দুদকের তিন মাসে ৪৮ মামলা, ৫৬ শতাংশ আসামি সরকারি চাকরিজীবী-আবদুল্লাহ আল মামুন

দুদকের তিন মাসে ৪৮ মামলা, ৫৬ শতাংশ আসামি সরকারি চাকরিজীবী-আবদুল্লাহ আল মামুন
দুদকের তিন মাসে ৪৮ মামলা, ৫৬ শতাংশ আসামি সরকারি চাকরিজীবী-আবদুল্লাহ আল মামুন

অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে চলতি বছরের প্রথম ৩ মাসে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অন্তত ৪৮টি মামলা করেছে। এসব মামলায় মোট আসামির সংখ্যা ১০২ জন। আসামিদের অর্ধেকের বেশি (৫৫.৮৮ শতাংশ) সরকারি চাকরিজীবী, ৫৭ জন।

অন্যদিকে একই সময়ে দুদক বিভিন্ন অপরাধীর বিরুদ্ধে আদালতে মোট চার্জশিট দাখিল করেছে ৫৩টি। এসব চার্জশিটে মোট আসামির সংখ্যা ৯৭ জন। চার্জশিটভুক্ত আসামিদের মধ্যে সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা ৪০ জন। অর্থাৎ চার্জশিটের আসামিদেরও অর্ধেকের বেশি (৪১.২৩ শতাংশ) সরকারি চাকরিজীবী। তাদের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন, আত্মসাৎ, জাল-জালিয়াতির অভিযোগে এসব মামলা করা হয়েছে। দুদক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

দুর্নীতি প্রতিরোধ ও মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে জনগণের সেবার পরিবর্তে নিজেরা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ায় দুদকের মামলায়ও তাদের সংখ্যা বেশি। তাদের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য শাস্তির দৃষ্টান্ত না থাকায় দুর্নীতি বন্ধ না হয়ে বরং বেড়েই চলেছে। এ ক্ষেত্রে যথাযথ তদন্ত করে দুর্নীতিবাজদের শাস্তির আওতায় এনে দৃষ্টান্ত তৈরি করা গেলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে।

ওই সূত্র জানায়, দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটির গত ৩ মাসে করা ৪৮টি মামলার আসামিদের মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া অন্য আসামিদের সংখ্যা ৪৫ জন। এর মধ্যে- বেসরকারি চাকরিজীবী ১৫ জন, ব্যবসায়ী ১২ জন, জন-প্রতিনিধি একজন ও অন্যান্য পেশার ১৬ জন। আবার চার্জশিটভুক্ত সরকারি আাসমিদের বাইরে অন্য আসামিদের সংখ্যা ১৭ জন। চার্জশিটভুক্ত অন্য আসামিদের ৮ জন বেসরকারি চাকরিজীবী, ১৭ জন ব্যবসায়ী, ২ জন প্রতিনিধি ও অন্যান্য পেশার ৩০ জন।

দুদক জানায়, ৩ মাসে হওয়া ৪৮টি মামলার মধ্যে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন-সংক্রান্ত ১৭টি, আত্মসাৎ-সংক্রান্ত ২৫টি, জাল-জালিয়াতির ৫টি ও মিথ্যা অভিযোগ-সংক্রান্ত ১টি। একই সময়ে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের তদন্ত শেষে ১৮টি মামলায় চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। এ ছাড়া আত্মসাৎ-সংক্রান্ত ২৯টি, ঘুষ লেনদেন-সংক্রান্ত ১টি, জাল-জালিয়াতির ৪টি ও মিথ্যা অভিযোগ-সংক্রান্ত একটি মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হয়েছে।

দুদক আরও জানায়, শুধু সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নয়, এ ৩ মাসে দুদকের ৩ জন নিজস্ব কর্মীর বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা নিয়েছে সংস্থাটি। এর মধ্যে ২ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা ও  ১ জনকে লঘুদ- (তিরস্কার) দেওয়া হয়েছে।

দুদক জানায়, গত ৩ মাসে হওয়া উল্লেখযোগ্য মামলাগুলোর মধ্যে মিসরের ইজিপ্ট এয়ার থেকে দুইটি বিমান লিজ গ্রহণ-সংক্রান্ত মামলাটি অন্যতম। মিসর থেকে বিমান লিজ ও রি-ডেলিভারি পর্যন্ত বিমান বাংলাদেশের ১ হাজার ১৬১ কোটি টাকা ক্ষতিসহ আত্মসাতের অভিযোগে এ মামলাটি করা হয়। এ মামলায় ২৩ আসামির মধ্যে বিমানের সাবেক পরিচালক (ফ্লাইট অপারেশন্স) ক্যাপ্টেন ইশরাত আহমেদ, সাবেক ডেপুটি চিফ ইঞ্জিনিয়ার শফিকুল আলম সিদ্দিক, মহা-ব্যবস্থাপক (মুদ্রণ ও প্রকাশন) মো. আবদুর রহমান ফারুকী, সাবেক প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার (সার্ভিসেস অ্যান্ড অডিট) শহীদ উদ্দিন মোহাম্মদ হানিফ, এয়ারওয়ারথনেস কনসালট্যান্ট গোলাম সারওয়ার, সাবেক চিফ ইঞ্জিনিয়ার (ইঞ্জিন ও সার্ভিসেস) গাজী মাহমুদ ইকবাল অন্যতম। উল্লেখযোগ্য অন্য মামলার মধ্যে একটি করা হয়েছে প্রিমিয়াম লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল হামিদ মিয়ার বিরুদ্ধে। এ মামলায় তার বিরুদ্ধে অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গ করে ৪ কোটি ১৬ লাখ ৯৭ হাজার ৭৭০ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রাইম ফাইন্যান্স ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড থেকে ৩৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সৈয়দ তৈয়বুল বশর মাইজভান্ডারিসহ ১৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া ৩৬ কোটি ৪৯ লাখ ৩১ হাজার টাকা আত্মসাতের দায়ে করা মামলায় বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্সিয়াল কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফসি) সাবেক চেয়ারম্যান উম্মে কুলসুম মান্নানসহ ১২ জনকে আসামি করা হয়েছে।

এ বিষয়ে দুদক কমিশনার (তদন্ত) জহুরুল হক সময়ের আলোকে বলেন, দুদকে যেসব অভিযোগ আসে সেগুলো যথাযথ প্রক্রিয়ায় যাচাই-বাছাই করে এখতিয়ারভুক্ত হলে অনুসন্ধান করে মামলা ও চার্জশিট দিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি বা বিশেষ কোনো পরিচয় বিষয় নয়। তবে এখতিয়ারভুক্ত না হলে সেগুলো অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেওয়া হয় না।

দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টরন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সময়ের আলোকে বলেন, দুদকের করা দুর্নীতির মামলায় আসামিদের মধ্যে সরকারি চাকরিজীবীদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় এটা প্রমাণ করে যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুর্নীতিতে বেশি জড়িত। সরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষমতা দেওয়া হয় জনগণের কাজ করার জন্য। কিন্তু একশ্রেণির লোক সেই ক্ষমতা অপব্যবহার করে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। তারা মনে করে, যতই অপরাধ করুক, শাস্তির সম্ভাবনা অনেক কম।

তার মতে, দুর্নীতিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে তাদের ভেতরে আতঙ্ক কাজ করবে। তখন তারা ভাববে, দুর্নীতি করে পার পাওয়া যায় না। ফলে দুর্নীতি করতে গেলে তারা অনেক ভাবনা-চিন্তা করে পা ফেলবে। 

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মানবাধিকার কর্মী মনজিল মোরসেদ সময়ের আলোকে বলেন, সরকারি চাকরিজীবীদের হাতে অঢেল ক্ষমতা থাকায় একশ্রেণির কর্মী জনস্বার্থে কাজ না করে নিজেরাই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে অপরাধীদের বিরুদ্ধে শাস্তির দৃষ্টান্ত তৈরিসহ যথাযথ জবাবদিহি নিশ্চিত করা গেলে তারা সতর্ক হবে। -সময়ের আলো

খালেদ / পোস্টকার্ড ;