সন্ধ্যা হলেই দক্ষিণ চট্টগ্রামে গণপরিবহনে কৃত্রিম সংকট !

প্রতিদিন দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়া নেয়ার অভিযোগ

সন্ধ্যা হলেই দক্ষিণ চট্টগ্রামে গণপরিবহনে কৃত্রিম সংকট !

ইকবাল হোসেন।।

যাত্রীদের চাপ একটু বেশি হলেই গণপরিবহনে ভাড়াও বেড়ে যায় কয়েকগুণ। এক্ষেত্রে বাসের চালক-হেলপারের মর্জিতেই যাত্রীদের গন্তব্যে যেতে হয়। বিশেষ করে, চট্টগ্রাম- পটিয়া, চট্টগ্রাম- বাঁশখালী, চট্টগ্রাম- কেরানিহাট, চট্টগ্রাম- আমিরাবাদ রুটে প্রতিদিন সন্ধ্যে হলেই কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পরিবহন চালকরা। এতে পরিবহন সংকটে জনদুর্ভোগ চরমে পৌঁছে।

কথায় কথায় বাড়তি ভাড়া, রিজার্ভ নৈরাজ্যের কারণে ভোগান্তিতে রয়েছে দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রতিদিনকার লাখো যাত্রী। একদিকে লক্কর-ঝক্কর, অন্যদিকে বিআরটিএ’র প্রয়োজনীয় কাপজপত্র ছাড়াই চলা বেশিরভাগ যানবাহনে সন্ধ্যা হলেই তিনগুণ-চারগুণ ভাড়া দিয়ে গন্তব্যে যেতে হয় দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাত উপজেলাসহ কক্সবাজার জেলার যাত্রীদের।

সরেজমিনে বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটায় নতুন ব্রিজ এলাকায় গেলে দেখা যায়, অসংখ্য নারী-পুরুষ অপেক্ষা করছে গাড়ির জন্য। নতুন ব্রিজে থাকা গুটিকয়েক বাস গন্তব্যে যাওয়ার ডাক দিলেই মানুষ হুমড়ি খেয়ে গাড়িতে উঠছে। অনেকে বাধ্য হয়ে বাসের ছাদেও চড়ে বসছেন। বিশেষত বৃহস্পতিবার সপ্তাহের শেষ দিনে অফিস ফেরত লোকজনের ভিড় থাকে নতুন ব্রিজে।

নতুন ব্রিজে ‘চট্টমেট্রো-ব-১১-০১১৮’ নম্বরের ‘কাশেম চেয়ারম্যান’ নামের বাসের হেলপার হাঁক দিচ্ছেন, “পটিয়া লোকাল, উঠানামা পঁচিশ”। তবে পটিয়া থেকে নতুন ব্রিজ পর্যন্ত ভাড়া নির্ধারণ করা ছিল ১৮ টাকা। তিন বছর আগে বাড়িয়ে এ ভাড়া ২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকে বাসগুলো যাত্রীদের কাছ থেকে ৪০-৫০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া আদায় করে বলে অভিযোগ করেন অনেকে। আবার কোন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যাত্রীর চাপ বেড়ে গেলে ভাড়াও বেড়ে যায় কয়েকগুণ।

এদিকে পটিয়া রুটে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্ত হয়েছে চার চাকার হিউম্যান হলার। রুট পারমিট বিহীন এসব হিউম্যান হলারকে টাকার বিনিময়ে মিনিবাস সাজিয়ে সমিতিভুক্ত করে চট্টগ্রাম কক্সবাজার আন্ত:জেলা কোস্টার-চেয়ারকোচ (বিলাসী) মালিক সমিতি। দিনে নিয়মিত ৩০ টাকা করে ভাড়া আদায় করলেও সন্ধ্যার পর থেকে রাত পর্যন্ত এসব হিউম্যান হলার যাত্রীদের কাছ থেকে ৪০-৬০ টাকা ভাড়া আদায় করে। আহসান হাবিব নামের এক যাত্রী বলেন, ‘শাহ আমানত সেতু পারাপারে হিউম্যান হলারকে ১০০ টাকা টোল দিতে হয়। কিন্তু বাসে মিনিবাস লিখে সমিতিভুক্ত হওয়ায় ৫০ টাকা টোল দিয়ে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দেয়। কিন্তু যাত্রীদের কাছ থেকে দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়া আদায় করে। পটিয়ার বাসগুলো একপ্রকার অভিভাবকহীন। এসব বাসগুলোকে কারা নিয়ন্ত্রণ করেন সেটাও কেউ জানে না।’

কথা বলে জানা যায়, দক্ষিণ চট্টগ্রামের বেশিরভাগ বাসের ট্যাক্স টোকেন নেই। রোড পারমিটের সাথে মিল নেই গাড়ির আসন সংখ্যারও। বেশিরভাগ গাড়ির বয়স ২৫ থেকে ৩০ বছরের। মেয়াদ উত্তীর্ণ লক্কর ঝক্কর এসব গাড়িতে চড়তেই গুণতে হয় দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়া। যাত্রীরা প্রতিবাদ করলেই বাসের চালক হেলপাররা সরকারি ভাড়ার অযুহাত দিয়ে বসেন। কিন্তু সরকার ঘোষিত ভাড়া অনুযায়ী মিনিবাসের ক্ষেত্রে ৩১ জন যাত্রীর জন্য নির্ধারিত।

আবার দক্ষিণ চট্টগ্রামে চলাচলকারী বাসগুলোর মধ্যে দুই তিনটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারকোচ বাদে বেশিরভাগ বাসের ফিটনেস নেই। ৭০ শতাংশ মিনিবাসের আয়ুষ্কাল ফুরিয়েছে অনেক আগেই। আবার পুলিশকে ম্যানেজ করে রুট পারমিটবিহীন গাড়িও চলাচল করছে। এতে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয় সরকার সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কক্সবাজার, বান্দরবানসহ দক্ষিণ চট্টগ্রাম বিভিন্ন রুটে লোকাল সার্ভিস রয়েছে, কিন্তু রিজার্ভ কোন সার্ভিস নেই। যাত্রী বেড়ে গেলে লোকাল এসব বাস রিজার্ভ সার্ভিসে রূপ নেয়। এক্ষেত্রে ভাল মানের চেয়ারকোচ সার্ভিসের চেয়েও বেশি ভাড়া আদায় করে এসব লোকাল বাস।

কক্সবাজারগামী কাজী সোহেল নামের এক যাত্রী বলেন, ‘চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে চলাচলকারী মারসা, এস আলম, সৌদিয়া পরিবহনের সার্ভিসগুলোর বাইরে হানিফ, শ্যামলী, ইউনিক সার্ভিসের বাসগুলো লক্কর ঝক্কর। ঢাকার হানিফ এন্টারপ্রাইজ, ইউনিক সার্ভিস ও শ্যামলী পরিবহন এর নামের সাথে মিল রেখে কয়েকটি সিন্ডিকেট চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে মারসা, এস-আলমের সমান ভাড়া নিয়েও এসব বাস সার্ভিস যাত্রীদের সাথে প্রতারণা করছে।’

বাঁশখালীর যাত্রী মো. শাহনেওয়াজ বলেন, ‘বাঁশখালী রুটে নতুন ব্রিজ থেকে জলদি পর্যন্ত স্পেশাল সার্ভিসের ভাড়া ৭০ টাকা। কিন্তু সুপার ও স্পেশাল সার্ভিসগুলো সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় সার্ভিস বন্ধ করে দেয়। এরপর থেকে পিএবি (পটিয়া-আনোয়ারা-বাঁশখালী) সড়কের লোকাল বাসগুলো যাত্রীদের কাছ থেকে ১০০-১২০ টাকা ভাড়া আদায় করে।’

টেরিবাজারের দোকান কর্মচারি নাছির উদ্দিন বলেন, ‘আমিরাবাদ পর্যন্ত বাসের লোকাল ভাড়া ৬০ টাকা হলেও সন্ধ্যা পরেই ৮০-১০০ টাকা হয়ে যায়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এ ভাড়া হয়ে যায় ১২০-১৫০ টাকা। অল্প বেতনের চাকরি করে বাধ্য হয়েই বেশি ভাড়া দিয়ে বাড়িতে যাওয়া আসা করতে হয়।’ এ যাত্রী বলেন, বৃহস্পতিবার শহর থেকে বাড়িতে যেতে এবং রোববার সকালে শহরে আসতে এভাবে জোরপূর্বক বেশি ভাড়া আদায় করা হয়।’

চট্টগ্রাম কক্সবাজার আন্ত.জেলা কোস্টার-চেয়ারকোচ (বিলাসী) মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘রাত ৯টার পর আমাদের লাইনম্যানরা থাকেন না। লাইনম্যানরা থাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া নিতে পারেন না। তবে ৯টার পর লাইনম্যান চলে গেলে কিছু অসাধু বাস ড্রাইভার বেশি ভাড়া আদায় করে। তবে আমাদের বাসগুলোর বিরুদ্ধে এ ধরণের অভিযোগ পাওয়া গেলে আমরা তাৎক্ষণিক এসব বাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। আমরা আগামী কয়েকদিনের মধ্যে বাস মালিক-শ্রমিকদের নিয়ে সভা করে বাড়তি ভাড়া না নেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’

নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক-উত্তর) আমির হোসেন বলেন, ‘অস্বাভাবিক ভাড়া আদায় কখনো কাম্য নয়। দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন রুটে বর্ধিত ভাড়া নিয়ে অনেক সময় অভিযোগ আসে। তারপরও বর্তমানে বিষয়টি আরাকান সড়ক বাস মালিক সমিতির নেতাদের ডেকে বাড়তি ভাড়া আদায়ের বিষয়ে পদক্ষেপ নেব।’

এবিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন রুটে যাত্রীদের কাছ থেকে বর্ধিত ভাড়া নেয়া রোধে আমাদের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা তৎপর থাকেন। যাত্রীরা অভিযোগ করলে অনেক সময় রাত পর্যন্ত ইউএনও’রা রাস্তায় নামছেন।’

তিনি বলেন, ‘যাত্রীদের ভোগান্তি কমাতে আমরা ইতোমধ্যে প্রায় ৫০টি অধিক বাসের নতুন করে রুট পারমিট দিয়েছি। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে পটিয়া, আনোয়ারা, বাঁশখালীসহ বিভিন্ন রুটে এসব বাস সার্ভিস দেবে। এতে দীর্ঘদিনের দক্ষিণ চট্টগ্রামের যাত্রীদের দীর্ঘদিনের ভোগান্তি দূর হবে বলে আশা করছি। তারপরও এসব বাস না নামা পর্যন্ত আমরা বাড়তি ভাড়া নেয়ার বিষয়টি মনিটরিং করবো।’