ইউটিউব চ্যানেলকে টেলিভিশন চ্যানেল দাবি করে চলছে 'সিপ্লাস', সংবাদ প্রকাশে টাকা লাগে

ইউটিউব চ্যানেলকে টেলিভিশন চ্যানেল দাবি করে চলছে 'সিপ্লাস', সংবাদ প্রকাশে টাকা লাগে
ইউটিউব চ্যানেলকে টেলিভিশন চ্যানেল দাবি করে চলছে 'সিপ্লাস', সংবাদ প্রকাশে টাকা লাগে

পোস্টকার্ড ডেস্ক ।। 

দেড় দশক আগেও আলমগীর অপু নিজেকে জাহির করতেন ছাত্রনেতা হিসেবে। চট্টগ্রাম নগরীর সিটি কলেজকেন্দ্রিক ছাত্রলীগের কিছু অনুষ্ঠানে তাকে অবশ্য দেখা যেত। তবে পদপদবি ছিল কি না, তা নিয়ে রয়েছে বিস্তর প্রশ্ন। ছাত্রনেতার খোলস ভেঙে এরপর তিনি নাম লেখান সাংবাদিকতায়। খোলেন ‘সিপ্লাস টিভি’ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল, যার প্রধান সম্পাদক হিসেবে নিজের নাম প্রচার করেন। অভিযোগ উঠেছে, এই চ্যানেলে সংবাদ প্রকাশের নামে আর্থিক অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছেন অপু। এমনকি নগরের ওয়াসার মোড়ে যেখানে তিনি বসেন, সেটিও দখল করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অপুর হলুদ সাংবাদিকতায় বিব্রতকর ও ক্ষুব্ধ চট্টগ্রামের মূলধারার সাংবাদিকরা।

জানা গেছে, ইউটিউব চ্যানেলকে টেলিভিশন চ্যানেল দাবি করে চলছে ‘নিউজ ব্যবসা’। পারিবারিক কলহ, সামাজিক, রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক থেকে শুরু করে ব্যক্তির সাধারণ দ্বন্দ্বও ঘটা করে আপলোড করা হয় সেখানে। পক্ষপাতদুষ্ট প্রতিটি কনটেন্টের জন্য সুবিধাভোগী বা স্বার্থান্বেষী মহলের কাছ থেকে নেওয়া হয় টাকা। আবার চাহিদামতো টাকা না পেলে উল্টো নেতিবাচক তথ্যও আপলোড করা হয়।

দেশের বিভিন্ন উপজেলা থেকে গ্রাম পর্যায়ে তথাকথিত সাংবাদিক নিয়োগ দিয়েছেন অপু। তাদের মাধ্যমেই চলছে টাকার লেনদেন। সেই টাকায় হয়েছেন গাড়ি-বাড়ি, ফ্ল্যাটসহ নানা সম্পদের মালিক। তার দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ নগর থেকে শুরু করে উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষ।

সম্প্রতি অনলাইনভিত্তিক নিউজ পোর্টালগুলোর নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু হলে চট্টগ্রাম থেকে বেশ কয়েকটি পোর্টাল নিবন্ধন চায়। এর মধ্যে সিপ্লাস টিভিও ছিল; কিন্তু জমি দখল, মাদক বাণিজ্য, ক্যাসিনো কাণ্ডে সম্পৃক্ততাসহ নানা কারণে সেটি নিবন্ধন পায়নি বলে জানিয়েছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। সংস্থাটির কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, আলমগীর অপুর বিরুদ্ধে কর্মীদের বেতন না দেওয়া, অফিসে জুয়ার আসর বসানো, ফ্ল্যাট দখল করে অফিস বানানোসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে শুরু থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে নানা বিতর্কিত মন্তব্য করে আলোচনায় থাকার চেষ্টা চালাতেন এই অপু। সম্প্রতি ফেসবুকে সরকারবিরোধী স্ট্যাটাস দিয়ে আবারও সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। একপর্যায়ে নিজের ওয়াল থেকে পোস্টটি সরিয়েও নিয়েছেন। তবে সেই পোস্টের স্ক্রিনশট শেয়ার দিচ্ছেন অনেকে। ওই স্ট্যাটাসে অপু লেখেন, ‘গাজীপুরে বয়স্ক জায়েদা খাতুনের এত ভোট পাওয়া কি জনপ্রিয়তা নাকি কুশাসনের ফসল?...’

স্ট্যাটাসটি নিয়ে সমালোচনা শুরুর পর আলমগীর অপুকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন অনেকে। তাদের দাবি, এ ধরনের মন্তব্য দেশদ্রোহের শামিল।

গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্র বলছে, আলমগীর অপুর করা সরকারবিরোধী পোস্টগুলোর উদ্দেশ্য উদ্ঘাটনে চলছে বিশেষ নজরদারি। সরকারবিরোধীদের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ মদদে এসব পোস্ট শেয়ার হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

সাত বছর আগে শুরু হওয়া ‘সিপ্লাস’ নামে ইউটিউব চ্যানেলটি এখন আস্ত টাকার গাছে রূপ নিয়েছে। টাকার বিনিময়ে মুদি দোকানের ফিতা কাটা থেকে শুরু করে যে কোনো অনুষ্ঠানের খবর প্রচার করা হয় এতে। জেলা ও উপজেলা পর্যায় থেকে এভাবে টাকা দিয়ে ৯ খাতে নিউজ করানো হয় কথিত এ চ্যানেলে। সঙ্গে চাঁদাবাজির অভিযোগ তো আছেই।

প্রতিবেদকের হাতে আসা সিপ্লাসের একটি ‘কনফিডেনশিয়াল চিঠিতে’ দেখা গেছে, যে কোনো ধরনের খেলাধুলার নিউজ, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের সংবাদ প্রচারে (উপজেলার না হলে) দিতে হয় ৫০০ টাকা করে। সব ধরনের ধর্মীয় সংবাদ, রাজনৈতিক পরিচিতি আছে কিংবা সরকারি পদ আছে—এমন কারও ব্যক্তিগত কর্মসূচির নিউজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের পুনর্মিলনী-বর্ষপূর্তির সংবাদের ক্ষেত্রে দিতে হয় ১ হাজার টাকা করে। তা ছাড়া রাজনৈতিক পরিচিতি নেই—এমন কারও ব্যক্তিগত কর্মসূচি, মেলার সংবাদের ক্ষেত্রে ২ হাজার টাকা এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংবাদ প্রচারে ৪ হাজার টাকা করে দিতে হয়। এ ছাড়া সংবাদের নামে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে হয়রানির অভিযোগও রয়েছে কথিত এ চ্যানেলের বিরুদ্ধে।

জানা গেছে, নিজেকে ছাত্রলীগ নেতা পরিচয় দেন অপু। তার ভাই মুজিবুল হক মঞ্জু দুবাই বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব পদে রয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে। এ ছাড়া অপুর বোন জিন্নাত রাজ্জাক চট্টগ্রাম নগর বিএনপির নেত্রী। দুদিন আগে তিনি স্থানীয় বিএনপির এক সমাবেশে যোগ দিয়ে ফেসবুক লাইভে এসে সরকারবিরোধী নানা বক্তব্য দেন। তার সাম্প্রতিক লন্ডন সফর নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। এ প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের স্থানীয় এক নেতা ফেসবুকে লেখেন, ‘আলমগীর অপু সাহেব, দালালির জন্য তারেক রহমান আপনাকে কত টাকা দিয়েছে?’

সিপ্লাস টিভির সাবেক এক প্রতিনিধি বলেন, সংবাদ প্রকাশের জন্য আলমগীর অপুকে টাকা দিতে হতো। টাকা না দিলে সেই সংবাদ প্রচার হয় না। একটি অনুষ্ঠানে গেলে, সেই সংবাদ প্রচার না হলে সেটি বিব্রতকর। তাই নিজের পকেট থেকেও তাকে টাকা দিয়েছি।

তবে এসব অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছেন আলমগীর অপু। অনলাইন নিউজ পোর্টাল বা আইপি টিভি হিসেবে নিবন্ধন না থাকা এবং অর্থের বিনিময়ে সংবাদ প্রকাশের বিষয়টি স্বীকার করে তিনি একে ‘বিজ্ঞাপন প্রচার’ বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, আমরা আইপি টিভি হিসেবে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিলাম; কিন্তু পাইনি। আর আমাদের প্রতিষ্ঠানে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা কাজ করেন। তা হলে আমরা কেন সংবাদ বিনামূল্যে প্রকাশ করব? পত্রিকায় যেমন বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়, তেমনি এটি আমাদের ‘পেইড কনটেন্ট’। আইপি টিভি বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ করা যাবে না মর্মে তথ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা আছে উল্লেখ করলে অপু বলেন, আপনারা এটিকে সংবাদ বললে সংবাদ, কনটেন্ট মনে করলে কনটেন্ট। চট্টগ্রামে সিপ্লাস টিভির নাম শুনলে অনেকেই টাকা দিয়ে দেয়। প্রতিনিধিরা আমাদের না জানিয়ে এর থেকে অনেক বেশি টাকা নেয়। তাই টাকার পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। সূত্র. কালবেলা

খালেদ / পোস্টকার্ড ;