বধ্য ভূমির পাশে গাভা কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন ও  বেশ কয়েকটি ব্রিজ-কালভার্ট  সহ ওই সড়কের বেশিরভাগ কাজ সম্পন্ন করা হলেও পরবর্তীতে তিনি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে  দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে সংসদ সদস্য পদ হারানোর পরে বধ্য ভূমি সংরক্ষনে স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ’র উদ্যোগ থমকে যাওয়ার পাশাপাশি মহতী ওই কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
সদ্য অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী স্থাণীয় সংসদ সদস্য বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মো. শাহে আলম গাভা-নরেরকাঠি  নির্বাচিত হওয়ার পরপরই বধ্য ভূমি পরিদর্শণ করে এটি সংরক্ষণ ও দৃষ্টি নন্দন স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শী সুত্রে জানা গেছে, উপজেলার সদর ইউনিয়নের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত দূর্গম গ্রাম গাভা ও নরেরকাঠীর সীমান্তবর্তী খালের উত্তর পাড়ে রাজাকারদের সহায়তায় পাকবাহিনীর হাতে নিহত শতাধিক লাশের মধ্যে ৯৫টি লাশ মাটি চাপা দেয়া হয়।
পাক বাহিনীর বর্বরতার প্রত্যক্ষদর্শী গাভা গ্রামের বয়োবৃদ্ধ যাদব চন্দ্র হাওলাদার (৮৫) জানান, ৭১ সালের ২ মে আনুমানিক দুপুর ২টা-আড়াইটার দিকে গাভা বাজার ও রায়েরহাট এলাকা থেকে দু’দল পাক সেনা এসে গাভা-নরেরকাঠী গ্রামের  লোকজনদের ডেকে বলে, “তোমরা এসো তোমাদের নিয়ে শান্তি কমিটি গঠন করা হবে। এটা হলে তোমরা শান্তিতে বসবাস করতে পারবে।” তাদের এই কুটকৌশল বুঝতে না পেরে শতাধিক নারী-পুরুষ সরল বিশ্বাসে তাদের সামনে এলে তারা মুহুর্তের মধ্যে তাদেরকে অস্ত্রের মাধ্যমে জিম্মি করে খালের পাড় সংলগ্ন জমিতে লাইন দিয়ে দাড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে। প্রায় ২০/২৫মিনিট তারা পাখি শিকারের মতো গুলি বর্ষণ করে। গুলিবিদ্ধ অনেকেই বাঁচার জন্য খালের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তলিয়ে যায়। তাদের আত্মচিৎকারে তখন আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। এদের মধ্যে ঠাকুর চাঁদ সরকার (৪৫), সখানাথ রায় (৪৭) ও সুনিল মিস্ত্রী (৩৫) গুলি বিদ্ধ হওয়ার ভান করে খালে লাফিয়ে পড়ে। এদের মধ্যে সুনিল মিস্ত্রী সাতরিয়ে খালের অপর পাড়ে উঠে দৌড় দিলে তা দেখে ফেলে পাক সেনারা তাকে গুলি করে। গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু ঘটে। সবার মৃত্যু নিশ্চিত হলে আনন্দে বর্বর পাক সেনারা ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে উল্লাস করে। পিপাসার্ত পাষন্ড পাক সেনাদের ডাবের পানি খাইয়ে পিপাসা মিটিয়েও সেদিন  তাদের হাত থেকে এলাকার লোকজনকে বাঁচতে পারেনি।
পাক সেনারা গান বোর্ড ব্যবহার না করে পায়ে হেটে ওই স্থানে আসায় আকস্মিকতায় পালাতে পারেনি এলাকার লোকজন। নিহতদের অনেকের লাশ খালের পানিতে ভেসে যায়। আতঙ্কে এলাকা জনশূণ্য হয়ে পড়ে। জমি ও খালের পাড়ে প্রায় এক সপ্তাহ পড়ে থাকা লাশগুলো দুর্গন্ধ ছড়িয়ে শিয়াল, শকুন ও কুকুরের খাদ্যে পরিনত হয়। এ দৃশ্য দেখে অনেকটা সাহস নিয়ে ওই এলাকার যাদব হাওলাদার, গেরদে আলী সিকদার, প্রহ্লাদ সমদ্দার ও সুদির রায় সহ কয়েকজন যুবক মিলে শিশু, নারী ও পুরুষ ৯৫টি লাশ মাটি চাপা দেয়। প্রথমে তারা একটি বৃহৎ গর্ত খুড়ে লাশ গুলো চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু সব লাশ ওই গর্তে না ধরায় আরও একটি গর্ত খুড়ে বাকী লাশ মাটি চাপা দেয়া হয়। ওই লাশের মাধ্যে যাদের নাম পরিচয় জানা গেছে তারা হলেন,নরেরকাঠী গ্রামের কার্তিক চন্দ্র সরকারের ছেলে লোকনাথ সরকার (৪৫), ছুডু মন্ডলের ছেলে বিনোদ বিহারী মন্ডল (৫৫), সখানাথ মিস্ত্রির ছেলে সুনিল মিস্ত্রী (২২), নীলকান্ত মন্ডলের ছেলে রাধে শ্যাম মন্ডল (১৮), নিবারন চন্দ্র বাড়ৈর ছেলে গোপিনাথ বাড়ৈ (৩০), গাভা গ্রামের লক্ষী কান্ত হাওলাদারের ছেলে অক্ষয় চন্দ্র হাওলাদার (৪৫), রাম বেপারীর ছেলে রাজেন বেপারী (২৫) কালিচরণ সমদ্দারের ছেলে সরৎ চন্দ্র সমদ্দার (৫৮), রাজেন্দ্র নাথ বনিকের ছেলে রঙ্গলাল বনিক (২২), হরলাল বণিক (২০), নারায়ন চন্দ্র বনিকের ছেলে কমল চন্দ্রবনিক (২০), রাখাল চন্দ্র বড়ালের ছেলে শ্যাম বড়াল (২৪), নিশিকান্ত দেউরীর ছেলে দেবেন দেউরী (৪০), বসন্তকুমার সাহার ছেলে কালা সাহা (৪৫), দেবেন মুরীর ছেলে রবিন মুরী (৪০), পুর্নচন্দ্র হাওলাদারের ছেলে উপেন্দ্রনাথ হাওলাদার (৬০), উপেন্দ্রনাথ হাওলাদারের ছেলে মনোরঞ্জন হাওলাদার (২৫), উপেন্দ্রনাথ হাওলাদারে স্ত্রী মনিরানী হাওলাদার (৫২), সুধীর বাড়ৈর মেয়ে কবিতা রানী বাড়ৈ (৮), কুঞ্জ বিহারীর দেউরীর স্ত্রী ফুলসোনা দেউরী (৪০), জ্ঞানেন্দ্রনাথ বাড়ৈর ছেলে অবিনাশ চন্দ্র বাড়ৈ (২৫), হেমন্ত কুমার রাজের ছেলে হরে কৃষ্ণ রাজ (২৫), লালু ঘরামীর ছেলে হরি ঘরামী (৩৫), লেদু ঋষির ছেলে কার্তিক চন্দ্র ঋষি (৪৮), জিতেন্দ্রনাথ সমদ্দারের ছেলে দিলিপ কুমার সমদ্দার (২৫), গঙ্গা চরণ দাসের ছেলে শশী কুমার দাস (৪৭), নসাই দাসের ছেলে উপেনদাস (৪২), সরৎ দাসের ছেলে সুশীল দাস (৪৫), অম্বিকা চরন বনিকের ছেলে নকুল চন্দ্র বনিক (৭০), রমেশচন্দ্র কর্মকার (৬৮) পিতা অজ্ঞাত, রশিক চন্দ্র ঘোষের ছেলে ফনি মোহন ঘোষ (৭২), ভাষারাম রায়ের ছেলে গোপাল রায় (৬০), লালু ঘরামীর ছেলে যজ্ঞেশ্বর ঘরামী (৫৮), করিম তালুকদারের ছেলে আঃ রব তালুকদার (৬২), জবেদ আলী হাওলদারের ছেলে আশ্রাফ আলী হাওলাদার (৪০), হুজ্জুত আলীর ছেলে মুনসুর হাওলাদার (৪০), আটসক মৃধার ছেলে আহম্মদ আলী মৃধা (৬০), রশিক চন্দ্র হাওলাদারের স্ত্রী গুনমনি হাওলাদার (৭০), বুলু পেদার ছেলে সেকেন্দার পেদা (৪৫), মধু ঘরামী (৪৮) পিতা অজ্ঞাত, ভোলানাথ দাসের স্ত্রী প্রফুল­ বালা দাস (৬২), অশ্বিনী কুমার বাড়ৈর স্ত্রী হেমলা বাড়ৈ (৬০), কেদার বাড়ৈর স্ত্রী গোলাপ বাড়ৈ (৫৮), নিশিকান্ত বাড়ৈ (৬৫) পিতা অজ্ঞাত।
এ এলাকায় পেয়ারা বাগান থাকায় এবং দুর্গম হওয়ায় বিভিন্ন শহর এলাকা থেকে লোকজন এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই সেদিন হত্যার শিকার হয়েছিল। তাই তাদের নাম পরিচয় অজ্ঞাতই রয়ে যায়। এদিকে উপজেলার সৈয়দকাঠী ইউনিয়নের তালাপ্রসাদ গ্রামের গনি খন্দকারের বাড়ীর বাগানে ছোট একটি গন কবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। ওই গণ-কবরে আঃ গণি খন্দকার (৬০), তার ছেলে দেলোয়ার হোসেন (২০) ও হাওলাদার বাড়ীর মক্তবের মাষ্টার সহ ৩ জনের লাশ রয়েছে। পাক বাহিনীর হাতে ওই এলাকায় তখন জোনাব আলী (৭০), তার ছেলে কালু (২৯), মোশারেফ হাওলাদার (৪৬), সত্তার বেপারী (১২), বাবরজান হাওলাদার (৪০), আঃ রহমান হাওলাদার (৩৫), তুজম্বর চৌকিদার (৬০) সহ ২৬ জন নারী-পুরুষ নিহত হয় বলে জানা যায়। এদিকে এলাকাবাসী এই মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের স্মৃতি আজও মনে ধারণ করে চলছে। বধ্যভুমি দু’টি সংরক্ষন করে পাক হানাদারদের নৃশংসতার শিকার সেই সব নাম জানা-অজানাদের স্মৃতি রক্ষায় ‘স্তম্ভ’ নির্মান করার দাবী জানিয়েছেন তাদের পরিবার, মুুক্তিযোদ্ধা ও এলাকবাসী।