নাসির উদ্দিন ছিলেন ‘সুঁই সুতার লক্ষ্মী’

নাসির উদ্দিন ছিলেন ‘সুঁই সুতার লক্ষ্মী’
নাসির উদ্দিন ছিলেন ‘সুঁই সুতার লক্ষ্মী’

পোস্টকার্ড ডেস্ক।। 

তাকে বলা হতো ‘সুঁই সুতার লক্ষ্মী’। বলা হতো গার্মেন্টস খাতের আইকনও। যেখানে হাত দিতেন সেখানেই সোনা ফলাতেন তিনি। সততা, নিষ্ঠা ও কমিটমেন্ট- এই তিন মন্ত্রে বাংলাদেশকে নিয়ে গেছেন তিনি বিশ্বদরবারে। আন্তর্জাতিক মানের জিন্স রপ্তানি করে দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনা সেই মো. নাসির উদ্দিন আর নেই। সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে তিনি আজ চলে গেলেন চিরতরে। রেখে গেলেন একাত্তর বছর বয়সী বর্ণাঢ্য এক কর্মময় জীবন।

প্যাসিফিক জিন্স লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। তার গড়া এই কারখানা এখন চট্টগ্রাম ইপিজেডের সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান। তাদের ছয়টি কারখানায় কর্মসংস্থান হয়েছে ৩২ হাজার মানুষের। দেশের ছয় শতাধিক কারখানার মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক ইয়াংওয়ান গ্রুপের পরেই এখন প্যাসিফিকের অবস্থান। ইউরোপ, আমেরিকা, জাপানসহ ৫০টির বেশি দেশে এককভাবে ৪৫ মিলিয়ন পিস জিন্স প্যান্ট রপ্তানি করেছে প্যাসিফিক জিন্স লিমিটেড। বাংলাদেশ থেকে বর্তমানে জিন্সের মোট রপ্তানি মূল্যের ১০ শতাংশের বেশি করছে প্যাসিফিক জিন্স।

চট্টগ্রামে ১৯৮৪ সালে মাত্র ২০০ শ্রমিকের ছোট্ট একটি কারখানা দিয়ে যাত্রা শুরু করেন তিনি। নাম ছিল এনজেডএন ফ্যাশন। এক দশক পর চট্টগ্রাম ইপিজেডে প্যাসিফিক জিন্স নামে এটি নতুন রূপে পথচলা শুরু করে ১৯৯৪ সালে। তখন শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় দেড় হাজার। কিন্তু এখন প্যাসিফিক জিন্স লিমিটেডে প্রত্যক্ষভাবে কর্মসংস্থান হয়েছে ৩২ হাজার মানুষের। গার্মেন্টেসের বাইরে বিশ্ববিখ্যাত ম্যারিয়ট হোটেল চেইনের সঙ্গে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এলাকায় পাঁচ তারকা মানের একটি হোটেল নির্মাণ করছে প্যাসিফিক জিন্স।

প্যাসিফিক জিন্সকে বিন্দু থেকে সিন্ধুতে রূপান্তর করেছেন সীতাকুণ্ডের বাসিন্দা নাসির উদ্দিন। এখন এ ব্যবসা আরও সম্প্রসারণ করছেন তার সন্তানরা। দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধি হয়ে তার তিন সন্তান যথাক্রমে- সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর, সৈয়দ মোহাম্মদ তানসীর, সৈয়দ মোহাম্মদ তাহমীর যুক্ত আছেন পারিবারিক ব্যবসার সঙ্গে।

জাতীয় রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২৪ বার রপ্তানি ট্রফি পেয়েছে প্যাসিফিক জিন্স লিমিটেড। এর মধ্যে ১০ স্বর্ণ পদক, ১০ রৌপ্য পদক ও ৪টি ব্রোঞ্জ। এই গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জাতীয় রপ্তানিতে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে টানা আটবার জিতেছে স্বর্ণপদক। ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে তারা একসঙ্গে পেয়েছে তিনটি পদক। সেবার প্রথমবারের মতো ইপিজেড ক্যাটাগরিতে স্বর্ণ, রোপ্য এবং ব্রোঞ্জ-তিনটি পদকই পেয়েছে জিন্স রপ্তানিতে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এই কোম্পানিটি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের হাতে তুলে দেন রপ্তানি ট্রফি।

যে স্বপ্ন দেখে যেতে পারলেন নাঃ

তিন বছরে নতুন আরও ১৮ হাজার লোকের কর্মসংস্থান করার স্বপ্ন দেখেছিলেন নাসির উদ্দিন। প্যাসেফিক জিন্সের বিভিন্ন কারখানায় এখন কাজ করছে প্রায় ৩২ হাজার শ্রমিক। আগামী তিন বছরে এ সংখ্যা ৫০ হাজারে উন্নীত করতে চেয়েছেন তিনি। এ জন্য ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে প্যাসেফিক নিটেক্স নামে সম্প্রতি নতুন আরেকটি কারখানা চালু করেছেন তিনি। ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছিলেন সুরক্ষা পোশাক তৈরিতেও। ২৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ইপিজেডের মধ্যেই নতুন আরেকটি নিট ও ওভেন পোশাক তৈরির কারখানা করতে যাচ্ছে এ প্রতিষ্ঠান। এটি পুরোদমে চালু করে আগামী তিন বছরে নতুন করে আরও অন্তত ১৮ হাজার লোকের কর্মসংস্থান করার ইচ্ছা ছিল তার। ২০২৩ সালের শুরুতে সাড়ে তিনশ’ কোটি বিনিয়োগ করা পাঁচ তারকা মানের নতুন আবাসিক হোটেলও চালু করার স্বপ্ন ছিল তার। কিন্তু এ স্বপ্নের শুরু হলেও শেষটা আর দেখে যেতে পারলেন না নাসির উদ্দিন।

বাংলাদেশকে বিশ্বের শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে দেখার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। নিজেদেরও নিতে চেয়েছিলেন গার্মেন্ট খাতের শীর্ষ স্থানে। চীনকে সরিয়ে লাল সবুজের বাংলাদেশ যাতে সর্বোচ্চ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হতে পারে সেই স্বপ্নই দেখেছিলেন নাসির উদ্দিন।

বাবার স্মৃতিচারণ করে সৈয়দ তানবীর বলেন, ‘আমার বাবা পোশাক শিল্পে যাত্রা শুরু করেন ১৯৮৪ সালে। কিন্তু ওনার ব্যবসায়ী জীবন শুরু ৬০ এর দশক থেকে। বাবার কঠোর পরিশ্রম, দৃঢ় মনোবল, একাগ্রতা এবং দূরদর্শিতা- আমাদের সফলতার মূল কারণ। বাংলাদেশে আজকে পোশাকশিল্পের যে অবস্থান তিনি তা আশির দশকেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। সেই অনুযায়ী তিনি কর্মপরিকল্পনা সাজিয়েছেন। তৈরি করেছেন প্রতিষ্ঠানকে। প্রস্তুত করেছিলেন আমাদেরও।’ -সমকাল

খালেদ / পোস্টকার্ড ;