সীতাকুণ্ডে বিষাক্ত ফিশ ও পোল্ট্রি ফিড তৈরি কারখানার সন্ধান , বাজারে আসতো সৌদি আরবের একটি কোম্পানির নামে
বিশেষ প্রতিবেদক ।।
সীতাকুণ্ডে বিষাক্ত উপাদান দিয়ে তৈরি ফিশ ও পোল্ট্রি ফিড কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে । উপজেলার বাঁশবাড়িয়া এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে এ এণ্ড এ সু নামে একটি এবং এই কারখানার নিকটে অবস্থিত অন্য একটি কারখানায় সন্ধান পাওয়া গেছে । চট্টগ্রাম জেলা ডিবি পুলিশের অভিযানে উদঘাটিত এ কারখানায় কয়েক বছর ধরেই চলছিল ভেজাল, পরিত্যক্ত উপাদান দিয়ে মাছ ও মুরগির বিষাক্ত খাদ্য তৈরির কাজ ৷
রবিবার (২০ আগস্ট) রাত সাড়ে এগারোটার দিকে চট্টগ্রাম জেলা ডিবির একটি টিম সীতাকুণ্ডের ওই কারখানায় অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানের নেতৃত্ব দেন জেলা ডিবির ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক মো. কামরুজ্জামান। অভিযানে আরও অংশ নিয়েছেন জেলা ডিবির পরিদর্শক নুর আহম্মেদ, এসআই মো. গোলাম রাসেল পারভেজ, এসআই মো. শাকিলসহ টীমের সদস্যরা। অভিযানে বিপুল সংখ্যক ভেজাল খাদ্য, বিষাক্ত বর্জ্য, উৎপাদনের মেশিন, খালি প্যাকেট, বস্তা ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি জব্দ করা হয়েছে। যদিও এসময় ঘটনাস্থল থেকে তাৎক্ষণিক কাউকে আটক করা যায়নি৷
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, বিশাল আয়তনের গোডাউনের দুটি কক্ষে স্যাঁতস্যাঁতে, দূষিত পরিবেশে স্তূপ করা আছে শতশত বস্তা ভেজাল খাদ্য, মুরগির বিষ্ঠা, পঁচা বেকারি পণ্য, কাফকো স্যার। এসব বস্তা পঁচে গলে উৎকট দুর্গন্ধ আশেপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। কারখানার কোনও অংশে পঁচা খাদ্য খুুঁটে খুঁটে খাচ্ছে কাক, শালিকসহ পশু পাখিরা। আবার কোনও অংশে খাদ্যের বস্তার উপরে মৃত ইঁদুর ও তেলাপোকা পড়ে আছে, মেয়াদোত্তীর্ণ পঁচা বেকারি পণ্যে পিঁপড়া, মশা-মাছির ও পোকামাকড়ের উপদ্রব ছড়িয়ে আছে। এছাড়াও কারখানাটির বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য পাশের ফসলি জমি ও মৎস্য চাষের একটি পুকুরে গিয়ে পড়তে দেখা গেছে। এতে পুরো এলাকার পরিবেশ দূষিত হয়ে পড়েছে।
স্থানীয়রা জানান, বেশ কয়েক বছর আগে বাঁশবাড়িয়ার কোট্টা বাজার সংলগ্ন এ এণ্ড এ সু কারখানার সামনের বড় গোডাউনটি ভাটিয়ারী এলাকার রাসেল নামে এক ব্যক্তি বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব লায়ন আসলাম চৌধুরীর ভাই জসিম চৌধুরীর কাছ থেকে ভাড়া নেন৷ এরপর সেখানে শুরু হয় মাছ ও মুরগির ভেজাল খাদ্য তৈরির কাজ। তারা অভিযোগ করেন, কারখানাটি কোনো ধরণের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না মেনে আশেপাশের ফসলি জমি ও পুকুরে তাদের বর্জ্যগুলো অপরিশোধিতভাবে ছেড়ে দেয়া হতো। এছাড়াও রাতদিন কারখানাটি থেকে তীব্র পঁচা দুর্গন্ধ ছড়াতো। এতে কৃষক, খামারি, পথচারী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সীমাহীন ভোগান্তিতে ছিল ।
জেলা ডিবির অভিযান চলাকালে কারখানারটির মালিক মো. রাসেল ও ম্যানেজার ইলিয়াছকে পাওয়া যায়নি। কারখানাটির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা মো. খায়রুল ইসলাম বলেন, এখানে প্রতিদিন কয়েকটি ট্রাকে মালামাল আনা-নেওয়া করা হয় । ২৪ ঘন্টা ১৫ জন শ্রমিক এখানে কাজ করে । দুর্গন্ধের মধ্যেই আমি কাজ করে আসছি।
চট্টগ্রাম জেলা ডিবির ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক মো. কামরুজ্জামান বলেন, মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদান ব্যবহার করে পোল্ট্রি ও ফিশ ফিড উৎপাদন করা হচ্ছে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আমরা এমন খবর পেয়ে আগে থেকেই কারখানাটিকে নজরদারিতে রেখেছিলাম। নিশ্চিত হওয়ার পরপর গত রাতে আমরা এখানে অভিযান পরিচালনা করি। অভিযানে আনুমানিক আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার বস্তা ভেজাল খাদ্য, বিষাক্ত উপাদান, কাফকোর সারের বস্তা, খালি প্যাকেট ও দুটি মেশিন জব্দ করা হয়েছে। কারখানাটিতে তৈরিকৃত ভেজাল প্রাণি খাদ্য সৌদি আরবের আল নোখারা আল ওয়াতানিয়া নামে একটি কোম্পানির নামে প্যাকেটজাত করে বাজারে ছাড়া হচ্ছিল।
তিনি আরও বলেন, কারখানাটির পরিবেশ একেবারে অসহ্যকর। একজন মানুষ কয়েক ঘন্টা ভেতরে অবস্থান করলে নিশ্চিত অসুস্থ হয়ে পড়বেন। তিনি আরও বলেন, আমরা ইতিমধ্যে জব্দ মালামালের তালিকা করে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছি। একইসাথে কারা কারখানাটির সাথে জড়িত তাদেরকে গ্রেপ্তারে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। এ কারখানাটির বিএসটিআই, পরিবেশ অধিদপ্তর কিংবা অন্যান্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কোনো অনুমতি নেই। এখনও পর্যন্ত কোনো বৈধ কাগজপত্র কেউ দেখাননি।
জানা যায়, দেশে মাছ ও মুরগির খাবারে মিশ্রিত থাকে নানা রকম রাসায়নিক উপাদান। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হেভিমেটাল। যার কারণে এসব খাবার খেয়ে দ্রুত বড় হয় ফার্মের মুরগি, বাড়ে ওজনও। এসব খাবারে লুকিয়ে আছে মরণঘাতী ব্যাকটেরিয়াসহ মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর মারাত্মক জীবাণু। যা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা সহজ নয়। বাজারে বিক্রি হওয়া হাঁস-মুরগি ও মাছের খাদ্য (পোলট্রি-ফিশ ফিড) খাওয়ানো মুরগি কেটে এর রক্ত, মাংস, হাড়, কলিজা, মগজ ও চামড়া আলাদাভাবে পরীক্ষা করে আঁঁতকে উঠেছেন গবেষকরা। প্রথম দফায় এক মাস এসব খাদ্য খাওয়ানোর পরে এবং দ্বিতীয় দফায় আরেক মাস খাদ্য খাওয়ানোর পরে পরীক্ষা করে যে ফলাফল পাওয়া গেছে তা রীতিমতো ভয়ঙ্কর। এসব মুরগির মাথার মগজে সর্বোচ্চ পরিমাণ ক্রোমিয়াম পাওয়া যায়। ক্রোমিয়াম হলো এক ধরনের ভারী ধাতু, মানবদেহে যার সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা হলো প্রতিদিন ২৫ পিপিএম বা মাইক্রোগ্রাম। এর বেশি হলে অতিরিক্ত অংশ শরীরে জমা হতে থাকবে এবং একপর্যায়ে প্রাণঘাতী রোগ সৃষ্টি করবে।
কিন্তু পরীক্ষায় এক মাস খাদ্য খাওয়া মুরগির মগজে পাওয়া যায় ৭৯৯ পিপিএম এবং দুই মাস খাদ্য খাওয়া মুরগির মগজে (প্রতি কেজিতে) পাওয়া যায় চার হাজার ৫৬১ পিপিএম। এছাড়া মাংসে যথাক্রমে ২৪৪ ও ৩৪৪, চামড়ায় ৫৫৭ ও ৩২৮, হাড়ে এক হাজার ১১ ও এক হাজার ৯৯০, কলিজা বা লিভারে ৫৭০ ও ৬১১ এবং রক্তে ৭১৮ ও ৭৯২ পিপিএম ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে। এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, এই মাত্রা মানবদেহের জন্য অসহনীয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন বিপজ্জনক মাত্রার হেভিমেটালযুক্ত মাছ বা মুরগির মাংস কিংবা ডিম খেয়ে দেশের মানুষ এমন পর্যায়ে রয়েছে, যাকে বলা যায় ‘বিষাক্ত পুষ্টি’।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, ‘মাছ ও মুরগির খাদ্যে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক উপাদান ব্যবহার করা হলে আমাদের জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকিতে পড়বে। এসব খাদ্য খেয়ে বেড়ে ওঠা মাছ ও মুরগির মাংস, ডিম খেয়ে মানুষ হৃদরোগ, লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে। এছাড়াও পেটের অসুখ, কিডনি, পাকস্থলীর নানারকম রোগ দেহে বাসা বাঁধতে পারে। যেগুলো মানুষকে একসময় মৃত্যুর দিকে ধাবিত করবে।’
ফিশ ও পোল্ট্রি খাদ্যে ইউরিয়া স্যারের ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মানবদেহে এমনিতেই ইউরিয়া থাকে। কিন্তু বেশি মাত্রায় ইউরিয়ার কারণে লিভার, কিডনি থেকে পাকস্থলী, সর্বত্র প্রভাব পড়ে। দেখা দেয় নানা উপসর্গ। যেমন তলপেটে যন্ত্রণা, দুর্বলতা, পেশিতে টান।
উল্লেখ্য যে , মাছ ও মুরগিকে দ্রুত সময়ে বড় করে উৎপাদন বাড়াতে ভেজাল ফিশ ও পোল্ট্রি ফিড ব্যবহারের ঘটনা দেশে নতুন নয়। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা পরিত্যক্ত, বিষাক্ত উপাদান দিয়ে খাদ্য তৈরি করে বাজারে ছেড়ে দিচ্ছে। আর অতি মুনাফালোভী খামারিরা নিম্নমানের কম দামি এসব খাদ্য মাছ ও মুরগিকে খাওয়ানোর মাধ্যমে বিষাক্ত মাংস ও ডিম বাজারে বিক্রি করছে। এর মধ্য দিয়ে মানবদেহে ছড়িয়ে পড়ছে মরণব্যাধি ক্যান্সারসহ জটিল সব রোগের উপাদান৷ যা মানুষকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় ভেজাল ও বিষাক্ত প্রাণী খাদ্যের ছড়াছড়ি কিছুটা কমলেও থেমে নেই এসব চক্রের অবৈধ কর্মকাণ্ড ।
খালেদ / পোস্টকার্ড;