আজ বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণের ১ বছর, ‘হতভাগাদের’ মৃত্যুর দায় কার

আজ বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণের ১ বছর, ‘হতভাগাদের’ মৃত্যুর দায় কার
আজ বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণের ১ বছর, ‘হতভাগাদের’ মৃত্যুর দায় কার

আলমগীর হোসেন ও মেজবাহ উদ্দিন খালেদ ।। 

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে বিভীষিকাময় বিস্ফোরণে ৫১ জনের মৃত্যু এবং প্রায় ৪ শতাধিক দগ্ধ-আহতের ঘটনায় বিচার পেলেন না ভুক্তভোগী পরিবার বা স্বজনরা। বিস্ফোরণের ঘটনায় পুলিশ বাদী মামলায় এরই মধ্যে নামীয় আসামি বা কর্তৃপক্ষকে দায়মুক্তি দিয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন (ফাইনাল রিপোর্ট) দেওয়া হয়েছে। আহত অনেকে এখনও যথাযথ ক্ষতিপূরণ পাননি বলেও অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু ঠিকই ঘুরে দাঁড়িয়েছে সেই বিএম কন্টেইনার ডিপো। পুরোনো ধারায় সচল হয়েছে ডিপোর ব্যবস্থাপনা। শুধু আড়ালে পড়ে গেছে হতাহত পরিবারগুলোর দীর্ঘশ্বাস-চাপাকান্না।

আজ ৪ জুন সীতাকুণ্ডের সেই বিএম ডিপোর বিভীষিকাময় বিস্ফোরণের এক বছর পূর্তি হচ্ছে। যে বিস্ফোরণে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল বিএম কন্টেইনার ডিপো। যেখানে ফায়ার সার্ভিসের ৯ কর্মীসহ ৫১ জনের করুণ মৃত্যু এবং চার শতাধিক দগ্ধ-আহতের ঘটনা ঘটে। ঘটনার প্রায় এক বছর হতে চললেও এখনও স্বজন হারা পরিবারগুলোর কান্না থামেনি। কর্মক্ষম স্বজনকে হারিয়ে অনেক পরিবার এখন দিশাহারা। নিহতদের পরিবারগুলো কিছু টাকা পেলেও দগ্ধ-আহত অনেকেই সেভাবে ক্ষতিপূরণ পাননি। বরং পঙ্গু বা ক্ষত জীবন নিয়ে ভয়াবহ দুর্দশায় কাটছে তাদের জীবন-সংসার। 

ভয়াবহ এই বিস্ফোরণের নেপথ্যে মালিক-কর্তৃপক্ষের স্পষ্ট দায় বা অবহেলা দেখেন বিশ্লেষকরা। এমনকি হতাহতদের স্বজন ও স্থানীয়রাও শুরু থেকেই কর্তৃপক্ষকে দায়ী করে প্রায় অভিন্ন অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়েই কর্তৃপক্ষকে দায়মুক্তি দিয়ে মামলা করে স্থানীয় পুলিশ। যেখানে পেনাল কোডের ৩০২ ধারায় স্পষ্ট মামলা করার সুযোগ দেখেছিলেন আইনজীবীরা, সেখানে পুলিশ বাদী হয়ে দুর্বল কয়েকটি ধারা (অবহেলাজনিত মৃত্যু) দিয়ে মামলা করে। সেখানেও যাদেরকে (আটজন) আসামি করা হয়েছিল তারা বিএম ডিপোর মধ্যম বা নিম্নপর্যায়ের কর্মকর্তা মাত্র। যাদের হাতে ডিপোর কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্ব থাকলেও প্রতিষ্ঠানের ‘সেফটি-সিকিউরিটি’ বাস্তবায়নের ক্ষমতা ছিল না বলে জানা যায়। অতঃপর গত ৫ মে সীতাকু-ের বিএম কন্টেইনার ডিপোর আট কর্মকর্তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা-ের মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন (ফাইনাল রিপোর্ট) দাখিল করে চট্টগ্রাম জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম জেলা ডিবি পুলিশ বলেছে, ‘অভিযুক্তরা ঘটনার জন্য দায়ী নয় বা বিস্ফোরণটি কোনো নাশকতা নয়। এটি একটি দুর্ঘটনা ছিল।’

সীতাকুণ্ড মডেল থানার ওসি তোফায়েল আহমেদ শুক্রবার মোবাইল ফোনে বলেন, ‘ডিবি পুলিশ বিএম ডিপোর বিস্ফোরণ-অগ্নিকান্ডের মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট জমা দিয়েছে বলে জানি। সেটি সম্ভবত আদালতে এখনও শুনানি হয়নি।’ বিএম ডিপোর কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে ওসি তোফায়েল আহমেদ বলেন, বর্তমানে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে সার্বিক কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলছে।

এদিকে ঘটনার প্রায় এক বছর হতে চললেও নিহত ও আহতদের পরিবারগুলোর কান্না-আহাজারি এখনও থামেনি। শুক্রবার বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণে নিহত আবদুল মুনিরের বাবা আবদুল হান্নান ওরফে শাহজাহানের সঙ্গে কথা হয়। এ সময় কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন শাহজাহান। তিনি বলেন, ‘সন্তানকে হারিয়েছি। বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলাম। কিন্তু টাকা কেন, কোনো কিছুর বিনিময়ে তো আর তাকে ফিরে পাব না। ছেলেরে হারিয়ে আমরা মানসিকভাবে শেষ হয়ে গেছি।’ কর্তৃপক্ষের দায় বা অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে শাহজাহান বলেন, ‘কাকে দায়ী করব? পুলিশ তো ফাইনাল রিপোর্ট দিল।’

বিএম ডিপো ফের সচল: ডিপো সংস্কার করার পর গত ২২ আগস্ট শুধু খালি কন্টেইনার সংরক্ষণের অনুমোদন দেয় কাস্টমস বিভাগ। গত ২৫ অক্টোবর ৯ শর্তে পোশাকপণ্য রফতানি কার্যক্রম ব্যবস্থাপনার অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে শর্ত মানায় গত ৭ নভেম্বর আমদানি-রফতানি কার্যক্রম পুরোদমে শুরুর অনুমোদন দেওয়া হয়। বর্তমানে সার্বিকভাবে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বিএম কন্টেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষ।

ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় যেভাবে: পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত ৬৯ জনের মধ্যে ক্ষতিপূরণের টাকা বিতরণ করা হয়েছে। যাদের মধ্যে ২৬ জন নিহত রয়েছেন। এ তালিকায় ১৩ জন ফায়ার সার্ভিস কর্মী, ৯ জন কর্মচারী এবং অন্যান্য ৪ জন। ফায়ার সার্ভিসের নিহতদের ১৫ লাখ, বিএম ডিপোতে কর্মরত ও সাধারণ নিহতদের ১০ লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় যাদের অঙ্গহানি হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী হলে ১০ লাখ, বিএম ডিপো ও সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে ৬ লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। আরও কিছু ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত বিষয় প্রক্রিয়াধীন আছে বলে জানা গেছে।

শনাক্ত হয়নি ৮ মরদেহ : ৫১ লাশের মধ্যে অন্তত ৮ জনের মরদেহ শেষ পর্যন্ত নাম-পরিচয় শনাক্ত হয়নি। এমনকি এসব মরদেহের কোনো স্বজন দাবিদারও পাওয়া যায়নি। দীর্ঘ প্রায় ১০ মাস চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ মর্গে লাশগুলো পড়ে থাকার পর গত ২০ এপ্রিল আদালতের নির্দেশে নগরীর বাইশ মহল্লা কবরস্থানে ৮ মরদেহ দাফন করা হয়েছে। 

এজাহারে যা বলা হয়েছিল: গত ৭ জুন সীতাকুণ্ড থানা পুলিশ বাদী হয়ে বিএম ডিপোর ৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করে। পুলিশ এজাহারে বলেছে, ‘বিএম ডিপোতে যথাযথ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বিপজ্জনক কেমিক্যালভর্তি কন্টেইনার রাখে। অগ্নিকাণ্ডের পর উদ্ধারকাজে নিয়োজিত ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের কন্টেইনারের ভেতর কেমিক্যালভর্তি ড্রাম থাকার বিষয়টি অবহিত করা হয়নি। আসামিদের ইচ্ছাকৃত অবহেলার কারণে বিএম ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।’ 

এ মামলায় মালিকপক্ষ না থাকলেও আসামি করা হয়-বিএম ডিপোর ডিজিএম (অপারেশন) নুরুল আক্তার, ম্যানেজার (অ্যাডমিন) খালেদুর রহমান, সহকারী অ্যাডমিন অফিসার আব্বাস উল্লাহ, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ (অ্যাডমিন অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স) মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, সহকারী ব্যবস্থাপক (ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো-আইসিডি) আবদুল আজিজ, সিএফএস ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম, কন্টেইনার ফ্রেইট স্টেশনের (সিএফএস) কর্মী নজরুল ইসলাম এবং জিএম (সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং) নাজমুল আক্তার খানকে। - দৈনিক সময়ের আলো । 

খালেদ / পোস্টকার্ড ;