আবু ত্ব-হা আদনান কি আসলেই ইসলামী বক্তা নাকি জঙ্গিবাদের প্রচারক : প্রভাষ আমিন

আবু ত্ব-হা আদনান কি আসলেই ইসলামী বক্তা নাকি জঙ্গিবাদের প্রচারক : প্রভাষ আমিন
আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনান

প্রভাষ আমিন ।।

অবশেষে ফিরে এসেছেন আলোচিত বক্তা আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনান এবং তার সঙ্গীরা । এটা বিশাল স্বস্তির। তাদের হারিয়ে যাওয়া উদ্বিগ্ন করেছিল অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকেও।

স্বীকার করছি, নিখোঁজ হওয়ার আগে আমি ত্ব-হার কোনো বক্তব্য শুনিনি, আসলে নামই শুনিনি। তিনি নিখোঁজ হওয়ার পর ফেসবুকে হাহাকার দেখে মনে হচ্ছিল আমিই বুঝি বোকা, বাকি সবাই বুঝি তাকে চেনেন। আমি চিনি আর না চিনি, একজন মানুষ হারিয়ে যাওয়াটা দুঃখজনক, সেটা অবশ্যই রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। তাই আমি আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনানের খোঁজ চেয়ে ফেসবুকে লিখেছিও।

এটা ঠিক বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি বেশ খারাপ। গত কয়েক বছরে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী বা ভিন্নমতের অনেকেই গুম হয়েছেন, যারা আর কখনও ফিরে আসেননি। আবার অনেককে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়েছে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি যখন তলানিতে, তখন যে কারও নিখোঁজ হওয়াটা আমাদের উদ্বিগ্ন করে। কিন্তু সব হারিয়ে যাওয়াই গুম নয়।

আমাদের ছেলেবেলায় বন্ধু-বান্ধবদের কেউ কেউ বাড়ি থেকে পালিয়ে যেত। কয়েকদিন ঢাকা বা কক্সবাজারে বেড়িয়ে টাকা ফুরিয়ে গেলে ফিরে আসত। ফিরে আসার পর কঠিন পিটুনি খেতে হতো তাদের। তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এত সক্রিয় ছিল না বলে কিশোরদের এসব অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে তেমন আলোচনা হতো না। আমার ছোট চাচাও ছেলেবেলায় বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন। তাকে পাওয়া গিয়েছিল অনেক পরে। তখন তিনি খুলনায় বিয়ে-শাদি করে সংসার পেতে বসেছেন। তবে এটা ঠিক তখনও কেউ কেউ একেবারে হারিয়ে গেছেন।

তারা কোথায় গেছেন, জানি না। ছেলেধরার আতঙ্কও ছিল আমাদের ছেলেবেলায়। তবে ছেলেবেলার সেই হারিয়ে যাওয়া আর এখনকার ভিন্নমতের মানুষের গুম হয়ে যাওয়া অবশ্যই এক নয়। কেউ নিখোঁজ হলেই সরকারের দিকে আঙুল ওঠে। অভিযোগ ওঠে, সরকারের বাহিনীর লোকজন তুলে নিয়ে গেছে। নিখোঁজ হওয়ার মাসখানেক পর পুলিশ যখন কাউকে গ্রেফতার দেখায়, তখন বুঝি তাকে তুলে নিয়ে যাওয়াতে সরকারের হাত ছিল। দেশের সব মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। কেউ হারিয়ে গেলে, তাকে খুঁজে বের করাও সরকারের দায়িত্ব। গুমের সংস্কৃতি চালুর পর সব হারিয়ে যাওয়াকেই প্রাথমিকভাবে এক পাল্লায় মেপে সরকারকে দায় দেওয়ার প্রবণতা শুরু হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সব হারিয়ে যাওয়া এক নয়। আমাদের ছেলেবেলার মতো বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা যেমন এখনও আছে, আবার পালিয়ে গিয়ে জঙ্গিদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার ঘটনাও আছে। হলি আর্টিজানে হামলার পর আমরা জেনেছি, হামলাকারীরা বিভিন্ন বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল এবং তারা পালিয়েছিল, গুম হয়নি।

আবু ত্ব-হার নিখোঁজ হওয়ার পরও যথারীতি সন্দেহের তীর ছিল সরকারের দিকে। ইসলামী বক্তা বলেই ‘ইসলামবিরোধী’ সরকার তাকে তুলে নিয়েছে, এই ধারণাও প্রচার করছিলেন কেউ কেউ। কেউ বলেছেন মোসাদ, কেউ বলেছেন ‘র’ তাকে তুলে নিয়ে গেছে। কারও কারও সন্দেহ ছিল, ত্ব-হা তালেবানদের সঙ্গে যোগ দিতে আফগানিস্তানে চলে গেছেন। কোনোটাই আমার বিশ^াস হতে চায়নি। আমি চিনি না বলে নয়, পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, আবু ত্ব-হা এমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ নন যে তাকে গুম করে ফেলতে হবে। মামুনুলের মতো রাঘববোয়ালকে যেখানে সরকার গ্রেফতার করেছে, সেখানে ত্ব-হার মতো চুনোপুঁটিকে গুম করতে হবে কেন? তবে চুনোপুঁটি হোক আর রাঘববোয়াল, কেউ হারিয়ে গেলে তাকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের। কিন্তু কেউ জেগে ঘুমালে যেমন তাকে জাগানো যায় না, তেমনি কেউ স্বেচ্ছায় আত্মগোপন করে থাকলে তাকে খুঁজে বের করাও কঠিন। পুলিশও পারেনি। ত্ব-হা নিজেই ৮ দিন পর বেরিয়ে এসেছেন। পুলিশ দাবি করেছে, ত্ব-হা গাইবান্ধায় এক বন্ধুর বাসায় আত্মগোপন করেছিলেন।

আবু ত্ব-হা নিখোঁজ হওয়ার পর আমি তার সন্ধান চেয়ে ফেসবুকে লিখেছি। স্ট্যাটাস দেওয়ার পর আমার এক শুভাকাক্সক্ষী ইনবক্সে জানালেন, সবকিছু নিয়ে আপনাকে লিখতে হবে কেন? সরকারকে অনেক কিছু করতে হয়, আপনি সব বুঝবেন না। আর ত্ব-হা তো আপনার আদর্শের লোক নন। আমি তাকে বলেছি, ত্ব-হা কে আমি চিনিই না, তাই তিনি আমার আদর্শের কি না সেটাও জানি না। আমার পক্ষের লোক হোক আর বিপক্ষের, একজন লোক হারিয়ে যাবে সেটা হতে পারে না। আমি আইনের শাসন চাই, বিচারবহির্ভূত কোনো কর্মকাণ্ড সমর্থনের কোনো সুযোগ নেই। আমি তো কখনও নিজামী বা গোলাম আযমের ক্রসফায়ার চাইনি, আইনি প্রক্রিয়ায় বিচার চেয়েছি। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের ফাঁসি পর্যন্ত নিতে শেখ হাসিনাকে দুবার ক্ষমতায় আসতে হয়েছে। তিনি ক্রসফায়ার তো নয়ই, খুনিদের দ্রুত বিচারের জন্য আলাদা কোনো ট্রাইব্যুনালও গঠন করেননি। তাই একজন মানুষ আমার পক্ষের হোক আর বিপক্ষের, কারও প্রতি বিচারবহির্ভূত কোনো পদক্ষেপ সমর্থন করার কোনো সুযোগ নেই। আইনের সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার সবার আছে।

৮ দিন পর আবু ত্ব-হা যখন ফিরে এলেন, তখন জানা গেল, আদর্শ-ফাদর্শ কিছু না; কোনো গোয়েন্দা সংস্থার চাপও নয়, আসলে দুই স্ত্রীর চাপ সামলাতে না পেরে তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন। তার প্রথম স্ত্রী হাবিবা নুর থাকেন রংপুরে। আর তার দ্বিতীয় স্ত্রী সাবেকুন নাহার থাকেন ঢাকায়। ত্ব-হা আবার সাবেকুন নাহারের চতুর্থ স্বামী। এই টানাটানিতেই বিধ্বস্ত বেচারা ত্ব-হা একটু নিরিবিলিতে থাকতে গিয়েছিলেন।

নিখোঁজ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি আবু ত্ব-হার নামই জানতাম না। ফেসবুকে তোলপাড় দেখে কৌতূহল হলো। খোঁজ নিয়ে জানলাম, তার প্রকৃত নাম সুহাম্মদ আফসানুল আদনান, ডাক নাম তোয়াহা। তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে দর্শনে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তারপর তিনি হঠাৎ করেই ইসলামী বক্তা বনে যান, পাল্টে ফেলেন নিজের নামও। ‘ইসলামী বক্তা’ই এখন তার পেশা। ত্ব-হাকে তার অনুসারীরা ইসলামী বক্তা, ইসলামী স্কলার, ধর্মীয় নেতা হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছে। এই বিশেষণগুলোর সংজ্ঞা কী, মানদণ্ড কী জানি না। দর্শনে মাস্টার্স করা একজন ব্যক্তি ইসলামী স্কলার হন কী করে?

তবে ইউটিউবে তিনি বেশ জনপ্রিয়ও। ইউটিউবে তার অল্প কিছু আমি শুনেছি। অন্য বক্তাদের সঙ্গে তার পার্থক্য হলো, অন্যদের মতো তিনি গলার রগ ফুলিয়ে বিদ্বেষ ছড়ান না। ত্ব-হা খুব ঠান্ডা মাথায়, শুদ্ধ উচ্চারণে, তার মতো যুক্তি দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ান। তার বক্তব্য শুনলে মনে হতে পারে, শেষ জমানা চলে এসেছে। শিগগিরই কেয়ামত হবে। তিনি সবাইকে কেয়ামতের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানান। ‘মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজী’ এই তত্ত্বে তিনি মানুষকে সহিংসতায় উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি প্রচলিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।

ত্ব-হা খুব স্পষ্টভাবেই তালেবানদের আদর্শ প্রচার করেন, জঙ্গিবাদের পথে ডাকেন। কে করেছে জানি না, তবে তার মগজ ধোলাই হয়েছে খুব ভালোভাবেই। এখন তিনি ঠান্ডা মাথায় সেই বিভ্রান্তি সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছেন। তার কোনো বক্তব্য শোনার আগেই আমি ফেসবুকে লিখেছিলাম, যদি তার বক্তব্যে বেআইনি কিছু থাকে প্রচলিত আইনে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া যেতে পারে। এখন তার কিছু বক্তব্য শোনার পর আমি স্পষ্ট করেই দাবি জানাচ্ছি, আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হোক। অবিলম্বে তাকে গ্রেফতার করা হোক। ইউটিউবে তার যে জনপ্রিয়তা, তরুণ সমাজ তার বক্তব্য শুনে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হতে পারে। এখনই সতর্ক না হলে এই চুনোপুঁটি ত্ব-হাই একদিন রাঘববোয়াল হয়ে যেতে পারে। আর তার মতো আরও অনেকের মগজ ধোলাই হলে সমাজের জন্য বিপদ, ইসলামের জন্যও বিপদ।

লেখকঃ হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ