মিরসরাইয়ের ঝর্ণাগুলো যেন মৃত্যুকূপ

মিরসরাইয়ের ঝর্ণাগুলো যেন মৃত্যুকূপ
মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জের সোনাপাহাড় এলাকার মেলখুম ট্রেইল

মেজবাহ খালেদ ।।

দিন দিন বিপদজ্জনক হয়ে উঠেছে মিরসরাইয়ের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত ঝর্ণাগুলো । পর্যটকদের ঝর্ণায় গোসল করা , সাঁতার না জানা ও পানি থেকে উঠার অভিজ্ঞতা না থাকায় বারবার ঘটছে দূর্ঘটনা। আবার অনেকে ঝুঁকিপূর্ণভাবে সেলফি তুলতে গিয়ে দূর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে। এতে করে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল।

সর্বশেষ গত রবিবার (২ জুলাই) চট্টগ্রাম নগরের ফিরোজ শাহ এলাকার মোহাম্মদ জামিলের ছেলে নুরুল আবছার (১৬) ও একই এলাকার জসীম উদ্দিনের ছেলে আরিফুল ইসলাম আরিফ (১৭) নামে দুই পর্যটক মারা যান ।

এবিষয়ে বন বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনের কোন উদ্যোগ না থাকায় দূর্ঘটনা ঠেকানো যাচ্ছে না বলে দাবি স্থানীয়দের। তাছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে নেই সতর্কতার পোস্টার কিংবা ব্যানার।

সূত্র জানায়, গত কয়েক বছরে প্রায় ১৩ জন পর্যটক নিহত হয়েছে। সর্বশেষ গত রবিবার চট্টগ্রামের দুই পর্যটক মারা গেছেন । এর আগে গত ২৯ আগস্ট দেলোয়ার হোসেন নামে চট্টগ্রামের এক পুলিশ কর্মকর্তা আহত হয়। গত বছরের ১৫ আগস্ট চট্টগ্রাম থেকে আসা মেহেদী হাসান (২২) নামে একজন প্রকৌশল ছাত্রের রুপসী ঝর্ণায় নির্মম ভাবে মৃত্যু হয়। একই বছরের ২৬ জুলাই ঢাকা থেকে আসা প্রকৌশলী আবু আলী আল হোসাই মেমোরী ( ৩০ ) নামের প্রকৌশলী অসতর্কভাবে ছবি তুলতে গিয়ে পিছলে পড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে খৈয়াছরা ঝর্ণায়। ওই বছরের ১২ জুলাই বোয়ালিয়া ঝর্ণা দেখতে আসা ১৫ ছাত্রছাত্রী অসতর্কতার জন্য ঝর্ণার পথে ছরায় পানি বেড়ে যাওয়ায় আটকা পড়ে। পরে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা গিয়ে তাদের উদ্ধার করে।

গত বছরের ১৭ মার্চে পন্থিছিলা এলাকায় ঝরঝরি ঝরনা দেখতে গিয়েছিলেন পর্যটকরা। পন্থিছিলা এলাকায় গাড়ি থেকে নেমে দুই ঘণ্টা পায়ে হেটে দুর্গম ঝরঝরি ঝরনায় যেতে হয়। সাধারণত রাতে ওই এলাকায় কেউ যায় না। দিনে ঘুরতে গেলেও আলো থাকতে আবার ফিরে আসতে হয়। ওই ১৭ জন পর্যটক দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে একসঙ্গে হয়ে ঝরঝরি ঝরনা দেখতে আসেন। তারা পাহাড়ে গিয়ে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন। এর মধ্যে চারজন ঘুরতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু পথ হারিয়ে ফেলা চারজনকে খোঁজ না পেয়ে ৯৯৯ এ কল দেয় । পরে স্থানীয়দের সহায়তায় পুলিশ তাদের সবাইকে রাত দেড়টার দিকে উদ্ধার করে ।

গত কয়েক বছরে এভাবে অন্তত ১৩ জন সম্ভাবনাময় তরুণ প্রাণ হারায় এই ঝর্ণা দেখতে এসে। কিন্তু তবু ও দর্শনার্থিদের প্রবল আকর্ষন এই জলপ্রপাত সম সৌন্দর্য্যমন্ডিত ঝর্ণাগুলো। এই সব ঝর্ণা দেখতে আসা দর্শনার্থিরা সতর্ক না হলে আগামী দিনে একইভাবে দূর্ঘটনা বাড়তেই থাকবে।

অন্যদিকে, পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছে জোরারগঞ্জের সোনাপাহাড় এলাকার মেলখুম ট্রেইল । গহীন পাহাড়ের এই ট্রেইলটি নিয়ে রহস্যের যেন শেষ নেই। কী আছে সেখানে? কেন এতোটা কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয় সেখানে যেতে? কেন এতোটা আকর্ষণীয় এই ট্রেইল? এমন সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গহীন পাহাড়ের আঁকাবাঁকা, অত্যন্ত সরু, বেশ পিচ্ছিল, গভীর খাদের ঝিরি, অন্ধকারাচ্ছন্ন, বিপদজনক সুউচ্চ পাহাড়ের কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে মেলখুমে বা মেলকুমে পৌঁছায় দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসা পর্যটকরা।

কিন্তু দিনে দিনে সেখানে ঘটছে নানা অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা। প্রায়ই পর্যটকরা এখানে আটকা পড়ছেন ও হারিয়ে যাচ্ছেন। পথটি অত্যন্ত পিচ্ছিল, ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন, আছে গভীর খাদও। এখানে সূর্যের আলো পৌঁছায় না। স্থানীয়রা এটিকে মৃত্যুকূপ হিসেবে অভিহিত করেছে। এর প্রবেশ পথের দু’পাশে অন্তত ২০০ ফুট উঁচু পাহাড় আড়াআড়িভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ( নিউজের ছবি )

গত ১৫ মে থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সেখানে প্রবেশ না করতে পর্যটকদের নিরুৎসাহিত করতে শুরু করেছে মিরসরাই রেঞ্জ বন বিভাগের কর্মকর্তারা।

তবুও বন্ধ করা যাচ্ছে না পর্যটকদের যাতায়াত। চলতি বছরের ঈদুল ফিতরের ছুটিতে মেলখুমে বেড়াতে এসে দুই দফায় আটকা পড়েন ১৩ পর্যটক। পরে ৯৯৯ এ কল দিয়ে সহযোগিতা চাওয়া হলে জোরারগঞ্জ থানা পুলিশ ৮ ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে তাদের উদ্ধার করে।

মিরসরাই বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা শাহ নেওয়াজ নওশাদ বলেন, মেলখুম ট্রেইল বিপদজনক বিধায় সেখানে পর্যটক প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অনেক পর্যটক সেখানে গিয়ে বিপদে পড়ছেন। ইতিমধ্যে আমরা মেলখুমের বিভিন্ন প্রবেশ পথে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি, সাইনবোর্ড টাঙিয়েছি।

পর্যটকদের বারবার সতর্ক করা হচ্ছে মেলখুমে না যেতে। পাহাড়ে আমাদের নিরুৎসাহিতকরণ অভিযান অব্যাহত আছে। এরপরও কিছু পর্যটক ভিন্ন পথ অবলম্বন করে মেলখুম ট্রেইলে পৌঁছে যাচ্ছেন৷ কেউ যদি সেখানে গিয়ে কোন বিপদে পড়েন তাহলে আমরা তার দায় নিব না।

তিনি আরও বলেন, যেহেতু মেলখুম কোনো পর্যটন স্পট নয়, সেহেতু আমরা কোনো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবো না। এটি একটি রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকা। এমনিতেই সেখানে দু’চারজন প্রবেশ করতে হলে অনুমতির প্রয়োজন আছে বলে জানান তিনি ।

এই বিষয়ে মিরসরাইয়ের ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষন পরিষদের সভাপতি প্রফেসর ডা. জামশেদ আলম বলেন, ঝর্ণার এলাকা গুলোতে বন বিভাগের উদ্যোগে সতর্কতা সম্বলিত বিভিন্ন ফেস্টুন, সাইনবোর্ড, সতর্কবার্তা সকল ঝুঁকিপূর্ণ স্থানের আসেপাশে লাগানোর ব্যবস্থা করা জরুরি।

তিনি বলেন, রাস্তাঘাটের তেমন কোন  সংস্কার করা হয়নি । যেসব স্থান ঝুঁকিপূর্ণ কিংবা বিপদজনক, সেসব স্থানে সচেতনতা কিংবা নিষেধ করার জন্য কোন প্রশাসনের কোন উদ্যোগ নেই। প্রশাসনের সদিচ্ছাই পারে মৃত্যুঝুঁকি এড়াতে।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;