বঙ্গমাতার জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি :বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্থপতি, প্রেরণায় শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব

ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ ।।

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্থপতি, প্রেরণায় ছিলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব । বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিপ্লবী মিছিলে নেতৃত্ব দেননি। কিন্তু তার গার্হস্থ্য জীবনের কর্তব্য পালন আর মন-মস্তিষ্কে স্বামী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহযোগিতা করে গেছেন আজীবন। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে কাছ থেকে দেখা ড. নীলিমা ইব্রাহিম লিখেছেন, ‘সাধারণ মানুষ তাঁর (বেগম মুজিব) নাম শুনেছে, ছবি দেখেছেÑ তাও সম্ভবত ইন্তেকালের পর। স্বাধীনতার আগে খুব কম মানুষেরই বিশেষত পরিবারের বাইরে তাকে দেখবার সুযোগ হয়েছে’। প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে আজীবন বঞ্চিত মানুষের কথা বলে বারবার নির্যাতিত হওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মনস্তাত্তি¡ক সমর্থন দিয়ে তাকে হিমালয়সম আসনে আসীন করানোর পেছনে প্রেরণা হয়ে পাশে থেকেছেন বেগম মুজিব। টুঙ্গিপাড়ার সেই খোকা থেকে শেখ মুজিব। শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু। আবার বঙ্গবন্ধু থেকে আমরা পেয়েছি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে। এর পেছনে সলতের মতো জ্বেলে জ্বেলে আজীবন স্বামীকে সাহস জুগিয়েছেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তিনি দিয়েছেন অনুপ্রেরণা ও গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শও।

যুবক বয়স থেকে শুরু করে মানুষের কথা বলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বহুবার জেলে যেতে হয়েছে। তার অবর্তমানে দলের পাশে থাকার পাশাপাশি নেতাকর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিতেন বঙ্গমাতা। নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও জননীর মতো বঙ্গমাতার কাছে আশ্রয় নিতেন, অভাব অভিযোগ শুনতেন, বাড়িয়ে দিতেন সহযোগিতার হাত। এভাবে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত পাশে থেকে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন ও আদর্শকে বাস্তবায়ন করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ‘প্রিয় রেণু’। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব প্রাতিষ্ঠানিক কোনো বড় ডিগ্রিধারী নন, কিন্তু মনের দিক থেকে তিনি ছিলেন বিশাল বড় হৃদয়ের অধিকারী। দলীয় কর্মী অথবা সাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষ, তার কাছে সাহায্য চেয়ে কেউ কখনও খালি হাতে ফেরত গেছে এমনটা কখনও শোনা যায়নি। ১৯৪৬ সালে দেশ ভাগের পর দাঙ্গা শুরু হয়। এ সময় শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব অসুস্থ; নিজে শয্যাশায়ী অবস্থায় থাকলেও স্বামীকে আক্রান্ত এলাকায় যেতে বারণ করেননি। বরং উৎসাহ দিয়ে তিনি চিঠিতে লিখেছেন, ‘আপনি শুধু আমার স্বামী হওয়ার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্যও জন্ম নিয়েছেন। দেশের কাজই আপনার সবচাইতে বড় কাজ। আপনি নিশ্চিন্ত মনে আপনার কাজে যান। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আল্লাহর ওপরে আমার ভার ছেড়ে দিন’।

তখন কতই বা বয়স ছিল তার। ১৯৩০ সালে ৮ আগস্ট জন্ম, সেই হিসাবে ১৬ বছরের মতো। এই বয়সে একজন কিশোরী বধূ নিজের সুখ-শান্তি, আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে দেশের প্রয়োজনকেই বড় করে দেখেছেন। এটা কেবল বেগম মুজিব বলেই সম্ভব হয়েছে। শৈশবেই তাদের বিয়ে হয়। বিয়ে সম্পর্কে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বার-তের বছর হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাওয়ার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, ‘তোমার বড় ছেলের সঙ্গে আমার এক নাতনির বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাব।’ রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সঙ্গে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হলো। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে।’

বিয়ে হলেও বঙ্গবন্ধু এন্ট্রান্স পাস করার পরই মূলত তাদের সংসার জীবন শুরু। ১৯৪২ সালে তরুণ শেখ মুজিব ভর্তি হন কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে। এই সময়টায় বিভিন্ন ধরনের বই পড়ে সময় কাটত শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের। তিনি ছিলেন সূ² প্রতিভাসম্পন্ন জ্ঞানী, বুদ্ধিদীপ্ত, দায়িত্ববান ও ধৈর্যশীল নারী। জাতির পিতার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ লেখার ক্ষেত্রেও মূল প্রেরণা ও উৎসাহ ছিল তার। বঙ্গবন্ধু তার আত্মজীবনীতেও সহধর্মিণীর সেই অবদানের কথা স্মরণ করেছেন। তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ বই দুটি ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল। স্ত্রীর অবদানের কথা তুলে ধরতে গিয়ে ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ এক অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বলেন, ‘আমার জীবনেও আমি দেখেছি যে গুলির সামনে আমি এগিয়ে গেলেও কোনো দিন আমার স্ত্রী আমাকে বাধা দেয় নাই। এমনও আমি দেখেছি যে, অনেকবার আমার জীবনের ১০-১১ বছর আমি জেল খেটেছি। জীবনে কোনো দিন মুখ খুলে আমার ওপর প্রতিবাদ করে নাই। তাহলে বোধ হয় জীবনে অনেক বাধা আমার আসত। এমন সময়ও আমি দেখেছি যে আমি যখন জেলে চলে গেছি, আমি এক আনা পয়সা দিয়ে যেতে পারি নাই আমার ছেলেমেয়ের কাছে। আমার সংগ্রামে তার দান যথেষ্ট রয়েছে’।

সব কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করে বঙ্গমাতা পরিবারও সামলেছেন বেশ গুছিয়ে। সবকিছুর পরও তিনিই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জীবনের রাজনীতির শ্রেষ্ঠ ছায়াসঙ্গী। তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যখনই প্রয়োজন হয়েছে তখনই সর্বাত্মক দিয়ে আওয়ামী লীগ ও নেতাকর্মীদের পাশে থেকেছেন তিনি। আন্দোলনের সময়ও তিনি প্রতিটি ঘটনা জেলখানায় দেখা করার সময় বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করতেন। সেখানে বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ শুনে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের তা জানাতেন বেগম মুজিব। অন্যদিকে কারাগারে সাক্ষাৎ করে বঙ্গবন্ধুর মনোবল দৃঢ় রাখতেও সহায়তা করতেন তিনি। বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে তখন বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা কর্মসূচি সফলের ক্ষেত্রেও তার রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। কলকাতায় অবস্থানকালে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত স্বামী শেখ মুজিবের যখনই অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হতো তখনই পিতৃ সম্পত্তি থেকে অর্জিত অর্থ বিনা দ্বিধায় পাঠিয়ে দিতেন মহীয়সী এই নারী।

আর বঙ্গবন্ধু জেলে থাকা অবস্থায় নিজের ঘরের আসবাবপত্র, অলঙ্কার বিক্রি করেও দল ও নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। একজন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হয়েও সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করতেন তিনি। তার বাড়িতে কোনো বিলাসী আসবাবপত্র ছিল না, মনে ছিল না কোনো অহংবোধ। তার সদয় আচরণ ও বিনয়ে মুগ্ধ ছিল সবাই। সন্তানদের যেমন ভালোবেসেছেন তেমন শাসনও করেছেন এই মমতাময়ী মা। পালন করে গেছেন পিতা-মাতা উভয়েরই কর্তব্য। কোমলে কঠোরে মিশ্রিত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এই সাহসী নারী স্বামীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ছেলেমেয়েদের গড়ে তোলেন।

১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ বাঙালি সেনা ও নৌবাহিনীর সদস্য এবং পদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে মামলা করে পাকিস্তান সরকার, যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে ইতিহাসে পরিচিত। এ মামলায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হলে তিনিসহ সব রাজবন্দির মুক্তি দাবিতে রাস্তায় নামে বাঙালি জনতা। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে। উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা সংস্থা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকেও গ্রেফতারের হুমকি দেয়। কিন্তু তিনি বিচলিত না হয়ে তার তী² বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মামলাটি আইনিভাবে মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে আইনজীবীদের পরামর্শ ও অর্থ জোগানোর জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে পিছু হটে আইয়ুব খানের সরকার। ওই সময় লাহোরে গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্য শেখ মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন সরকার। কিন্তু প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বেগম মুজিবের ছিল জোরালো আপত্তি। পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি দেখে তিনি বুঝতে পেরেছিলেনÑ প্যারোলে নয়, পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হবে।

এ অবস্থায় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বঙ্গমাতা বলেন, ‘তিনি (বঙ্গবন্ধু) যেন প্যারোলে মুক্তি নিয়ে লাহোর বৈঠকে না যান।’ তিনি (বঙ্গমাতা) এ-ও বুঝতে পেরেছিলেন, শেখ মুজিবের ব্যাপারে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ। পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হবে। তাই বঙ্গমাতার পরামর্শে বঙ্গবন্ধুও প্যারোলে মুক্তিতে অসম্মতি জানান। প্যারোলে মুক্তি না নেওয়া নিয়ে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের এ সিদ্ধান্তকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনন্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ১৯৫৪ সালে শেখ মুজিব তখন যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার সদস্য। ওই বছরই ছেলেমেয়েদের নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন বেগম মুজিব। তারা ওঠেন ঢাকার গেÐারিয়ার রজনী চৌধুরী লেনের একটি বাড়িতে। বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী হলে সরকারি বাসা পান, তারা ওঠেন মিন্টো রোডের সরকারি বাড়িতে। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দিলে অল্পদিনের নোটিসেই ছাড়তে হয় সেই বাড়ি। শুধু ওই ঘটনা-ই নয়। এ রকম অনেকবার বাসা পাল্টাতে হয়েছে তাদের। ১৯৬১ সালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বাড়ি করেন বঙ্গবন্ধু। এটি ছিল জাতির পিতা ও বঙ্গমাতার প্রিয় বাড়ি। এই বাড়ি নির্মাণেও বঙ্গমাতার অনেক কষ্ট ও শ্রম জড়িয়ে রয়েছে। ১৯৬১ সালের অক্টোবরে নিজেদের বাড়িতে ওঠেন তারা। এরপর এই বাড়িটিই হয়ে ওঠে নেতাকর্মীদের আপন ঠিকানা। বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকার সময় এই বাড়িতে বঙ্গমাতার কাছে ছুটে আসা নেতাকর্মীদের শুধু বুদ্ধি-পরামর্শই নয়, যার যেমন প্রয়োজন সাধ্য অনুযায়ী তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি।

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ক্ষেত্রেও রয়েছে বঙ্গমাতার বুদ্ধিমত্তার ছাপ। ওইদিনের ঘটনার স্মৃতিচারণ করে গতবছর বঙ্গমাতার জন্মদিনের এক অনুষ্ঠানে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘৭ মার্চ ভাষণের আগে কতজনের কত পরামর্শ, আমার আব্বাকে পাগল বানিয়ে ফেলছে! সবাই এসেছে-এটা বলতে হবে, ওটা বলতে হবে। আমার মা আব্বাকে খাবার দিলেন, ঘরে নিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। আব্বাকে সোজা বললেন, তুমি ১৫টা মিনিট শুয়ে বিশ্রাম নিবা। অনেকেই অনেক কথা বলবে। তুমি সারা জীবন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছ, জেল খেটেছ। তুমি জানো-কী বলতে হবে, মানুষ কী শুনতে চায়? তোমার মনে যে কথা আসবে, সে কথাই বলবা’। এরপর তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে উত্তাল জনসমুদ্রে তর্জুনী উঁচিয়ে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম-আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম-স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তার সেই ডাকেই স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি জাতি। এ কথাগুলোই সংগ্রামে যোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা-সাহস দিয়েছে।

এ থেকেই স্পষ্ট যে, বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতার ডাকে ছিল বঙ্গমাতার মনস্তাত্তি¡ক সমর্থন। এই সমর্থন তাকে সাহস জুগিয়েছিল, নির্ভার থাকতে সহযোগিতা করে। আজ এই ভাষণ বিশ^ ঐতিহ্যের অংশ। শুধু তাই নয়, মহান মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯টি মাস অসীম সাহস, দৃঢ় মনোবল ও ধৈর্য্য নিয়ে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। এই সময়টায় ছেলেমেয়েদের নিয়ে অনেকটা বন্দিদশায় কেটেছে তার। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পান। এরপর সেখান থেকেই লন্ডনে যান। এরপর ওখান থেকে প্রিয়তমা, অনুপ্রেরণাদায়ী শেখ ফজিলাতুন্নেছার সঙ্গে প্রথম কথা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। অবসান ঘটে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছার দীর্ঘ প্রতীক্ষার। এবার স্বামীর সঙ্গে শুরু হয় তার দেশগড়ার কাজ। যুদ্ধবিধ্বস্ত জন্মভ‚মিকে শস্য-শ্যামলারূপে গড়ে তুলতে জাতির পিতার পাশে দাঁড়ান বঙ্গমাতা। এ ছাড়া অনেক বীরাঙ্গনাকে বিয়ে দিয়ে তিনি তাদের সামাজিকভাবে মর্যাদাসম্পন্ন জীবন দেন। বীরাঙ্গনাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আমি তোমাদের মা’। বঙ্গমাতা বলেন, ‘এই বীরাঙ্গনা রমণীদের জন্য জাতি গর্বিত। তাদের লজ্জা কিংবা গøানিবোধের কোনো কারণ নেই। কেননা তারাই প্রথম প্রমাণ করেছেন যে, কেবল বাংলাদেশের ছেলেরাই নয়, মেয়েরাও আত্মমর্যাদাবোধে কী অসম্ভব বলীয়ান’। (সূত্র : দৈনিক বাংলার বাণী, ১৭ ফাল্গুন, ১৩৭৮ বঙ্গাব্দ)।

আন্তর্জাতিকভাবে দেশকে তুলে ধরতেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অবদান রেখেছেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তার সঙ্গে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধীর বেশ ভালো সখ্য ছিল। বিশ^নেতারা বাংলাদেশ সফরে এলেও বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকতেন অসম্ভব প্রাণশক্তিতে বলীয়ান এই মহীয়সী নারী। সহধর্মিণী হিসেবে নয়, রাজনৈতিক সহকর্মী হিসেবে আজীবন প্রিয়তম স্বামী শেখ মুজিবুর রহমানের ছায়াসঙ্গী ছিলেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ইতিহাসের কালজয়ী মহানায়কের অনুপ্রেরণাদায়িনী হয়ে পাশে ছিলেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে স্বাধীনতাবিরোধীরা। বাঙালি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে বঙ্গমাতার অবদান রয়েছে। তিনি ধূপের মতো নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে ভ‚মিকা রেখেছেন এবং বঙ্গবন্ধুকে হিমালয়সম আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। চলতি বছরে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছে বাঙালি জাতি। এরই মধ্যে ২০২০-২১ সালকে ‘মুজিববর্ষ’ ঘোষণা করা হয়েছে। বিশ^ জুড়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে অনুষ্ঠানমালারও আয়োজন করা হয়। তবে ভয়াবহ করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে এসব অনুষ্ঠানমালা স্থগিত বা সীমিত করা হয়। জাতির পিতা শেখ মুজিব-বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছার রক্তের উত্তরাধিকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পিতার আদর্শে ও তার দেখানো পথে ‘সোনার বাংলা’ গড়তে তিনি দিনরাত কাজ করছেন। উন্নত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে সবারই উচিত নিজ নিজ জায়গা থেকে দেশের কল্যাণে অবদান রাখা। তরুণ জনগোষ্ঠীকে বোঝা না হয়ে সম্পদে পরিণত হতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন কারিগরি ও বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাব্যবস্থা। পাশাপাশি আমাদের মানবিক মানুষ হতে হবে। বঙ্গমাতার আদর্শে গড়ে উঠুক এ দেশের নারীরা। তার আদর্শে আপন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে নারীর ক্ষমতায়নে দৃষ্টান্ত হোক বাংলাদেশ। জন্মদিনে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের প্রতি শ্রদ্ধা।
 
উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়, জামালপুর