পাহাড় কাটা ও পুকুর ভরাট মামলায় জরিমানা শেষে পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে নির্দেশ দিলেও তা হয়না!

আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস।

পাহাড় কাটা ও পুকুর ভরাট মামলায় জরিমানা শেষে পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে নির্দেশ দিলেও তা হয়না!
পাহাড় কাটা ও পুকুর ভরাট মামলায় জরিমানা শেষে পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে নির্দেশ দিলেও তা হয়না!

নিজস্ব প্রতিবেদন।। 

দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিনিয়ত চলছে পাহাড় কাটা ও পুকুর ভরাটের মহাউৎসব । আর এসব করছে সমাজের প্রভাবশালীরা।কেউ করছে দিনের আলোতে আবার কেউ কেউ করছে রাতের আঁধারে । কারোটা প্রকাশ পায় কারোটা আড়ালে থেকে যায় । দু'একটাতে হানা দেয় দেশের পরিবেশ অধিদপ্তর।  

পাহাড় কাটা ও পুকুর ভরাটের অভিযোগে মামলা হয়- শুনানি হয় -শেষে পরিবেশগত ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। কিন্তু আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত কোনো নজির স্থাপন করতে পারেনি পরিবেশ অধিদপ্তর।

ক্ষতিপূরণ কিংবা জরিমানার অর্থ আদায় সম্ভব হলেও ভরাটকৃত পুকুর কিংবা কর্তনকৃত পাহাড়ের কোনোটাই আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়নি। বিষয়টিতে পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, আইনি সীমাবদ্ধতার কথা। অন্যদিকে পরিবেশ অধিদপ্তরের সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি পরিবেশ পুলিশিংয়ের দাবি জানিয়েছেন পরিবেশবাদীরা।

আজ ৫ জুন বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হবে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। ‘প্রকৃতি সংরক্ষণ করি, প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করি’ এ স্লোগানে এবারের পরিবেশ দিবস পালিত হবে। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির ঘোষণা অনুযায়ী এবার প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- ‘প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার, হোক সবার অঙ্গীকার’। বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়াও পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন নানান কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দিয়েছে।

এদিকে পাহাড় কাটা, বৃক্ষ কর্তন, বনাঞ্চল উজাড়, নদী-খাল-জলাশয় ভরাট ও দূষণ, অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মানবসৃষ্ট এসব দূষণের কারণে বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। দিন দিন বাড়ছে ঘূর্ণিঝড় ও সাইক্লোনের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শংকাও। বিগত সময়ে বর্ষায় চট্টগ্রাম মহানগরীতে পাহাড়ধসে অসংখ্য প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। তারপরেও থেমে নেই পাহাড় কাটা। পাহাড়ের পাদদেশে বসতি নির্মাণ করে বসবাস।

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক মো. নূরুল্লাহ নূরী বলেন, ‘কাটা পাহাড় ও ভরাটকৃত পুকুর পুনরুদ্ধারের বিষয়ে আইনে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। কিন্তু এ ধরণের একটি ঘটনায় উচ্চ আদালতের একটি আদেশ রয়েছে। কর্তনকৃত পাহাড় আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আমরা উচ্চ আদালতের সেই আদেশকে সামনে রেখে শুনানিতে আদেশ দেই।’ তিনি বলেন, ‘আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশ কিংবা প্রশাসন যেভাবে প্রয়োগ করতে পারে, সেভাবে পরিবেশ অধিদপ্তর পারে না। চট্টগ্রাম মহানগরীতে ৬০ লাখ বাসিন্দা রয়েছে। এতো বড়ো শহরে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত করার বিষয়ে, বিশেষ করে পাহাড় কাটা, পুকুর ভরাট, খাল নদী দূষণ যে হারে হচ্ছে, তা নিবারণের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পরিবেশ অধিদপ্তরের নেই। জনবলেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে।’

এদিকে করোনা মহামারী ও সরকারি লকডাউনে প্রশাসনের নজরদারি কমে যাওয়ার সুযোগে পাহাড়খেকোরা বেপারোয়া হয়ে উঠে। গত এক বছরে ভরাট হয় অসংখ্য পুকুরও। সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরীর বায়েজিদ-ফৌজদারহাট সংযোগ সড়ক লাগোয়া জঙ্গল সলিমপুর, জাফরাবাদ, জালালাবাদ, আরেফিন নগর এলাকার সবুজ পাহাড়গুলো কেটে সাবাড় করা হচ্ছে। তাছাড়া লালখান বাজার মতিঝর্ণা পাহাড়, আকবর শাহ এলাকার রেলওয়ের পাহাড় ঝিল-১, ঝিল-২, গরীব উল্লাহ শাহ আবাসিক এলাকার পেছনে অপরূপ হাউজিং সোসাইটি লাগোয়া পাহাড় দখল করে, কেটে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি তৈরি করা হয়েছে। অন্যদিকে নগরীর ম্যানোলা পাহাড়, আসকারদীঘি পাড়ের গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকের পাহাড়েও পড়েছে প্রভাবশালীদের কুদৃষ্টি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের ১ জুন নগরীর এস এস খালেদ রোডের গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকের পাহাড় কাটার অভিযোগে জনৈক সঞ্জীব দত্তসহ আরও কয়েকজনকে ২৮ লাখ টাকা জরিমানার পাশাপাশি কাটা পাহাড়টি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার আদেশ দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। ওই ঘটনায় জরিমানার অর্থ পরিশোধের পদক্ষেপ নেওয়া হলেও এখনো সেই পাহাড় আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়নি। একইভাবে নগরীর জিইসি সংলগ্ন ম্যানোলা পাহাড়ের পাদদেশ কেটে স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। অন্যদিকে গত ১ জানুয়ারি নগরীর মনসুরাবাদে পুকুর ভরাটের অভিযোগে স্থানীয় একটি ওয়াকফ এস্টেটের মোতোয়াল্লীকে জরিমানা করলেও ভরাটকৃত পুকুরগুলো পুনরুদ্ধারের পদক্ষেপ নেয়নি পরিবেশ অধিদপ্তর। বর্তমানে পুকুরগুলোতে তৈরি হয়েছে নানান স্থাপনা। তাছাড়া নগরীর কেবি আমান আলী রোডের পশ্চিম বাকলিয়া বড় মিয়া মসজিদ সংলগ্ন ৩৮ শতকের পুকুরটির একাংশ ভরাট করেও বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে।

নগরীতে পুকুর ভরাট নতুন নয়। ঐতিহ্যবাহী পুকুরগুলোও ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসছে। নগরীর ঐতিহ্যবাহী আসকারদীঘি, বলুয়ারদীঘি, ভেলুয়ারদীঘি, লালদীঘি, আগ্রাবাদ ডেবাও সংকুচিত হয়েছে নানান স্থাপনা নির্মাণের কারণে। ভরাট হয়ে গেছে নগরীর নাম করা অনেক পুকুরও। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে অগোচরে ভরাট করা হচ্ছে শত শত পুকুর, ডোবাও।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. দানেশ মিয়া বলেন, ‘বড় বড় প্রভাবশালীরা পাহাড় কাটছে, পুকুর ভরাট করছে। আবার অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্যেও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো পাহাড় কাটছে। এ ধরণের ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন থাকলেও একটি প্রকল্পের জন্য কী পরিমাণ পাহাড় কাটতে হবে? সেজন্য কোনো স্টাডি প্রতিষ্ঠানগুলোর থাকে না। সড়ক তৈরির জন্য পাহাড় কাটতে হলে ২২ডিগ্রি এঙ্গেলে পাহাড় কাটতে হয়, কিন্তু এখানে খাড়াখাড়ি পাহাড় কাটা হচ্ছে। এতে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। প্রাণহানি হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘পাহাড় কাটার কারণে পরিবেশের ইকো সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখন পাহাড় কাটা, পুকুর ভরাট কিংবা পরিবেশ দূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরকে আরও কার্যকর করতে হবে। আইনি যেসকল সীমাবদ্ধতা রয়েছে, সেগুলোও সংশোধনের জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। তাছাড়া নতুন করে পরিবেশকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। ইকো সিস্টেমগুলো কিভাবে কার্যকর করা যায়, সেজন্য উদ্যোগী হতে হবে। পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায় সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে।’

পরিবেশ দূষণ বন্ধে পরিবেশ আইনকে আরও সময়োপযোগী করার তাগিদ দিয়েছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক এ বি এম আবু নোমান। তিনি বলেন, ‘পরিবেশ রক্ষায় পরিবেশ সংরক্ষন আইন রয়েছে। পরিবেশ আদালত রয়েছে। পরিবেশ রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তরকে আইনি ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আইন বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা পরিবেশ অধিদপ্তরের নেই। আবার পাহাড় কাটা কিংবা পুকুর ভরাটসহ পরিবেশ দূষণ বন্ধে পুলিশ প্রশাসন, জেলা প্রশাসন, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভাসহ স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা প্রয়োজন। এজন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের সাথে সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয় প্রয়োজন। কিন্তু আইনে প্রশাসনের সাথে সমন্বয়ের সুস্পষ্ট কিছু বলা নেই।’

তিনি বলেন, বর্তমানে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট রয়েছে। নারী শিশুকে সহায়তার জন্য কুইক রেসপন্স ইউনিট আছে। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটসহ বিশেষায়িত কয়েকটি ইউনিট আছে। এ ধরণের পরিবেশ পুলিশ ইউনিটও থাকা উচিত। এজন্য আইনের প্রয়োজন হয় না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চাইলেই একটি আদেশের মাধ্যমে পুলিশের মধ্যে এ ধরণের একটি ইউনিট তৈরি করতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে বিভাগীয় শহরগুলোতে করা গেলে পরিবেশ রক্ষায় অনেক উপকারে আসবে। আবার এ ইউনিটের সাথে পরিবেশ অধিদপ্তরের সাথে সুক্ষ্ম সমন্বয়ের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। যাতে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্তের কোনো অভিযোগ আসলে পরিবেশ অধিদপ্তর চাইলেই যাতে দ্রুততম সময়ে পরিবেশ পুলিশ ইউনিট সহযোগিতা দিতে পারে।’ আজাদী