হামে ১০ শিশুর মৃত্যু পাহাড়ের তিন জেলায় , আক্রান্ত আরো ২শতাধিক

হামে ১০ শিশুর মৃত্যু পাহাড়ের তিন জেলায় , আক্রান্ত আরো ২শতাধিক

ইশরাত আলম আরজু।।

সারাবিশ্ব করোনায় আক্রান্ত । অন্যদিকে পাহাড়ের তিন জেলায় করোনায় ছোবলের মধ্যে হাম নতুন আতংক হিসেবে দেখা দিয়েছে। তিন জেলায় এ পর্যন্ত ১০টি শিশু মারা গেছে। এর মধ্যে শুধু সাজেকেই মৃত্যু হয়েছে আট শিশুর। অপর দুই পাহাড়ি জেলায় মারা গেছে আরো ২ জন। এ পর্যন্ত আরে ২ শতাধিক শিশু আক্রান্ত হয়েছে।
বান্দরবান সদরের চিম্বুক, টংকাবর্তী এবং থানচি, লামা উপজেলায় হাম রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। ঐসব এলাকাসহ বিভিন্ন দুর্গম পাহাড়ি পল্লীগুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে হাম রোগ। শিশু থেকে শুরু করে যুবক-যুবতী, বয়ো:বৃদ্ধ পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছে না। দুর্গমতার জন্য যোগাযোগ সমস্যার কারণে দ্রুত চিকিৎসাসেবার অভাবে এরোগ ছড়াচ্ছে বেশি। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ ৩ এপ্রিল থানচি উপজেলার দুর্গম দুই পল্লীতে হাম রোগে তিন শিশু আক্রান্ত হয়েছে।
সদর ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের দুর্গম উষামাং হেডম্যান পল্লীর বাসিন্দা থোয়াই সিং মং মারমা জানান, তার ৩য় শ্রেণিতে পড়ুয়া ৯ বছরের শিশু কন্যা উ ম্যা সাইন মারমা ও দেড় বছরের শিশু ছেলে নু সাই ম মারমা হাম রোগে আক্রান্ত হয়েছে। একই কথা জানালেন ৩নং ওয়ার্ডের দুর্গম তংক্ষ্যংপাড়ার বাসিন্দা ছোমং মারমা। তিনি বলেন, তার দুই বছরের শিশু ছেলে উ মং প্রু মারমাও হাম রোগে আক্রান্ত হয়েছে।
দুর্গম তংক্ষ্যংপাগার বাসিন্দা ছোমং মারমা জানান, তার দুই বছরের শিশু ও ৯ বছরের শিশু কন্যার শরীরের ৩১ মার্চ গুটি গুটি ফোঁটা দেখা যায়। এরপর থেকে তাদের জ্বর ও সর্দি হয়।
এদিকে রাঙ্গামাটির সাজেকের দুর্গম অরুণপাড়ার শিশুরা হামের আক্রান্ত হয়ে পড়ে। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি অরুণপাড়ায় সাগরিকা ত্রিপুরা (১৩) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়। পরে সাজেকের অরুণপাড়াসহ লংতিয়ান পাড়া, কমলাপুর পাড়া, হাইচ্চাপাড়া ও তারুমপাড়ায় পাড়ায় আরও ১৩৬ জন শিশু একই রোগে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে এ পর্যন্ত অরুণপাড়ায় পাঁচ শিশু ও লংতিয়ান পাড়ায় দুই শিশুর মৃত্যু হয় এ রোগে। সবশেষ গত ৩০ মার্চ দিবাগত রাতে সাজেকের ব্যাটালিং মৌজার উদোলছড়ি গ্রামে সুরেশ কুমার ছেলে নিকেতন চাকমা (১৫) নামে আরও এক শিশু মারা যায়। এর আগে পার্বত্য খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় এক ত্রিপুরা শিশু ও বান্দরবানের লামায় এক ম্রো শিশুও মারা গেছে হামের মতো এই রোগে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বর্তমানে সাজেকের কয়েকটি মৌজার ১০-১২টি গ্রামের শিশুরা হাম রোগে আক্রান্ত আছে। এ পর্যন্ত মারা গেছে আট শিশু। হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়েছে আরও আট শিশুকে।
স্থানীয় কার্বারিরা (গ্রামপ্রধান) জানান, দুর্গম সাজেকের একেকটি এলাকা থেকে একেকটি এলাকায় পৌঁছাতে দুই-তিন পর্যন্ত সময়ও লাগে। পাড়ি দিয়ে হয় গহীন অরণ্যও। এতে অল্প সময়ের মধ্যে মেডিকেল টিম সব এলাকায় পৌঁছাতে পারে না। তাছাড়া অধিকাংশ মানুষ শিশুদের লতাপাতা ও বৈদ্যালি চিকিৎসা দেন।
সাজেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নেলশন চাকমা বলেন, ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে এ পর্যন্ত ৮ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সবশেষ উদলছড়ি গ্রামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এখনো সাজেকের উদোলছড়ি, নিউঢাংনাং, কমলাপুর, শিবপাড়া, সাতনাম্বার পাড়া, বড়ইতলী, ডেবাছড়ি, কজইছড়ি, ভূয়াছড়ি, লাম্বাবাক ও উজানছড়িতে বিচ্ছিন্নভাবে আড়াই শতাধিক শিশু হামসদৃশ রোগে আক্রান্ত আছে। এসব গ্রামে শিশুদের পুষ্টিকর খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।
ইউপি চেয়ারম্যান নেলশন আরো জানান, গত বুধবার সাজেকের সাতনাম্বার পাড়া থেকে একই পরিবারের দুই শিশুর অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাদের খাগড়াছড়ি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। এর আগে লংতিয়ান পাড়ার একই পরিবারের ভাই ও অরুণপাড়ার এক শিশুকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। যতটুকু জেনেছি, তারা সবাই সুস্থ আছে। বর্তমানে সেনাবাহিনী ও বিজিবির মেডিকেল টিম ছাড়াও স্বাস্থ্য বিভাগের দুইটি মেডিকেল টিমের একটি উদোলছড়ি ও আরেকটি মাচালং এলাকা থেকে ভূয়াছড়িসহ আশপাশের এলাকায় চিকিৎসা দিচ্ছে।
তিনি বলেন, দুর্গম গ্রামের মানুষ হওয়ায় এসব এলাকার মানুষজন বেশিরভাই কুসংস্কারে বিশ্বাসী। অনেকেই স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশনা অমান্য করে গ্রামে বৈদ্যের চিকিৎসা দিচ্ছেন। এর কারণেই শিশুরা সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ইফতেখার আহমেদ জানিয়েছেন, ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে আনুমানিক ১৬০ জন শিশু এই রোগে আক্রান্ত। তিনি বলেন, আমরা ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম যে শিশুদের নমুনা সংগ্রহ করে পাঠিয়েছি, ল্যাবরেটরি রিপোর্টে তাদের হাম রোগ শনাক্ত হয়েছে। এটি সংক্রামক রোগ হওয়ায় একে আমরা হাম বলেই ধারণা করছি। তবে ১৬০ শিশু ছাড়াও অনেকেই শিশু নিউমোনিয়া ও সর্দি-কাশি ও জ্বরে আক্রান্ত রয়েছে। তাদের লক্ষণগুলোকে হাম বলা যাচ্ছে না। বর্তমানে সাজেকে আমাদের দুইটি মেডিকেল টিম কাজ করছে।
রাঙ্গামাটি জেলা সিভিল সার্জন ডা. বিপাশ খীসা জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত এই রোগে আক্রান্ত সাজেকের বিভিন্ন গ্রামের ১৭০ শিশুকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২ এপ্রিল) সাজেকের শিয়ালদহ এলাকায় উদ্দেশ্যে আমাদের আরেকটি মেডিকেল টিম রওয়ানা দিয়েছে। তারা শুক্রবার সেখানে পৌঁছে কাজ শুরু করবে।
এদিকে, গত ২৮ মার্চ খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়নের ত্রিপুরা অধ্যুষিত প্রত্যন্ত গ্রাম রথিচন্দ্র কার্বারি পাড়ায় হামসদৃশ রোগে আক্রান্ত হয়ে ধ্বনিকা ত্রিপুরা নামের ৯ বছরের এক শিশু মারা যায়। এ ঘটনার পর রথিচন্দ্র ত্রিপুরা পাড়ার আরও ২০ শিশুকে দীঘিনালা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। তারা বর্তমানে সুস্থ আছে। এছাড়া গত ১৩ মার্চ বান্দরবানের লামা উপজেলার সদর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের পুরাতন লাইল্যা মুরুং পাড়ায় হাম আক্রান্ত হয়ে দুতিয়া মুরুং (৭) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়। এ ঘটনার ওই পাড়ার আক্রান্ত আরও ৩৫ শিশুকে ইউপি চেয়ারম্যানের সহায়তায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করানো হয়। তারা সবাইও সুস্থ আছে।
এদিকে বান্দরবান স্বাস্থ্য বিভাগ জানায় প্রতি বছরের মত চলতি বছরেও সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ গত ১৮ মার্চ থেকে আগামী ১২ এপ্রিল পর্যন্ত ৯ মাস থেকে ১০ বছর বয়সী সকল শিশুকে হাম-রুবেলার টিকা দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করলেও বিশ্বব্যাপী মরণব্যাধি করোনা ভাইরাস আক্রমণের কারণে আপাতত হাম-রুবেলা ক্যাম্পেইন স্থগিত ঘোষনা করে।
এর কয়েকদিন পরেই লামা উপজেলার দুর্গম পাহাড়ী এলাকা গুলোতে হাম রোগের ৩৫জন পাড়াবাসী এ রোগে আক্রান্ত হয় এবং এক শিশু মারা যায়।
পরে সিভিল সার্জন অং সুই প্রু মারাম নির্দেশে উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ ক্যাম্পেইন স্থগিত থাকা সত্বেও ২৬টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি ও বাঙ্গালী পাড়ার ৭০৩জন শিশুকে হাম-রুবেলার টিকা প্রদান করেন ।
এব্যাপারে বান্দরবান সিভিল সার্জন অং সুই প্রু মারমা এপ্রতিবেদককে জানান, হাম আক্রান্ত তিন শিশুকে থানছি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, শুধু থানছিতে নয়, সদর উপজেলা টংগাবর্তী ইউনিয়নেও হাম রোগ দেখা দিয়েছে। সেখানেও খোঁজখবর নিতে স্বাস্থ্য কর্মীদের প্রেরণ করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবিলার কারণে হাম-রুবেলা ক্যাম্পেইন স্থগিত করা হলেও চলতি মাসে আবরো শুরু করা হবে বলে জানিয়েছেন।