সীতাকুন্ড-মীরসরাই-বন্দর বিভিন্ন স্পটে আমদানিকৃত স্ক্র্যাপ লুট, জিম্মি ইস্পাত শিল্প-প্রশাসনের হন্তক্ষেপ কামনা

সীতাকুন্ড-মীরসরাই-বন্দর বিভিন্ন স্পটে আমদানিকৃত স্ক্র্যাপ লুট, জিম্মি ইস্পাত শিল্প-প্রশাসনের হন্তক্ষেপ কামনা

ইকবাল হোসেন ।। 

জিপিএইচ ইস্পাত, বিএসআরএম, কেএসআরএমসহ দেশের বড় ইস্পাত কারখানাগুলোর বেশিরভাগের অবস্থান চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়কের সীতাকুণ্ড-মীরসরাই ও নগরীর নাসিরাবাদ এলাকায়। রড তৈরিতে দেশীয় শিপব্রেকিং শিল্পের লোহা বাদেও কাঁচামাল হিসেবে স্ক্র্যাপ আমদানি করে চাহিদা মিটিয়ে থাকে ইস্পাত কারখানাগুলো। আর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সীতাকুণ্ড ও মীরসরাইয়ের কারখানাগুলোর প্রায় ৬০ কিলোমিটার পথে অন্তত ২৫ স্পটে লরি আটকে লুট হয় আমদানিকৃত স্ক্র্যাপ। করোনা প্রাদুর্ভাবের মধ্যেও লুটেরা সিন্ডিকেটের কাছে একপ্রকার জিম্মি হয়ে পড়েছে ইস্পাত শিল্প মালিকরা। এতে করে আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে ইস্পাত কারখানাগুলো। অভিযোগ রয়েছে, লুটেরা গ্যাংদের নিয়ন্ত্রণ করে পর্দার আড়ালের প্রভাবশালীরা। আমদানিকৃত স্ক্র্যাপ লুট রোধে লুটেরা সিন্ডিকেটগুলোকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন শিল্প উদ্যোক্তারা।

চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে স্ক্র্যাপ আমদানি হয়। যেনতেনভাবে পথিমধ্যে স্ক্র্যাপ চুরি করে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি করা যাবে না। কাঁচামাল চুরি হলে প্রকারান্তরে এসবের ব্যয়ভার ভোক্তাদের ওপরই বর্তাবে। তাই এসব মালামাল পরিবহনের ক্ষেত্রে পুলিশ ও পরিবহন ঠিকাদারদের দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। আমদানিকৃত স্ক্র্যাপ লুট রোধে নগরীতে সিএমপি ও হাইওয়েতে হাইওয়ে পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাবের তৎপরতা বাড়াতে হবে। স্ক্র্যাপ লুটে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তিনি।

দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে পাল্লা দিয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে ইস্পাত। সময়ের ব্যবধানে ইস্পাত শিল্পে বৈপ্লবিক অগ্রগতি হয়েছে। গত ১০ বছরে তিন গুণেরও বেশি চাহিদা বেড়েছে ইস্পাতের। আর পুরো শিল্পটির নেতৃত্ব চট্টগ্রামের হাতেই। ইস্পাতের বৃহৎ কারখানাগুলোর বেশিরভাগই চট্টগ্রামে। এর মধ্যে নগরীর নাসিরাবাদ, জেলার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের লাগোয়া সীতাকুণ্ড, জোরারগঞ্জ এলাকায় রয়েছে বিএসআরএম, কেএসআরএম, একেএস, জিপিএইচ, এসএআরএম, আরএসআরএমসহ বড় বড় ইস্পাত শিল্পের কারখানা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের মোট ইস্পাত উৎপাদনের ৮০ শতাংশই উৎপাদিত হয় চট্টগ্রামের কারখানাগুলোতে। রড উৎপাদনের জন্য সাম্প্রতিক সময়ে বছরে প্রায় ৪০ লাখ টন স্ক্র্যাপ আমদানি করে থাকে ইস্পাত কারখানাগুলো। আমদানিকৃত এসব স্ক্র্যাপ বন্দর থেকে খালাস নিয়ে বাকেট লরি দিয়ে নিজেদের কারখানায় নিয়ে যায় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। রড উৎপাদনের এসব কাঁচামাল বন্দর থেকে খালাস নিয়ে কারখানায় যেতে পথিমধ্যে গাড়ি আটকে লুট করে দুর্বৃত্তরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্ষতিগ্রস্ত এক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বলেন, করোনাকালেও রাতে, ভোরে কিংবা দিনেদুপুরে সাধারণ মানুষের সামনে গাড়ি আটকে স্ক্র্যাপ লুট করা খুবই দুঃসাহসিক ব্যাপার। কেউ বাধা দিলে তাদেরকে হামলা চালিয়ে জখম করে দুর্বৃত্তরা। লুটেরা গ্যাংগুলোকে নিশ্চয়ই পর্দার আড়ালের প্রভাবশালীরা ইন্ধন দিয়ে থাকেন। তা না হলে দেশের বৃহৎ ইস্পাত কারখানাগুলোর স্ক্র্যাপ লুট করার মতো সাহস কারো দেখানোর কথা নয়। দেশীয় শিল্পকে বাঁচাতে এসব অপতৎপরতা রোধে প্রশাসনকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ২৪ জুন ভোরে বন্দর থেকে বিএসআরএমের স্ক্র্যাপবোঝাই লরি সীতাকুণ্ডের কারখানায় যাচ্ছিল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে টোল রোডের আব্বাস পাড়া নামক স্থানে ১৫-২০ জনের লুটেরা লরিটি আটকে লরিতে উঠে লুট করে নেয় কয়েক টন স্ক্র্যাপ। স্ক্র্যাপবোঝাই লরির নিরাপত্তায় থাকা আনসার সদস্যরা বাধা দিলে তাদের ওপর হামলা করতে উদ্যত হয় লুটেরার দল। একইভাবে প্রায় প্রতিদিন চলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আমদানিকৃত স্ক্র্যাপ লুট।

একই কায়দায় ২৯ ডিসেম্বর জিপিএইচ ইস্পাতের একটি স্ক্র্যাপবোঝাই বাকেট লরি কুমিরা ফ্যাক্টরিতে যাওয়ার সময় রাত ২টার দিকে কালুশাহ নগর বেড়িবাঁধ সংলগ্ন এলাকায় আটকে লুটেরার দল স্ক্র্যাপ লুট করে। এসময় আকাশ বড়ুয়া নামে একজন নিরাপত্তাকর্মী বাধা দিলে তাকে লোহার রড দিয়ে পায়ে মারাত্মক জখম করে দুর্বৃত্তরা। সর্বশেষ ১৬ জুলাই মাদামবিবির হাটে লুটেরাদের কবলে পড়ে কেএসআরএমের একটি স্ক্র্যাপবাহী লরি। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে লুট হওয়া স্ক্র্যাপ উদ্ধার হয়।

শুধু আব্বাস পাড়া, কালুশাহ নগর বেড়িবাঁধ সংলগ্ন এলাকা কিংবা মাদামবিবির হাট নয়, বন্দর থেকে নাসিরাবাদ ও সীতাকুণ্ড-মীরসরাইয়ে ইস্পাত কারখানাগুলোতে যেতে নগরীর সদরঘাট, মাঝিরঘাট স্কেলের প্রবেশ মুখ, ধনিয়ালাপাড়া বায়তুশ শরফ মাদ্রাসার সামনে, দেওয়ানহাট ফ্লাইওভার থেকে নামার মুখে (তায়েফ হোটেলের সামনে), ঈদগাঁ কাঁচা রাস্তার মোড়, সরাইপাড়া নয়াবাজার হাক্কানী পেট্রল পাম্প, সল্টগোলা ক্রসিং, টোল রোডের টোল প্লাজা সংলগ্ন চোচালা ব্রিজ, চিটাগাং ফিলিং স্টেশনের পর, জেলেপাড়া তেলের দোকান, পাহাড়তলী দক্ষিণ কালীবাড়ি, শুকতারা পয়েন্ট, বাংলাবাজার বেড়িবাঁধ, ডিএবি গ্যারেজের সামনে,সলিমপুর ফকিরহাট পশ্চিম পাড়া, চৌধুরী ঘাটা, কুমিরা রয়েল গেট, এমএমটি গ্যারেজ, বাড়বকুণ্ড আনোয়ারা জুট মিল, সুলতানা মঞ্জিল, সীতাকুণ্ড শেখ পাড়া, বড় দারোগাহাট স্কেল ও মীরসরাই ফিলিং স্টেশনসহ প্রায় ২৫টির অধিক স্পটে লরি আটকে স্ক্র্যাপ লুট চলে হরহামেশা। বিভিন্ন সময়ে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিযোগের প্রেক্ষিতে পুলিশ ব্যবস্থা নিলে কিছু সময় দুর্বৃত্তদের উপদ্রব কিছুটা কমে। সাম্প্রতিক সময়ে লুটেরাদের উপদ্রব বেড়েছে।

জিপিএইচ ইস্পাতের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমাস শিমুল বলেন, টোল রোডসহ নগরীর কয়েকটি এলাকায় আমদানিকৃত স্ক্র্যাপবাহী লরি থেকে মালামাল চুরি করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এর আগেও আমরা সিএমপি কমিশনার মহোদয়কে চিঠি দিয়েছিলাম। তিনি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাও নিয়েছিলেন। এরপর রাতের বেলায় র‌্যাবের টহল জোরদার হওয়ার পরে একটু সহনীয় পর্যায়ে চলে আসছিল। ইদানীং প্রতি রাতেই স্ক্র্যাপ লুটের ঘটনা ঘটছে। ১২-১৫ জনের সন্ত্রাসী দল গাড়ি আটকিয়ে ৮-১০ জন গাড়িতে উঠে স্ক্র্যাপ লুট করে। অনেক সময় খালি ট্রাক সামনে দিয়ে স্ক্র্যাপবাহী লরি আটকিয়ে স্ক্র্যাপ নামিয়ে নেয়। এরপর তারা অন্য ট্রাকে করে স্ক্র্যাপগুলো নিয়ে যায়।

তিনি বলেন, এখন মহামারিতে দিনেদুপুরে মানুষের সামনে উঠেও স্ক্র্যাপ লোহা নামিয়ে নেয়। তাদের বাধা দেওয়া যায় না। নিরাপত্তাকর্মী কিংবা লরি চালকদের ওপর হামলা করে। পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব টহল দিলে হয়ত দুর্বৃত্তরা এ ধরনের অপতৎপরতা করার সাহস দেখাবে না।

বিএসআরএমের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, বন্দর থেকে কারখানায় স্ক্র্যাপ নেওয়ার পথে প্রচুর স্ক্র্যাপ চুরি হয়। অনেক সময় সন্ত্রাসীরা লরি আটকিয়ে স্ক্র্যাপ লুট করে। বাধা দিলে আমাদের নিরাপত্তা কর্মীদের ওপর হামলা করে। বিশেষ করে টোল রোডের শুকতারা হোটেল ও ফকিরহাট এলাকা নিয়ে একটি সন্ত্রাসী দল রয়েছে। লুটের স্ক্র্যাপগুলো অনেক সময় সিটি গেট সংলগ্ন পুরনো লোহার কয়েকটি দোকানে মজুদ ও কেনাবেচা চলে। আমরা অনেকবার প্রশাসনকে জানিয়েছি।

কেএসআরএমের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান বলেন, বন্দর থেকে কারখানার কাঁচামাল পরিবহনের সময় বিভিন্ন স্পটে স্থানীয় চোর সিন্ডিকেটের কবলে পড়তে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গাড়ি থামিয়ে চোরের দল জোর করে মালামাল নিয়ে যায়। চোরের উপদ্রব আগে অসহনীয় পর্যায়ে ছিল। ব্যবসায়ীদের অনুরোধে সাম্প্রতিক সময়ে টোল রোডসহ বিভিন্ন সড়কে টহল তৎপরতা বাড়িয়েছে পুলিশ। আমরা আশা করছি, এসব চোরকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার ব্যাপারে প্রশাসনের ধারাবাহিক তৎপরতা ও নিয়মিত অভিযান অব্যাহত থাকবে।

স্ক্র্যাপ লুট রোধে পদক্ষেপের বিষয়ে র‌্যাব-৭ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মশিউর রহমান জুয়েল বলেন, এ ধরনের তথ্য আমরা পাচ্ছি। ইদানীং এসব রাস্তায় ছিনতাই, ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। টোল রোডসহ ওই এলাকাগুলোতে আমরা গোয়েন্দা নজরদারি আরো বাড়াব। এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অভিযান পরিচালনা করব এবং এ ধরনের অপতৎপরতা বন্ধ করতে শক্ত পদক্ষেপ নেব।

এ বিষয়ে সিএমপি কমিশনার মাহবুবর রহমান বলেন, বন্দরের টোল রোডে স্ক্র্যাপ লুটের ঘটনা আগে ঘটত। গত ৬ মাসে তিন থানার সমন্বয়ে যৌথ অভিযানের মাধ্যমে এগুলো নির্মূল করা হয়েছে। তবে এ ধরনের ঘটনা পুনরায় ঘটে থাকলে আমরা কঠোর হাতে দমন করব। সুূত্র. আজাদী