বড় ভাইদের আশীর্বাদ -মা-বাবার অন্ধ স্নেহে গড়ে উঠছে কিশোর গ্যাং ,আছে নিম্ন ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা

বড় ভাইদের আশীর্বাদ -মা-বাবার অন্ধ স্নেহে গড়ে উঠছে কিশোর গ্যাং ,আছে নিম্ন ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা

নিজস্ব প্রতিবেদক ।।

মা-বাবার অন্ধ স্নেহ , বড় ভাইদের আশীর্বাদ আর মাদকের সর্বনাশা নেশায় নিম্ন ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা জড়িয়ে পড়ছে কিশোর অপরাধে। ছিনতাই থেকে খুন-খারাবি, মাদক ব্যবসা থেকে অপহরণ; নানা অপরাধে জড়াচ্ছে কিশোররা। গড়ে তুলছে নিজস্ব গ্যাং। ক্রমশ বাড়ছে কিশোর অপরাধের সংখ্যা। ফেসবুকেও তাদের পেজ ও ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ রয়েছে। ওই সব পেজে গ্রুপের সদস্যরা সারাদিন অশ্লীল ভাষায় তথ্য আদান প্রদান করে। তবে র‌্যাব-পুলিশ বলছে, কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা আগের তুলনায় এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। সমপ্রতি মাদক সহজলভ্য না হওয়ায় চুরি-ছিনতাইয়ে নামছে তারা।

কিশোর গ্যাং কালচারের বিরোধের জের ধরে গত ২৪ আগস্ট (মঙ্গলবার) নগরীর ইপিজেড থানাধীন বন্দরটিলা এলাকায় অধরা আহমেদ (২২) নামে এক তরুণীকে বাসায় গিয়ে বেধড়ক মারধর করে পাঁচ কিশোর-কিশোরীর একটি দল। ঐ ঘটনায় লেডি গ্যাং লিডার তাহমিনা সিমি (১৮) ওরফে সিমরান সিমিকে দুই সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

ইপিজেড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উৎপল বড়ুয়া জানান, মোহনা আক্তার নামে এক নারীর দায়ের করা মামলার ভিত্তিতে লেডি গ্যাং লিডার সিমি ও তার দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সামাজিক ও নৈতিক অধ:পতনের খন্ডিত চিত্র এটি। পুলিশ ও মামলার এজাহারের সূত্রে জানা গেছে, মারধর ছাড়াও হামলাকারীরা ওই তরুণীর গায়ের পোশাকও ছিঁড়ে ফেলে। ঘটনাটি মোবাইলে ভিডিও করে হামলাকারীরাই ‘শিক্ষা দিতে’ শিরোনামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেটি ভাইরাল করে। এর কিছুদিন আগে ফ্লাইওভার ভিত্তিক গ্যাং কালচারের একটি চিত্র উঠে আসে র‌্যাব পুলিশের অভিযানের মধ্য দিয়ে। ফ্লাইওভারের মাঝে ধারালো সুতার মাধ্যমে প্রথমে চলন্ত মোটরসাইকেল আরোহীদের রাস্তায় ফেলে দেয়। এরপর সাহায্যের নামে কাছে এসে আহত আরোহীর মালামাল লুটে নেয়। বিপজ্জনক এসব অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়েছে চট্টগ্রামের কয়েকটি কিশোর গ্যাং। এই সুতার কবলে পড়ে প্রায়ই গুরুতর আহত হচ্ছেন অনেকেই। র‌্যাবের হাতে এই চক্রের ৬ সদস্য আটকের পর বের হয়ে আসছে অভিনব পন্থার এই ছিনতাইয়ের তথ্য। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটককৃতরা স্বীকার করেছে দলের কম বয়সীরাই ফ্লাইওভারে খেলার অভিনয়ে ধারালো সুতা বেঁধে দেয়। আর তাদের নেপথ্যে থাকে মোটরসাইকেল নিয়ে বড় ভাইরা। সুতায় লেগে কোনো আরোহী রাস্তায় পড়ে গেলে পেছন থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে এসে আহত পথচারীর মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। র‌্যাব-৭ এর অধিনায়ক লে. কর্ণেল মশিউর রহমান জুয়েল জানান, মানুষের জীবনের কথা চিন্তা না করে, নেশার টাকা জোগাড় করতেই তারা এই অভিনব ছিনতাই করতো। আটককৃত ছয় জনের মধ্যে শুধুমাত্র একজনের বয়স ৩২ বছর। বাকি সবাই ১৮ বছরের নিচে। এর মধ্যে দু’জনের বয়স ১২ থেকে ১৪ বছর।

র‌্যাবের এ অভিযানের পর পাঁচলাইশ থানা পুলিশ ফ্লাইওভারে সুতা বেঁধে ছিনতাইয়ের ঘটনায় ৩৪ জনকে আটক করে। উদ্ধার করা হয় বেশ কয়েকটি ধারালো অস্ত্র। পাঁচলাইশ থানার ওসি আবুল কাশেম ভূঁইয়া জানান, দীর্ঘদিন ধরে ফ্লাইওভারগুলোতে সুতা বেঁধে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে আসছে। এমন খবরে আখতারুজ্জামান, বহদ্দারহাটসহ নগরীর বিভিন্ন ফ্লাইওভারে অভিযান চালানো হয়। দুইদিনের অভিযানে ৩৪ জনকে আটক করা হয়। তাদের মধ্যে ১৪ জনই কিশোর অপরাধী। আদালতের নির্দেশে তাদেরকে হাটহাজারী কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানো হয়েছে।

র‌্যাবের একটি সূত্র জানায়, কিশোর গ্যাং কালচারের যাত্রা শুরু হয় ২০০১ সালে। মূলত মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, পার্টি করা, হর্ন বাজিয়ে প্রচন্ড গতিতে মোটর বা কার রেসিং করা, খেলার মাঠ নিয়ন্ত্রণ করা, দেয়ালে চিকা মেরে নিজেদের পাওয়ার বা অবস্থান জানান দেওয়া, এমনকি মাদক গ্রহণ প্রভৃতি কর্মকান্ড ঘিরে গড়ে ওঠে এসব কিশোর গ্যাং গ্রুপ।

পুলিশ ও অপরাধবিজ্ঞানীরা বলছেন, পারিবারিক অনুশাসনের অভাবে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে এসব শিশু-কিশোর। তুচ্ছ বিষয়ে কথা কাটাকাটি, ফেসবুক-মোবাইল, প্রেম, চুরি-ছিনতাইসহ নানা ইস্যুতে সামান্য মতানৈক্য হলেই এদের মাথায় খুনের নেশা আসে। আবার মাদক বিক্রেতা থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ পর্যন্ত অনেকেই নিজেদের স্বার্থে কিশোরদের অপরাধ জগতে টানছে। ফলে এই কিশোররা পরিবারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। যারা শুধু পাড়া-পড়শি নয়, নিজের পরিবারের জন্যও মারাত্মক বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।