কর্ণফুলী নদীর তলদেশে স্বপ্নের ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’ এর বিশাল কর্মযজ্ঞের অর্ধেক শেষ

‘বঙ্গবন্ধু টানেল’এর দুটি টিউবের মধ্যে একটির ১২০০ মিটার রিং বসানো হয়েছে ৩৮৩ একর ভূমি অধিগ্রহণ করে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে যথাসময়ে কাজ শেষ হবে’

কর্ণফুলী নদীর তলদেশে স্বপ্নের ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’ এর বিশাল কর্মযজ্ঞের অর্ধেক শেষ

ইমরান বিন ছবুর ।।

‘বঙ্গবন্ধু টানেল’ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ ৫০ শতাংশ (সার্বিক) সম্পন্ন হয়েছে। টানেলের ভিতরে দুটি টিউবের মধ্য দিয়ে যান চলাচল করবে। প্রতিটি টিউবের দৈর্ঘ্য হবে ২ হাজার ৪৫০ মিটার। একটি টিউব দিয়ে নেভাল থেকে আনোয়ারামুখী যান যাবে। অন্যটি দিয়ে আনোয়ারা থেকে শহরমুখী যান আসবে। আনোয়ারামুখী টিউবটির ১ হাজার ২০০ মিটার রিং বসানোর কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে এবং আগামী মে-জুন মাসে টিউবটির রিং বসানোর কাজ সম্পন্ন হবে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বড় সমস্যা না হলে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে আশা করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। ৯৪ মিটার দীর্ঘ ও ২২ হাজার টন ওজনের টিবিএম মেশিন (টানেল বোরিং মেশিন) দিয়ে খনন কাজ করে এই রিং বসানো হচ্ছে।

চীনের সাংহাই শহরের আদলে চট্টগ্রামকে ‘ওয়ান সিটি এন্ড টু টাউন’ মডেলে দেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কে সংযুক্তিসহ সাতটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়াধীন বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ কর্ণফুলী নদীর তলদেশে চার লেন বিশিষ্ট সড়ক টানেল নির্মাণ প্রকল্পের কাজ হাতে নেয়।

২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর টানেল নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং এবং চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানেলের মূল খনন কাজ উদ্বোধন করেন। এই প্রকল্পে ব্যয় হবে ৯ হাজার ৮৮০ কোটি ৪০ লাখ টাকা। যার মধ্যে ঋণ হিসেবে চীনের চাইনিজ এক্সিম ব্যাংক দেবে ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা। তবে প্রথমে টানেলের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। বাড়তি জমির প্রয়োজনীয়তা ও জমির মূল্য বাড়ায় এই প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে ৪ হাজার ১০৯ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

বঙ্গবন্ধু টানেলের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশিদ চৌধুরী বলেন, এখন কর্ণফুলী নদীর মাঝামাঝিতে কাজ চলছে। বর্তমানে টানেলের সার্বিক অগ্রগতি হচ্ছে ৫০ শতাংশ। ভূমি অধিগ্রহণের কাজ আমাদের সম্পন্ন হয়েছে। মোট ৩৮৩ একর ভূমি অধিগ্রহণ করে ইতোমধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। টানেলের কাজ সম্পন্ন হলে নদীর তলদেশে দু’টি টিউব দিয়ে যান চলাচল করবে। একটি টিউব দিয়ে নেভাল থেকে আনোয়ারামুখী যান চলাচল করবে। অন্যটি দিয়ে আনোয়ারা থেকে শহরমুখী যান আসবে। প্রতিটি টিউবের দৈর্ঘ্য হবে ২ হাজার ৪৫০ মিটার। এরমধ্যে নেভাল থেকে আনোয়ারামুখী টিউবের ১ হাজার ২০০ মিটার রিং বসানোর কাজ শেষ হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, ‘এখন টিবিএম (টানেল বোরিং মেশিন) নদীর তলদেশে টিউব তৈরি করে নেভাল থেকে আনোয়ারা অংশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যা দুই লেনের একটি টিউব হবে। সেটি শেষ হলে টিবিএম আনোয়ারা প্রান্ত থেকে নদীর তলদেশে ঢুকে আরেকটি দুই লেনের সড়ক খনন করে নেভাল অংশে বের হবে। এভাবে দুটি টিউবে চার লেনের সড়ক পথ হবে। টানেলের প্রতিটি টিউব চওড়ায় হবে ১০ দশমিক ৮ মিটার বা ৩৫ ফুট এবং উচ্চতায় হবে

৪ দশমিক ৮ মিটার বা প্রায় ১৬ ফুট। একটি টিউবে বসানো হবে দুটি স্কেল। এর উপর দিয়ে দুই লেনে গাড়ি চলাচল করবে’।

যথাসময়ে কাজ শেষ হওয়া প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, আমাদের যেহেতু নদীর তলদেশে কাজ করতে হচ্ছে, সবকিছু ঠিকটাক থাকলে এবং কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে নির্ধারিত সময়ে অর্থাৎ ২০২২ সালের ডিসেম্বরে টানেলের কাজ শেষ হবে বলে আশা করছি।

বঙ্গবন্ধু টানেল সূত্র জানায়, চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন এন্ড কন্সট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) টানেল নির্মাণের কাজ পায়। ৩ দশমিক ৩১৫ কিলোমিটার মূল টানেলের সাথে আনোয়ারা অংশে ৫ দশমিক ৫২৭ কি.মি এবং নেভাল অংশে দশমিক ৫৫ কি.মি সংযোগ সড়ক থাকবে। নগরীর নেভাল একাডেমি পয়েন্ট দিয়ে তলদেশে ঢুকে আনোয়ারা অংশের কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি (কাফকো) এবং চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) মাঝামাঝি স্থান দিয়ে বের হবে। নদীর তলদেশে এর গভীরতা হবে ১৮ থেকে ৩১ মিটার।

চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি) এবং হংকংভিত্তিক প্রতিষ্ঠান অভি অরূপ এন্ড পার্টনারস হংকং লিমিটেড যৌথভাবে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি প্রতিবেদন জমা দেয় ২০১৩ সালের এপ্রিলে। এর উপর ভিত্তি করে চীন ও বাংলাদেশের যৌথ অর্থায়নে সিসিসিসি টানেলের নির্মাণকাজ শুরু করেছে। সেই সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা আছে, কর্ণফুলী টানেল চালুর প্রথম বছর ৬৩ লাখ গাড়ি টানেলের নিচ দিয়ে চলাচল করবে। একসময় এই পরিমাণ এক কোটি ৪০ লাখে গিয়ে ঠেকবে। চালুর প্রথম বছরে চলাচলকারী গাড়ির প্রায় ৫১ শতাংশ হবে কনটেইনার পরিবহনকারী ট্রেইলর ও বিভিন্ন ধরনের ট্রাক ও ভ্যান। বাকি ৪৯ শতাংশের মধ্যে ১৩ লাখ বাস ও মিনিবাস, আর ১২ লাখ কার, জিপ ও বিভিন্ন ছোট গাড়ি।