সীতাকুন্ডের খেজুর রসের সেই ঐতিহ্য আর নেই

সীতাকুন্ডের খেজুর রসের সেই ঐতিহ্য আর নেই
সীতাকুন্ডের খেজুর রসের সেই ঐতিহ্য আর নেই

পোস্টকার্ড প্রতিবেদক।।

মাটির নানান গুণাগুন ও প্রকৃতিগতভাবে সীতাকুন্ডের খেজুর রসের স্বাদ ও ঐতিহ্য সেই আদিকাল থেকেই। কিন্তু নানা প্রতিকুলতার কারণে খেজুর রসের সেই স্বাদ, মৌ মৌ গন্ধ ও ঐতিহ্য এখানে আর অবশিষ্ট নেই বললেই চলে। স্বাদ অনেক আগে থেকেই চলে গেছে। এভাবে ঐতিহ্য হারিয়ে এটি আস্তে আস্তে সীতাকুন্ডবাসীর কাছ থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে। এরকম চলতে থাকলে কয়েক বছরের মাথায় এটি এলাকাবাসির কাছে রূপকথার গল্প হিসেবে পরিগণিত হবে বলে মনে করেন অনেকেই।

এ নিয়ে কথা হয় কুমিরার জাহাঙ্গীর আলমের সাথে । এ সময় তিনি বলেন, এ দুর্দিনে ৩ টা খেজুর গাছ কোনমতে আগলে রেখেছি। কিন্তু গাছির অভাবে এ গাছ থেকে রস খেতে পারি না।

রসের জন্য অপেক্ষায় থাকা বাঁশবাড়িয়া এলাকার আবুল কাশেম বলেন, নাতি-নাতনিরা বেড়াতে আসবে জেনে এক সপ্তাহ আগেই এক গাছিকে বলে রেখেছিলাম, শেষ পর্যন্ত গাছি রস দিতে পারবে না বলায় বেকায়দায় পড়ে গেলাম। কুমিরার গাছি শুক্কুর বলেন, আগের মতো খেজুর গাছ না থাকায় এখন রসের সেই রমরমা অবস্থা আর নেই। ফলে শীতকাল আসলে নিজের বাড়ির ২/৩ টা খেজুর গাছ শখের বসে কাটি। তার থেকে সামান্য যা পাই তা দিয়ে নিজেদের চাহিদা মেটাতে পারি না। পরকে দেই কেমনে।

অথচ দেশের অন্যান্য স্থানের মত একসময় সীতাকুন্ড উপজেলার আনাচে-কানাচে পথ-ঘাট, মাঠ প্রান্তর সর্বত্রই সারি সারি প্রচুর খেজুর গাছ চোখে পড়ত। একেবারেই অযত্ন ও অবহেলায় জন্মাতো এসব গাছগুলো। শীত এলেই এসব খেজুর গাছকে ঘিরে শুরু হত নানা আয়োজন। চারিদিকে শুরু হত উৎসবের আমেজ। একেবারে শীতের শুরুতেই শত শত গাছি পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে তাদের দা তৈরি, দড়ি ও মাটির কলস কেনা সহ গাছ পরিস্কারের ধুম পড়ে যেত। গাছিদের কেনা দড়ি, কোমরে পেঁচিয়ে ধারালো দা ও মাটির কলস হাতে খেজুর গাছ কাটার উদ্দ্যেশে এখানকার পথ প্রান্তরে ঘুরে বেড়ানো, কাক ডাকা ভোরে ঠিল্লা (কলস) ভর্তি কাঁচা রস কাঁদে নিয়ে বাড়ি বাড়ি দৌঁড়ানো। বাড়ির বৌ-ঝিদের সেই রস জ্বাল দেয়া, পরে এসব রস দিয়ে মুখ রোচক নানা স্বাদের পিঠা পুলি, পায়েস তৈরি। খুব ভোরে ভাঁপা পিঠা গ্রাম্য ভাষায় ধুঁই পিঠা বানানোর ধূম, হাড় কাঁপানো শীত সকালে উনুনের পাশে বসে বাড়ির সবার খুব আয়েশে রস দিয়ে এসব পিঠা খাওয়ার প্রতিযোগিতা। আত্মীয় স্বজন প্রতিবেশী সহ নতুন বেয়াই বাড়িতে লাই ভর্তি করে এসব পিঠা আর রস পাঠানোর দৃশ্য দেখে মন ভরে যেত। এক কালের গ্রাম বাংলার মন ভুলানো এসব দৃশ্য দেশের কোথাও এখন দেখা যায় কিনা জানিনা।

তবে সীতাকুন্ড উপজেলার কোন পাড়া বা গ্রামে শীতে খেজুর রসের সেই জৌলুস আগের মত নেই বললেই চলে। কারণ একদিকে এসব খেজুর গাছ রক্ষায় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের অভাব সহ নানা প্রতিকূলতার কারণে এসব এলাকা হতে খেজুর গাছ বিলুপ্তি ঘটা অন্য দিকে ভেজালের জালে আটকে খেজুর রসের মৌ মৌ গন্ধ ও নিজস্ব স্বাদ হারিয়ে গেছে। এর উপর যে টুকু অবশিষ্ট ছিল তাও আবার গত কয়েক বছর থেকে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্তের ভয়ে সরকারের তরফ থেকে কাচা রস না খাওয়ার প্রচারে সেই টুকুও নিঃশেষ হয়ে গেছে। আবার অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির কারণেও অনেকের কাছে এটি এবার অধরা রয়ে গেছে বলে জানা গেছে। ব্যক্তি পর্যায়ে এভাবে অধরা থাকতে থাকতে এটি একসময় পুরো সীতাকুন্ডবাসীর জন্য অধরা হয়ে যাবে বলে ধারণা অনেকেরই। যদি না এটি রক্ষায় এখনই কোন উদ্যোগ নেয়া না হয়।

স্থানীয় কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, খেজুর গাছ আবাদি জমির কোন ক্ষতি করে না। সড়কপথ, পতিত জমি, ক্ষেতের আইল, পুকুর পাড়, বাড়ির আঙ্গিনায় খেজুর গাছ লাগানো যায়। অভিজ্ঞ মহল মনে করেন খেজুর গাছের আবাদ বাড়াতে পারলে খেজুর রসে মুখরিত হবে সীতাকুন্ডের এসব গ্রামীণ জনপথ। এতে একদিকে যেমন আর্থিক লাভবান হবে অনেকেই তেমনি রক্ষা পাবে বাঙালির ঐতিহ্যে খেজুর রসের যশ ও খ্যাতি।