কক্সবাজারের রামুর দুর্গম ব্যাঙডেবা গ্রামে ৭৩ বছর পর গেলেন কোনো ইউএনও

কক্সবাজারের রামুর দুর্গম ব্যাঙডেবা গ্রামে ৭৩ বছর পর গেলেন কোনো ইউএনও

সুনীল বড়ুয়া, রামু।।

প্রায় ১৯৪৭ সালে কক্সবাজারের রামুর দুর্গম ব্যাঙডেবা গ্রামে জনবসতি শুরু হয় । বসতি গড়ে ওঠার ৭৩ বছর পেরোলেও অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এখনো মৌলিক অধিকার বঞ্চিত এই গ্রামের মানুষ। এমনকি জনবসতির শুরু থেকে এতদিন কোনো উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) পা পড়েনি এই এলাকায়। অথচ এই গ্রামে বসবাস করে ৮০টি পরিবার।

সম্প্রতি করোনা পরিস্থিতিতে খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ায় সেই দুর্গমতা ভেদ করেন রামু উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) প্রণয় চাকমা।

স্থানীয় চেয়ারম্যানসহ সকল গ্রামবাসীর জন্য খাদ্যসামগ্রী নিয়ে ব্যাঙডেবায় ছুটে যান তিনি। প্রথমবারের মতো কোনো উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে দেখে এবং ত্রাণ পেয়ে অনেক খুশি গ্রামবাসী।

পাড়ার হেডম্যান আলী আহম্মদ বলেন, ‘১৯৪৭ সালে এই গ্রামে প্রথম বসতি শুরু হয়। সেই থেকে বাড়তে বাড়তে বর্তমানে ৮০টি পরিবার এখানে বসবাস করে কিন্তু গ্রামটিতে শুধু একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়া আর কিছুই নেই। শুধু অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে গ্রামটি এখনো সেই অন্ধকারেই পড়ে আছে।‘

তিনি বলেন, ‘গ্রামটিতে আসার পরিকল্পিত কোনো রাস্তা নেই এবং দুর্গম এলাকা হওয়ার কারণে ৭৩ বছরেও কোনো ইউএনও এই গ্রামে আসেননি। করোনা পরিস্থিতির কারণে এই প্রথমবার একজন ইউএনও ব্যাঙডেবায় আসলেন এবং আমাদের সবার জন্য খাদ্যসামগ্রী নিয়ে। আমরা ভীষন খুশি।’

ব্যাঙডেবা গ্রামের চারদিকেই গহীন বন। বনের মাঝখানে ছোট্ট গ্রাম ব্যাঙডেবা যার আয়তন প্রায় ৮০ একর। যেখানে হাতির ভয়ে টংঘরে থাকেন অনেক মানুষ।

 

জানা গেছে, রামু উপজেলা সদর থেকে ৪২ কিলোমিটার দূরে ঈদগড় ইউনিয়নের করলিয়া মুরা এলাকা থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টা পায়ে হেঁটে এবং পাহাড়-ঝিরি পেরিয়ে যেতে হয় এই ব্যাঙডেবায়। অবাক করা বিষয় হলো এ গ্রামের নিজস্ব কারো এক ইঞ্চি জমিও নেই। বন বিভাগের জমিতেই এই ৮০টি পরিবারের বসবাস এবং সেখানকার পতিত জমি চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন গ্রামের ছয়শতাধিক নারী-পুরুষ। বিনিময়ে গ্রামবাসী পালা করে বন পাহারা দেন।

ব্যাঙডেবার বাসিন্দা ও কলেজ ছাত্র আল আমিন বলেন, ‘এখানকার প্রধান সমস্যা যাতায়াত। একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও বিদ্যালয়টি শিক্ষক সংকটসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত। এছাড়াও গ্রামে কোনো হাইস্কুল না থাকায় দেড় ঘণ্টা পায়ে হেঁটে প্রায় ছয়শ’ ফুট উচুঁ পাহাড় পেরিয়ে ঈদগড় যেতে হয়। আবার আসতে হয়ও একইভাবে।’

এখানে কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। এক কথায় দেশ এখন ডিজিটাল হতে চললেও এই ব্যাঙডেবায় এখনও ভালোভাবে সভ্যতার আলো পৌঁছেনি। এখনো মৌলিক অধিকার বঞ্চিত এই গ্রামের মানুষ।

কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং জোয়ারিয়ানালার বাসিন্দা সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘গ্রামটিতে না এলে বুঝতে পারতাম না এখানকার মানুষ কতটা সমস্যায় আছেন। তাই ভাবছি, আমার নিজ উদ্যোগে ব্যাঙডেবা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি লাইব্রেরি করে দিব।’

স্থানীয় জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল শামসুদ্দিন আহমেদ প্রিন্স বলেন, ‘শুধু গ্রামটির অবস্থান দুর্গম এলাকায় হওয়াতে এখনো অবহেলিত এ গ্রামের মানুষ। সম্প্রতি করোনা পরিস্থিতিতে এই গ্রামের মানুষ খাদ্য সংকটে পড়েছে বিষয়টি শুনেই আমি ইউএনও মহোদয়কে অবহিত করি। তিনি নিজেই ব্যঙডেবায় আসার সন্মতি দেন। তাই গ্রামবাসীর জন্য কিছু খাদ্যসামগ্রী নিয়ে আসি।’

চেয়ারম্যান প্রিন্স আরও বলেন, ‘৭৩ বছর পর এই প্রথমবার কোনো উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এই গ্রামে এলেন তাও আবার দেড় ঘণ্টা পায়ে হেঁটে অনেক উঁচু-নীচু পাহাড় এবং দুর্গম পথ মাড়িয়ে। এসেই তিনি স্বচক্ষে সবকিছু দেখলেন। এতে গ্রামবাসীও ভীষণ খুশি। এইজন্য আমি ইউএনও মহোদয়ের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই।’

রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রণয় চাকমা বলেন, ‘আমি শুনেছি জায়গাটি খুবই দুর্গম, দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে এখানে আসতে হয়। তবুও চেয়ারম্যান সবকিছু জানানোর পরও বলেছি, আমি নিজেই ব্যাঙডেবায় যাব। এসেই দেখলাম এই গ্রামের মানুষের অনেক সমস্যা। একটি মাত্র প্রাইমারি স্কুল আছে। সেখানেও নাই নাই অবস্থা। এখানে কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই, যাতায়াতের রাস্তা নেই। সবকিছুই আজ অবগত হলাম। এই গ্রামের সামগ্রিক অবস্থার কীভাবে উন্নয়ন ঘটানো যায় সেই বিষয়টি আমি অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে দেখবো। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে এখানকার কোনো মানুষ যেন খাদ্য সংকটে না পড়ে সেই বিসয়টিও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হবে।’

খাদ্যসামগ্রী কাঁধে নিয়ে ছুটলেন ৩০ স্বেচ্ছাসেবক

ব্যাঙডেবার ৮০টি পরিবারের জন্য খাদ্যসামগ্রীর পরিমাণও প্রায় ৩০ বস্তার চেয়ে বেশি। তাই খবর পেয়ে আগে থেকেই ঈদগড় করলিয়ামুরা নামক স্থানে চলে আসেন ব্যাঙডেবার প্রায় ৩০ জন স্বেচ্ছাসেবক। এসব খাদ্যসামগ্রী কাঁধে করে দেড় ঘণ্টা পায়ে হেঁটে তারাই নিয়ে যান ব্যাঙডেবা গ্রামে। পরে এসব খাদ্যসামগ্রী গ্রামবাসীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। পবিত্র রমজান মাস শুরুর আগের দিন খাদ্য সহায়তা পেয়ে ভীষণ খুশি গ্রামের সহজ-সরল মানুষ।

এ সময় অন্যান্যদের মধ্যে কক্সবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমলের একান্ত সচিব মিজানুর রহমান, স্থানীয় ইউপি সদস্য জসীমুল করিমসহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন।