আমরাই বারবার বিশ্বকে জানান দিতে পারবো, আমরা বাঙালি-বীরের জাতি : রাশেদ রউফ

আমরাই বারবার বিশ্বকে জানান দিতে পারবো, আমরা বাঙালি-বীরের জাতি : রাশেদ রউফ
আমরাই বারবার বিশ্বকে জানান দিতে পারবো, আমরা বাঙালি-বীরের জাতি : রাশেদ রউফ

রাশেদ রউফ ।। 

বাঙালি চরিত্রের নানা দিক ও মনস্তত্ত্ব নিয়ে মনীষীরা কতো কিছু লিখে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ বেশ কিছু প্রবন্ধে বাঙালি চরিত্রের জটিলতা নিয়ে লিখেছেন। লিখেছেন গোষ্ঠীগত ও সম্প্রদায়গত সীমাবদ্ধতার কথা। ‘বিদ্যাসাগর–চরিত’–এ তিনি বলেছেন : ‘আমরা আরম্ভ করি শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি, তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি, তাহা পালন করি না; ভূরি পরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিলপরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না; আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতা লাভের চেষ্টা করি না; আমরা সব কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি; পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধুলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিকস; এবং নিজের বাক–চাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবহুল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য’।

অন্যের নিন্দা ও দোষ না খুঁজে নিজেকে গড়ে তোলার দিকেই নিজের শক্তি ব্যয় করা কর্তব্য মনে করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। দীনেশচন্দ্র সেনকে এক চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, ‘বিদ্বেষে কোনো সুখ নাই, কোনো শ্লাঘা নাই, এই জন্য বিদ্বেষটার প্রতিও যাহাতে বিদ্বেষ না আসে, আমি তাহার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিয়া থাকি। জীবনপ্রদীপের তেল তো খুব বেশি নয়, সবই যদি রোষে, দ্বেষে হু হু শব্দে জ্বালাইয়া ফেলি, তবে ভালোবাসার কাজে এবং ভগবানের আরতির বেলায় কী করিব?’

আবার তিনি এটাও বলেছেন, ‘বড় হবার সব উপকরণই বাঙ্গালীর আছে, কিন্তু আরও একটি উপকরণ আছে যার জন্য বাঙ্গালীর বড় হবার কোনো আশা দেখি না– পরশ্রীকাতরতা, বাঙ্গালি এটা ছাড়তে পারবে বলে ভরসা হয় না।’

নীরদ সি চৌধুরী লন্ডনে বসে একটি বইও লিখে ফেলেছেন ‘আত্মঘাতী বাঙালি’ নামে। বইটির এক জায়গায় বাঙালিচরিত্র বিশ্লেষণ করেছেন এভাবে: ‘বাঙালির বাঙালি বলিয়া যত দিনের ইতিহাস আছে তাহার সবটুকু জুড়িয়া ভালো বাঙালি শুধু আপনভোলা বাঙালির মধ্যেই দেখা দিয়াছে। বাকি যাহারা ধন, মান, ঐহিক ক্ষমতা বা প্রতিষ্ঠা চাহিয়াছে, তাহাদের বাসনা যখন শক্তির অল্পতা বা সমাজের ভয়ের দ্বারা সংযত থাকে নাই তখন তাহারা নামে চোর–ডাকাত না হইলেও চরিত্র ধর্মে তাহাই হইয়াছে।’ এই পণ্ডিত লেখক যে উদ্দেশ্যেই নিজের জাতির বিরুদ্ধে এমন উচ্চারণ করুন না কেন, আমরা অস্বীকার করতে পারি না যে, জাতি হিসেবে বাঙালি সত্যিই আত্মঘাতী।

হুমায়ুন আজাদ আরো কঠিন করে বলেছেন বাঙালি চরিত্র নিয়ে। তিনি বাঙালি চরিত্রের স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছেন এভাবে: ‘বাঙালি পৃথিবীর সবচেয়ে অহমিকাপরায়ণ জাতিগুলোর একটি, বাস করে পৃথিবীর এক কোণে; ছোটো, জুতোর গুহার মতো, ভূভাগে; খুবই দরিদ্র, এখন পৃথিবীর দরিদ্রতম। তার দেশ ছোটো; ছোটো ভূভাগে বাস করার একটি ফল মানসিকভাবে ছোটো, সংকীর্ণ হওয়া; কূপমণ্ডুকতায় ভোগা, যাতে ভুগছে বাঙালি অনেক শতাব্দী ধরে। বাঙালির এক অংশ পড়ে আছে এক বড় দেশের একপ্রান্তে, ভুগছে প্রান্তিক মানসিকতায়; এবং আরেক দারিদ্র বিশ শতকের বড়ো কিংবদন্তি ও সত্য। আর্থিক দারিদ্র্য মানুষকে মানসিকভাবে গরিব করে, বাঙালির মনের পরিচয় নিলে তা বোঝা যায়। ইতিহাসে বাঙালির যে–পরিচয় পাওয়া যায় তা গৌরবজনক নয়; এবং এখন যে–পরিচয় পাই বাঙালির, তা আরও অগৌরবের। প্রতিটি জনগোষ্ঠীর রয়েছে একটি বিশেষ চরিত্র, যা দিয়ে তাকে শনাক্ত করা যায়; কিন্তু বাঙালির পাওয়া যায় না এমন বৈশিষ্ট্য, যার দিকে নির্দেশ করে বলা যায় এ হচ্ছে বাঙালিত্ব। প্রতিটি জনগোষ্ঠীর স্বভাবের রয়েছে একটি–দুটি প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্য; কোনো জাতি সরল, কোনো জাতি পরোপকারী, কোনো জনগোষ্ঠী উদার, বা মহৎ, বা আন্তরিক, বা কোনো জাতি স্বল্পভাষী, বা বিনয়ী, বা পরিশ্রমী, বা উচ্চাভিলাষী; কিন্তু বাঙালির নেই এমন কোনো গুণ, যার সংস্পর্শে এসে মনুষ্যত্বের প্রসার ঘটাতে পারে।’

কথাগুলোর সঙ্গে পুরোটা একমত না হলেও এটা সুস্পষ্ট যে, বিশ্বাসঘাতকতা ও পরশ্রীকাতরতা বাঙালির অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর সতীদাহপ্রথা বিলুপ্তির আন্দোলনের পথে বাধা হিসেবে বাঙালির পরশ্রীকাতরতাকে দায়ী করেছিলেন। তিনি এও বলেছেন, ‘একজন বাঙালি নারীর প্রধান শত্রু আরেক বাঙালি নারী। এর প্রধান কারণ হলো পরশ্রীকাতরতা’। আর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বড় দুঃখ করে লিখেছেন, ‘পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধ হয় দুনিয়ার কোনো ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, পরশ্রীকাতরতা। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে পরশ্রীকাতরতা বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায় পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্য বাঙালি জাতির সব রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে।’ এর চেয়ে বড় সত্যি কথা আর কী হতে পারে?

গত ১৪ জুন ছিল বরেণ্য কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের ৭৭ তম জন্মদিন। তিনি আমাদের সাহিত্যে বড় মর্যাদায় আসীন। আমাদের দেশ ও জাতির ধ্রুবতারা। মূলত তাঁর লেখালেখির উপজীব্য বিষয় ‘বাংলাদেশের মানুষ, তার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য’। জীবনের গভীর উপলব্ধির প্রকাশকে তিনি শুধু গল্প–উপন্যাসে সীমাবদ্ধ রাখেন নি, প্রবন্ধ গবেষণায়ও তিনি উপস্থাপন করেছেন অত্যন্ত শাণিত ও যৌক্তিকভাবে। তিনি তাঁর সমস্ত রচনায় ও সম্পাদনা কর্মে প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁর বিশ্বাস ও অন্তরাত্মাকে। তিনি যেমন সাহসী, নির্ভীক; তেমনি অকৃত্রিম। উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য ও গবেষণা বিষয়ক বই নিয়ে এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত হয়েছে প্রায় ১৩০টি বই। বাংলা একাডেমির সভাপতি তিনি। এর আগে পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেছেন। লেখালেখির জন্য দেশের উল্লেখযোগ্য সব পুরস্কারই তিনি পেয়েছেন। পেয়েছেন স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, চট্টগ্রাম একাডেমি মমতাজ সবুর সাহিত্য পুরস্কার, পদ্মবীণা পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা।

ইংরেজি, ফরাসি, জাপানি, রুশ, মালে, উর্দু, হিন্দি, কন্নড়, মালয়েলম্‌, মারাঠি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর গল্প–উপন্যাস। তাঁর ‘যাপিত জীবন’ উপন্যাস রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ‘নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি’ উপন্যাস যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ পত্রে পাঠ্য। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য হয়েছে ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’। ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ উপন্যাসটি পশ্চিমবঙ্গের ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগেও পাঠ্য। মার্কিন যুুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় রাজ্যের ওকটন কমিউনিটি কলেজে ২০০৬ সালের দুই সেমিস্টারে পাঠ্য ছিল ‘হাঙর নদী গ্রেনেডের’ ইংরেজি অনুবাদ ‘The Shark The River and The Grenade।’

তাঁর জন্মদিনকে আমাদের পাঠকসমাজ খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে যে যার মতো করে উদযাপন করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি শুভেচ্ছা আর অভিনন্দনের প্লাবন। আমরা মনে করি, তাঁর সুস্থ থাকা আর সাহিত্যে সক্রিয় থাকা মানে জাতির লাভ। কিন্তু অতীব পরিতাপের সঙ্গে লক্ষ করলাম, তাঁর মতো নির্ঝঞ্ঝাাট ব্যক্তিত্বও ঈর্ষার তরবারি থেকে রেহাই পায়নি। এতো অভিনন্দন ও প্রশংসা সহ্য হয়নি কারো কারো। লেখক নামধারী একজন তার ফেসবুক টাইমলাইনে যা লিখলো, তা কেবল ঈর্ষা ও পরশ্রীকাতরতা নয়, রীতিমত বেয়াদবি। এ ধরনের নমস্য ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধে লিখে সেই লোক কেবল নিজেকে ছোটো করেনি, আমাদের মর্মাহত করেছে। আমরা তাঁর প্রশংসা করতে না পারি, কিন্তু তার সম্মান হানি করতে যাবো কেন? আমাদের দুঃখ, সেই পোস্ট আবার অনেকে শেয়ারও করেছে। যা নিন্দনীয়। আমরা মনে করি, সেলিনা হোসেনের মতো ব্যক্তিত্বদের সম্মান আর মর্যাদার প্রশ্নে কোনো আপস থাকতে পারে না। তাঁরা জাতির গর্ব।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল তাঁর এক লেখায় বলেছেন, ‘যারা জীবনেও অন্য কারো প্রশংসা করেনি তারা কি জানে প্রশংসা শুনতে যত আনন্দ হয় তার চেয়ে অনেক বেশি আনন্দ হয় প্রশংসা করতে? আমার কথা বিশ্বাস না হলে বলব একবার চেষ্টা করে দেখতে। শুধু মনে রাখতে হবে তোষামোদ আর প্রশংসার মধ্যে কিন্তু অনেক পার্থক্য।’

বাঙালি–চরিত্রের নানা কুৎসিত দিক পণ্ডিত ব্যক্তিদের কলমে উঠে আসলেও আমরা ভুলবো না, বাঙালি সেই জাতি– যারা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছিল বায়ান্নতে। বাঙালি সেই জাতি– যারা একাত্তরের স্রষ্টা। সারা বিশ্বের এমন হিরন্ময় অর্জন নেই আর কোনো জাতিরই। পরশ্রীকাতরতার মতো একটা বাজে বিষয় থেকে নিজেকে মুক্ত করা গেলে আমরাই বারবার বিশ্বকে জানান দিতে পারবো, আমরা বাঙালি –বীরের জাতি।

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী

খালেদ / পোস্টকার্ড;