নির্বাচন নিয়ে কূটনীতিকদের মন্তব্য ‘শিষ্টাচারবহির্ভূত’, ক্ষুব্ধ সরকার

নির্বাচন নিয়ে কূটনীতিকদের মন্তব্য ‘শিষ্টাচারবহির্ভূত’, ক্ষুব্ধ সরকার
নির্বাচন নিয়ে কূটনীতিকদের মন্তব্য ‘শিষ্টাচারবহির্ভূত’, ক্ষুব্ধ সরকার

পোস্টকার্ড ডেস্ক ।।

বিরোধী দলগুলো যখন আগামী নির্বাচন সামনে রেখে মাঠ দখলের চেষ্টা করছে, তখনই একের পর এক ‘বিতর্কিত’ মন্তব্য করে যাচ্ছেন ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশি দূতরা। কূটনীতিকদের এসব মন্তব্য ‘শিষ্টাচারবহির্ভূত’ বলে মনে করছে সরকার।

বিশেষ করে ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে সম্প্রতি জাপানের রাষ্ট্রদূতের মন্তব্য সরকারের শীর্ষ পর্যায়কে ক্ষুব্ধ করেছে। এ বিষয়ে সরকারের একাধিক মন্ত্রী প্রকাশ্যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কূটনৈতিক বক্তব্যই দিয়েছে। ওই মন্তব্যের জেরে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকিকে ডেকে বুধবার সতর্ক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্টে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লিখেছেন, ‘আমরা বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের অ্যাম্বাসেডরকে (রাষ্ট্রদূত) ডেকেছিলাম। তাকে যা যা বলা দরকার আমরা বলেছি। সবকিছু বিস্তারিত গণমাধ্যমে বলার প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না। তাই এই বিষয়ে গণমাধ্যমে আমরা আর কোনো বক্তব্য দিতে চাই না।’

একই পোস্টে তিনি ভিয়েনা কনভেনশন ১৯৬১-এর অনুচ্ছেদ ৪১ ধারা-১-এর কথা কূটনীতিকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। যে ধারায় কূটনীতিকদের স্বাগতিক রাষ্ট্রের আইন ও বিধিবিধানের প্রতি শ্রদ্ধা করতে স্মরণ করতে এবং ওই দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকতে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, গত ১৪ নভেম্বর ঢাকায় সেন্টার ফর গভর্ন্যাস স্টাডিজের মিট দ্য অ্যাম্বাসেডর অনুষ্ঠানে সরকার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন জাপানের রাষ্ট্রদূত। ২০১৮ সালের নির্বাচনসংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি শুনেছি, (গত নির্বাচনে) পুলিশের কর্মকর্তারা আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছেন। আমি অন্য কোনো দেশে এমন দৃষ্টান্তের কথা শুনিনি। আমি আশা করব, এবার তেমন সুযোগ থাকবে না বা এমন ঘটনা ঘটবে না।’

তার এ বক্তব্যের পর গতকাল বুধবার প্রকাশ্যেই ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী। তাদের অভিযোগ, বন্ধুপ্রতিম দেশ হিসেবে সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলেও নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ বিষয়ে কূটনীতিকদের মন্তব্য সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপের পর্যায়ে পড়ে।

মেহেরপুরে এক অনুষ্ঠানে বৃহস্পতিবার কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে জাপান কেন, কোনো রাষ্ট্রদূতের নাক গলানো আমরা কখনোই মেনে নিতে পারি না। তাদের আবারও সতর্ক করা হবে। বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। দেশের আত্মমর্যাদা রক্ষায় আমরা কাউকে ছাড় দেব না।’

রাজ্জাক বলেন, সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্ট বলা আছে নির্বাচন পরিচালনা করবে নির্বাচন কমিশন। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপাররা নির্বাচন শান্তিপূর্ণ করবেন।

তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বুধবার সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কথা বলার সময় কূটনীতিকদের অবশ্যই কূটনৈতিক শিষ্টাচারের দিকে লক্ষ রাখা উচিত।’

তবে এ জন্য তিনি কূটনীতিকদের চেয়ে বিরোধী দলকেই বেশি দুষেছেন। হাছান মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের রাজনীতিবিদরা, বিএনপি ও অন্যান্য দলের রাজনীতিবিদরা গিয়ে যখন তাদের (কূটনীতিকদের) পায়ে পানি ঢালে এবং বলে, ‘একটু বলুন, একটু দেখা করুন’, আবার রাত-বিরাতে ওদের বাড়িতে যায়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর জন্য তাদের প্ররোচিত করা হয়। যত না কূটনীতিকদের দোষ, তার থেকে বেশি দোষ বিএনপিসহ যারা তাদের কাছে গিয়ে ধরনা দেয় তাদের।’

তবে উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের এসব বিষয়ে কথা বলার অধিকার রয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান। তিনি দৈনিক বাংলাকে বলেন, বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্র যার আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অনেক পদচারণা রয়েছে, সেখানে যদি মারাত্মক বিচ্যুতি ঘটে, তখন অবশ্যই রাষ্ট্রদূতরা বক্তব্য রাখতেই পারেন। জনগণ এবং মানবাধিকারের ধারণা সামনে রেখেই এসব মতামত দেয়া হয়।

অধ্যাপক শাহীদুজ্জামান বলেন, বিদেশি দূতরা তাদের জাতীয় স্বার্থে কীভাবে বাংলাদেশকে দেখতে চান সেটি প্রকাশ করতেই পারেন। এটি কোনোভাবেই অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা নয়। মন্ত্রীদের বক্তব্যের সমালোচনা করে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এই বিশ্লেষক বলেন, যারা ভিয়েনা কনভেনশনের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন তারা কি রাষ্ট্র ধারণার মৌলিক বিষয়টি মানেন? তারা কি মানুষের ভোটাধিকার মানেন?

তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আরেক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. এহসানুল হক দ্বিমত করেছেন অধ্যাপক শাহীদুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি বলেন, জাপানের রাষ্ট্রদূত স্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ ছাড়া এ ধরনের কথা বলে কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন তো করেছেন, পাশাপাশি জাপানের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন করেছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন করেছেন।

বাংলাদেশ নিয়ে কূটনীতিকদের বক্তব্য নতুন নয়

গতকাল বুধবার ঢাকায় নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মুস্তাফা ওসমান তুরান বলেছেন, বাংলাদেশ সরকার একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের চেষ্টা করছে। আমরা আশা করি, সরকার এ দেশে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে।

মুস্তাফা ওসমান বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন অভ্যন্তরীণ বিষয়। তবে নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলেরই পর্যবেক্ষণ ও অংশ নেয়া উচিত। আর যেকোনো সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক সংলাপ প্রয়োজন।

রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশে অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের সুযোগ আছে। তবে দুঃখজনকভাবে এটি এখন হচ্ছে না। তিনি বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার জন্য সরকারের সদিচ্ছা থাকতে হবে। তবে নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশই যেকোনো সিদ্ধান্ত নেবে, কোনো বিদেশি শক্তি নয়।

এর আগে গত ৮ নভেম্বর ঢাকায় সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত মতবিনিময় সভায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচনে কে জয়লাভ করল তা নিয়ে নয়, যুক্তরাষ্ট্র অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে চিন্তা করে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের সব সংস্থাকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার দিনটির আগে থেকেই নির্বাচন শুরু হয়।

গত ১৪ অক্টোবর জার্মান রাষ্ট্রদূত আখিম ট্রোসটার বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ভোটারের ভোট দেয়ার এবং সরকার গঠনে ভূমিকা রাখার অধিকার রয়েছে। তাই সমালোচিত হলেও বন্ধু হিসেবে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিষয়ে কথা বলে যাব।’

সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলছেন। বৈঠক শেষে তারা কোনো বক্তব্য না দিলেও সংশ্লিষ্ট দলগুলো বৈঠকের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেয়। সেখানে বলা হয়, কূটনীতিকরা নির্বাচন, মানবাধিকারসহ নানা বিষয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন।

পেছনের কথা

১৯৯৫ সালের দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি নিয়ে জোরদার আন্দোলনে নেমেছিল আওয়ামী লীগসহ সমমনা দলগুলো। জামায়াত-জাতীয় পার্টিও তাদের সঙ্গী হয়। ওই সময় বিএনপি সরকারের অনড় অবস্থানের কারণে বিরোধীদের হরতাল-অবরোধে দেশ প্রায় অচল হয়ে পড়ে। তখন মধ্যস্থতা করতে কমনওয়েলথের সেক্রেটারি জেনারেল এমেকা এনিয়াকু তার প্রতিনিধি হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গভর্নর জেনারেল স্যার নিনিয়ান স্টিফেন ঢাকায় পাঠান। কিন্তু তার প্রচেষ্টা সফল হয়নি। শাসক দল একতরফা নির্বাচন করলে আন্দোলনে অচল হয়ে পড়ে সরকারব্যবস্থা। তখন তারাই তড়িঘড়ি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধানে সংযোজন করে দায়িত্ব ছাড়ে।

১৯৯৬ সালের জুনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। মেয়াদ শেষে ২০০১ সালের জুলাইয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা ছাড়ে দলটি। সে সময় নানা কারণে অস্থিরতা দেখা দিলে মধ্যস্থতা করতে বাংলাদেশে আসেন জিমি কার্টার। তিনি সব পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে অনেক পরামর্শ দেন। তার প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতায় অন্তরায় দুটো প্রধান দলের মধ্যে বৈরিতা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মতভেদ ও হানাহানি।

২০০৫ সালেও নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে রাজনৈতিক বিরোধ ভয়াবহ রূপ নিলে বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল বিদেশি দূতাবাসগুলোতে দফায় দফায় বৈঠক করেন। সেবারও জনমত উপেক্ষা করে বিএনপি এককভাবে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের চেষ্টা করে। সে পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সংকট নিরসনে ঢাকায় কর্মরত ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী, ভারতের হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন, আমেরিকার রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাস, পরবর্তী সময়ে প্যাট্রিসিয়া বিউটিনিসসহ অসংখ্য বিদেশি কূটনীতিককে পরিস্থিতি সামলাতে দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা যায়। ঢাকায় তখনকার কূটনৈতিক কোরের ডিন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত শাহতা জারাব বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অন্যতম মধ্যস্থতাকারী হয়ে ওঠেন।

২০১৪ সালের নির্বাচনের আগেও রাজনৈতিক বিরোধ মেটাতে ২০১৩ সালের জুনে ঢাকায় আসেন জাতিসংঘের রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তখনকার বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া ছাড়াও আরও কয়েকটি দলের নেতা এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। মধ্যস্থতায় ব্যর্থ হয়ে তিনি ফিরে যাওয়ার পর জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন নিজেও দুই নেত্রীর সঙ্গে আলাপে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চায়- সে বার্তা দিয়েছিলেন। পরে সে বছরের অক্টোবরে তারানকো আওয়ামী লীগের তখনকার সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে ফোনে আবারও কথা বলেন। তার সে চেষ্টাও সফল হয়নি। দৈনিক বাংলা

খালেদ / পোস্টকার্ড;