এখন আর গ্রামের মানুষ হাঁটে না, হাঁটতে ভুলে গেছে 

এখন আর গ্রামের মানুষ হাঁটে না, হাঁটতে ভুলে গেছে 
এখন আর গ্রামের মানুষ হাঁটে না, হাঁটতে ভুলে গেছে 

আব্দুর রাজ্জাক ।। 

বেশ কয়েক দিন গ্রামের বাড়িতে থেকে এলাম। সাধারণ মানুষ, বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে গল্পগুজব করে পাঁচ দিন পার হয়ে গেল। মফস্বলের ছোট্ট উপজেলা শহর বানারীপাড়া ও উজিরপুরের মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলাম।

এখানে দৈনন্দিন জীবনের অনেক বিষয়ই পরিবর্তন হয়েছে। উপজেলা শহর, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে গ্রাম পর্যন্ত রাস্তা মোটামুটি পাকা। প্রতিটি রাস্তায়, রাস্তার মোড়ে গ্রামের চায়ের দোকানের সামনে থেকে শুরু করে বাজার বা স্কুল-কলেজ পর্যন্ত সব জায়গায় অটোরিকশা চলে। এখন আর গ্রামের মানুষ কেউ হাঁটে না। এক থেকে দেড় কিলোমিটার রাস্তা যা আগে সব সময় সবাই হেঁটে যেত, এখন কেউ কল্পনাই করতে পারে না হেঁটে এই এক-দেড় কিলোমিটার জায়গা পাড়ি দেবে। ঘর থেকে বের হলেই রাস্তা আছে, রাস্তায় দাঁড়ানো অটোরিকশা আছে, এই অটোরিকশাগুলো ব্যাটারিচালিত।

অটোরিকশা তিন ধরনের দেখলাম। ছোট্ট অটোরিকশাকে মিনি বেবিট্যাক্সি বলা যায়। সামনে একজন, পেছনে দুজন নিয়ে অনায়াসে চলাচল করতে পারে। এই অটোরিকশাকে আমাদের এলাকায় বলা হয় ‘বউ গাড়ি’। ব্যাটারিচালিত বড় অটোরিকশাও আছে এখানে। পেছনে চারজন, সামনে দুজন—মোট ছয়জন নিয়ে অনায়াসে চলাচল করে। আরও আছে আগের সেই রিকশা, যেটায় দুজন চড়ে। পরিবর্তন হলো, এই রিকশা এখন আর মানুষ পায়ের শক্তি দিয়ে চালায় না, এটাও ব্যাটারিচালিত হয়ে গেছে। এসব বাদে আরও আছে ব্যাটারিচালিত ভ্যান গাড়ি।

এক কথায় বলতে চাইছি, রাস্তায় বের হলে এই চার ধরনের ব্যাটারিচালিত যান সহজেই পাওয়া যায়। চলাচলের জন্য এসব যানবাহন ব্যবহার করে মানুষ।

সমাজ পরিবর্তনশীল, মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্মের চলাফেরায়ও পরিবর্তন হয়ে গেছে। বানারীপাড়ার মতো ছোট্ট একটি জায়গায় প্রায় তিন শ বউ গাড়ি আছে; ব্যাটারিচালিত বড় তিন চাকার গাড়ি, ছোট রিকশাসহ এসব যানের সংখ্যা হবে প্রায় ছয় শ। মানুষ স্বাভাবিক হাঁটাচলা পরিহার করে সবাই রিকশায় চলাচল করে। এই পরিবহন সস্তা, যখন-তখন পাওয়া যায়। তাই তো মানুষের অভ্যাসের পরিবর্তন হয়ে গেছে।

মানুষ আরাম-আয়েশে থাকতে চায়, কষ্ট কম করতে চায়—এটা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। তাই তো সামান্য এক থেকে দেড় কিলোমিটার, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়েও কম জায়গায় যাওয়ার জন্য যানবাহন ব্যবহার করে। মানুষ কায়িক পরিশ্রম করতে চায় না। যেটা শরীরের জন্য আবশ্যক, সেই পরিমাণ কায়িক পরিশ্রমও করতে চায় না। এই অভ্যাসগত পরিবর্তনের জন্য মানুষের শরীরে নানা ধরনের রোগব্যাধি বাসা বাঁধছে। সুস্থ সবল মানুষ দিনে কম করে হলেও ৩০ থেকে ৪০ মিনিট হাঁটা উচিত। অবশ্য যাঁরা কঠিন পরিশ্রম করেন, তাঁরা এই বিধান না মানলেও চলবে। বিনা কারণে ঘোরাফেরার জন্য, সামান্য বাজার করার জন্য, একটু হাঁটা দরকার মানুষের। কিন্তু মানুষ হাঁটা ভুলে গেছে।

আমরা ছোটবেলায় যে পথটুকু হেঁটে স্কুল-কলেজে যেতাম, এখন কেউ কল্পনাও করতে পারে না যে এই জায়গাটুকু হেঁটে স্কুলে বা কলেজে যাবে। ছাত্রছাত্রীরা একইভাবে সামান্য পথটুকু যানবাহনে চলাচল করে। অবসর সময়ে মোবাইলে বিভিন্ন গেম খেলে। গত পাঁচ দিনে আমি দুই উপজেলার অনেক ইউনিয়নের গ্রাম ঘুরে বেড়িয়েছি। কোথাও কোনো খেলাধুলার ব্যবস্থা দেখলাম না। তবে কি ছাত্ররা বা সাধারণ মানুষ ঘরে বসে বা রাস্তার মোড়ে বসে শুধুই চা খায় ও মোবাইলে গেম খেলে? এ ধরনের পরিবর্তন গ্রামেগঞ্জেও হয়ে গেছে দেখে মন খারাপ হয়।

যাতায়াতব্যবস্থার উন্নতি ভালো, তবে ছোটখাটো বাজারের মধ্যে যেসব বাজারের সাকল্যে আয়তন হবে এক বর্গকিলোমিটার, সেই সব বাজারের মধ্যেও সরু রাস্তায় ডজনে ডজনে ব্যাটারিচালিত গাড়ি ঘুরে বেড়ায়। মানুষের সাধারণ হাঁটাচলার ব্যাঘাত ঘটায়, এটা কেমন পরিবর্তন? আমরা বোধ হয় হঠাৎ করেই হাতের কাছে অনেক কিছু পেয়ে গেছি, তার একটি খারাপ উদাহরণ এই কায়িক পরিশ্রম না করা।

সন্ধ্যার পরে আমি একটি ওষুধের দোকানে বসি, দোকানের মালিক আমার বাল্যবন্ধু। সে পল্লিচিকিৎসক। আমি সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ওই দোকানে বসে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করেছি। ওই দোকান থেকে যত মানুষ ওষুধ কিনেছে তাদের মধ্যে বেশির ভাগ শুধু প্রেশারের ট্যাবলেট কিনেছে। সবাইকে এখন প্রেশারের রোগে পেয়ে বসেছে। খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের কারণে গ্যাস্ট্রিকের রোগীও প্রচুর। ওই দোকান থেকে যত ওষুধ বিক্রি হয় তার প্রায় ৯০ ভাগই প্রেশার ও গ্যাস্ট্রিকের। আমরা জীবনযাত্রা সহজ করে এনেছি, হাঁটাচলা বন্ধ করে দিয়েছি, তার সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগসহ বহু রোগ নিজের শরীরের মধ্যে স্থান করে দিয়েছি।

একেবারে খেটে খাওয়া মানুষকেও দেখেছি সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে কাজে যাওয়ার আগে রাস্তার মোড়ের দোকানে এসে দুটো পরোটা, ভাজি, চা খেয়ে কাজে যায়। বিকেলে ফেরার পথে রাস্তার মোড়ের দোকান থেকে চা-নাশতা করে বাড়িতে যায়। অবশ্য এই সব মানুষজন আগে বাড়িতে সবাইকে নিয়ে নাশতা করত, এটা ছিল স্বাস্থ্যসম্মত। এখন এসবের বলাই নেই। সবাই রাস্তাকেন্দ্রিক দোকান থেকে মুখরোচক নাশতা করে। আর নিজের শরীরকে বিক্রি করে দেয় নানান রোগের কাছে।

এখানে অর্থনৈতিক দিক থেকে যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুফল কিছুটা আছে; বেকার সমস্যা দূর হচ্ছে, মানুষ কিছু একটা করে খাচ্ছে। কিন্তু মানুষ যে তার আসল শরীরকে বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, এদিকে কারও খেয়াল নেই।

সারা দেশে যে পরিমাণ ব্যাটারিচালিত যানবাহন চলাচল করে, তার হিসাব মেলা বড়ই কঠিন। এসব ব্যাটারিচালিত যানের জন্য ব্যাটারিতে চার্জ দিতে হয়। আমার তো মনে হয় সারা দেশে এ ধরনের ব্যাটারিচালিত যানের জন্য প্রতিদিন হাজার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হয়।

সবকিছু বিবেচনা করে আমাদের সবারই এই পণ করা উচিত—প্রতিদিন যেন আমরা তিন থেকে চার কিলোমিটার হাঁটাহাঁটি করি। ছোটখাটো জিনিস কিনতে বাজারে যাওয়া, ঘোরাফেরা বা সামান্য পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য এসব অটোরিকশা ব্যবহার না করে নিজের পা দুটোকে ব্যবহার করতে হবে। এতে নিজের শরীর-মন ভালো থাকবে, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্‌রোগ থেকে আমরা মুক্ত থাকব, সাশ্রয় হবে অনেক অর্থ। এই সাশ্রয়ী অর্থ সঞ্চয় করতে হবে ভবিষ্যতের জন্য। মানুষ এটা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবে, ততই জাতির জন্য মঙ্গল হবে।

লেখক : প্রকৌশলী 

খালেদ / পোস্টকার্ড;