বঙ্গবন্ধু সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা অন্তর্ভুক্ত করেন, ধর্মের নামে ব্যবসার বিপক্ষে ছিলেন

বঙ্গবন্ধু সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা অন্তর্ভুক্ত করেন, ধর্মের নামে ব্যবসার বিপক্ষে ছিলেন
বঙ্গবন্ধু সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা অন্তর্ভুক্ত করেন- ধর্মের নামে ব্যবসার বিপক্ষে ছিলেন

নিজস্ব প্রতিবেদক।।

১৯৭২ সালের সংবিধানে দেশের সব ধর্মের মানুষের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার শাসন আমলে বাংলার মানুষের অসম্প্রদায়িক চেতনা অক্ষুণ্ন ছিল।

বঙ্গবন্ধু যেমন ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক বাঙালি, তেমনি ছিলেন একজন প্রকৃত মুসলমান। বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের কর্মপ্রয়াস ছিল বাংলার জনগণের শোষণ ও মুক্তির অন্বেষণ। তিনি ইসলামের উদারনৈতিক অসাম্প্রদায়িক সাম্য ও মৈত্রীর চিরন্তন ভিত্তিকে মনে প্রাণে বিশ^াস করতেন। স্বাধীন বাংলাদেশে ইসলামী অগ্রযাত্রায় বঙ্গবন্ধুর অবদান অবিস্মরণীয়। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে ইসলামের প্রচার প্রসারে যে অবদান রেখেছেন, তা সমকালীন ইতিহাসে বিরল।

বঙ্গবন্ধু চেতনায় ধর্ম নিরপেক্ষ হলেও তিনি ভুলে যাননি এদেশের বেশিরভাগ মানুষ মুসলমান। তাই ১৯৭৫ সালের ২২ মার্চ এক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ইসলামিক ফাউন্ডেশন গঠন করেন। একই বছরের ২৮ মার্চ ইসলামিক ফাউন্ডেশন আইন তৈরি হয়। তিনি শুধু ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠাই করেননি, এর জন্য যথাযথ স্থানও বরাদ্দ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে ইসলামের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, মর্মবাণী মানুষের কাছে পৌঁছাতে অর্থবহ ভূমিকা পালন করছে। বঙ্গবন্ধু জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের পুনর্নির্মাণ করেন।

আন্তর্জাতিক ইসলামী সংস্থা ওআইসিতে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও বঙ্গবন্ধুর অবদান অবিস্মরণীয়। তাঁর আন্তরিকতায় ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ওআইসির সদস্যপদ লাভ করে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিরোধিতা সত্ত্বেও বাংলাদেশকে তিনি ওআইসি সম্মেলনে পাঠান।

ধর্মকে ব্যবহার করে কেউ যাতে কারও ক্ষতি না করতে পারে এবং এক ধর্মের মানুষ যেন অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, প্রত্যেকে যেন স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারে সেদিকে গুরুত্বারোপ করেন বঙ্গবন্ধু। জাতীয় সংসদে এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে। অন্য সম্প্রদায় তাদের ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবে, যে কথাটি ইসলামেও স্বীকৃত। তিনি আরও বলেন, ‘এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে।’ এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে লুটপাট করে খাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার, আল-বদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না।’

বঙ্গবন্ধু যে সোনার বাংলাদেশ চেয়েছেন তাতে কোনো প্রকার সাম্প্রদায়িকতার স্থান ছিল না। তিনি চেয়েছেন কেউ যাতে কারও ধর্ম অবমাননা না করেন। ইসলাম ধর্মে অন্য ধর্মকে শ্রদ্ধা করার কথা বলা আছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে ইসলামের সেই প্রকৃত বাণী ও মাহাত্ম্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়ে গেছেন।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন ছাড়াও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন করেন। তিনি বিশ^ এজতেমা করার জন্য সরকারি জায়গা বরাদ্দ করেন। পাশাপাশি পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। শুধু তাই নয়, তিনি ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে আয়োজিত মাহফিলেরও উদ্বোধন করেন। শেখ মুজিবুর রহমান হজব্রত পালন করার জন্য সরকারি অনুদান ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। তিনি ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোতে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন। যেমনÑ ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.), শবে কদর, শবে বরাত উপলক্ষে সরকারি ছুটির ব্যবস্থা করা।

তিনি টেলিভিশন ও বেতারে কোরআনের বাণী ও হাদিস প্রচারের জন্যে নির্দেশ দেন। মুসলিম রাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বিস্তারেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। বঙ্গবন্ধুর আন্তরিকতায় প্রথমবারের মতো রাশিয়াতে তাবলীগ জামাত প্রেরিত হয়। অন্যদিকে ইসলামী দেশগুলোর ক্রান্তিলগ্নে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ওই দেশগুলোকে সমর্থন দিয়েছে। ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ফিলিস্তিনের পক্ষ অবলম্বন করেন। শুধু তাই নয় তিনি ফিলিস্তিন যোদ্ধাদের জন্য কয়েক লাখ কার্টুন চা প্রেরণ করেন। এমনকি তাঁর উদ্যোগেই রেসকোর্সের ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা, মদ, জুয়ার আসর নিষিদ্ধ করা হয়। যেগুলো ইসলামেও নিষিদ্ধ।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে বেতার ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে, আমরা ইসলামে বিশ^াসী নই। এ কথার জবাবে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য, আমার লেবাস সর্বস্ব ইসলামে বিশ^াসী নই। আমরা বিশ^াসী ইনসাফের ইসলামে। আমাদের ইসলাম হজরত রাসুলে করিম (সা.)-এর ইসলাম। যে ইসলাম জগৎবাসীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র। ইসলামের প্রবক্তা সেজে পাকিস্তানের মাটিতে বারবার যারা অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ, বঞ্চনার পৃষ্ঠপোষকতা করছে, আমাদের সংগ্রাম সেই মুনাফিকদের বিরুদ্ধে। যে দেশের শতকরা ৯৫ জন মুসলমান, সে দেশে ইসলামবিরোধী আইন পাসের ভাবনা ভাবতে পারে তারাই, ইসলামকে যারা ব্যবহার করে দুনিয়াকে শায়েস্তা করার জন্য।’

জানা যায়, বঙ্গবন্ধু ছিলেন বংশ পরম্পরায় বাগদাদের দরবেশ বংশের লোক। তার বাবা-মা সবাই ধার্মিক ছিলেন। তিনি ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করাকে ঘৃণা করতেন। তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে সব মানুষের স্ব-স্ব ধর্মের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার উৎসই ছিল রাসুল (সা.)-এর মদিনা সনদের শিক্ষার অনুসরণে। ‘মদিনা সনদে ইহুদি-নাসারা, পৌত্তলিক ও মুসলমান সবাই নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে।’ ইসলামই প্রথম নিরপেক্ষতার বাণী বিশ্ব প্রচার করেছে, ‘তোমার ধর্ম তোমার জন্য, আমার ধর্ম আমার জন্য এবং ধর্মে কোনো জুলুম বা অত্যাচার নেই।’ এ কথা পবিত্র কোরআন ছাড়া আর কোনো ধর্মগ্রন্থ প্রচার করেনি। ধর্মকে বঙ্গবন্ধু শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু ধর্মান্ধতাকে তিনি মনে-প্রাণে ঘৃণা করতেন। এ কারণেই তিনি এদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের গোড়া হতেই ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতার স্বীকৃতির মধ্যে তাই এদেশের জনগণের সুদীর্ঘ তিক্ত অভিজ্ঞতা ও বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ প্রত্যয়ের ফলে ঘটেছে বা তা বাস্তবায়ন করে এ জাতি উন্নত জাতিতে পরিণত হয়েছে।