কেউ কখনো দেউলিয়া হয় না বই কিনে

কেউ কখনো দেউলিয়া হয় না বই কিনে

জিয়া উল ইসলাম ।।

আমাদের বর্তমান বিশ্বে টিকে থাকতে হলে জ্ঞানার্জনের কোনো বিকল্প নেই। আর জ্ঞানার্জনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হলো বই পড়া। যতই পড়বে ততই শিখবে— শিখতে হলে অবশ্যই পড়তে হবে।

কারণ জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট, আর মানুষের মুক্তি সেখানে অসম্ভব। বই জ্ঞানের আধার, চির যৌবনা, চির অমলিন আনন্দের উৎস। পারস্য কবি ওমর খৈয়ম স্বর্গে নিয়ে যাওয়ার যে উপকরণ তালিকা প্রস্তুত করে ছিলেন, সে তালিকায় বই ছিলো অন্যতম।

 

এদিকে দার্শনিক টলস্টয় বলেছেন, জীবনে তিনটি বস্তুই বিশেষভাবে প্রয়োজন তা হচ্ছে বই, বই এবং বই। ‘রাজা স্বদেশে পূজিত বিদ্বান পূজিত সর্বত্র’ এ বাক্যটি চিরসত্য। বই কিনতে গিয়ে বাঙালি যখনই অপচয়জনিত হেজিটেশনের সামনে পড়ে, আর তখনই মনে করিয়ে দেন সৈয়দ মুজতবা আলী আর তার সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘বই কিনে কেউ কখনো দেউলিয়া হয় না’।

৩২টি বই সাজিয়ে গোড়াপত্তন: একুশে বইমেলার
প্র য়াত কথাসাহিত্যিক জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক ছিলেন সরদার জয়েনউদদীন। তিনি বাংলা একাডেমিতেও একসময় চাকরি করেছেন। বাংলা একাডেমি থেকে ষাটের দশকের প্রথম দিকে তিনি গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক পদে নিয়োগ পান। এসময় শিশু গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন ততকালীন কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি) নিচতলায়।

সম্ভবত, এটাই ছিলো বাংলাদেশের প্রথম বইমেলা। এটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬৫ সালে। এরপরে ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহযোগিতায় নারায়ণগঞ্জে একটি গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন তিনি। এই মেলায় সরদার জয়েন উদদীন একটি মজার কাণ্ড করেছিলেন। মেলার ভেতরে একটি গরু বেঁধে তার গায়ে লিখে রাখা হয়েছিল ‘আমি বই পড়ি না’।

মানুষকে গ্রন্থপাঠে আগ্রহী করে তুলতেই সরদার জয়েন উদদীনের এই অভিনব প্রয়াস ছিলো তাতে সন্দেহ নেই। এরপর তিনি যখন গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক, তখন ইউনেসকো ওই বছরকে অর্থাৎ ১৯৭২ সালকে ‘আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করে।

গ্রন্থমেলায় আগ্রহী সরদার সাহেব এই আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ উপলক্ষে ১৯৭২ সালে ডিসেম্বর মাসে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। সেই থেকেই বাংলা একাডেমিতে বইমেলার সূচনা।

এদিকে, ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণে বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন।

এই ৩২টি বই ছিলো চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা বই। বইগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রথম অবদান।

১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে মেলার সাথে সস্পৃক্ত করেন। ১৯৭৯ সালে মেলার সাথে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। এই সংস্থাটিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা।

১৯৮৩ সালে কাজী মনজুরে মওলা যখন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, তখন তিনি বাংলা একাডেমির আয়োজনে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র আয়োজন সম্পন্ন করেন। কিন্তু তখনকার সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষা ভবনের সামনে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিল হয় এবং এতে দুইজন ছাত্র নিহত হয়।

ওই মর্মান্তিক ঘটনার পর সেই বছর আর বইমেলা করা সম্ভব হয়নি। ১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে বর্তমানের অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখ বাংলা ভাষার জন্য আত্মোত্যাগের যে ঘটনা ঘটে, সেই স্মৃতিকে অম্লান রাখতেই এই মাসে আয়োজিত বইমেলার নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’।

মেলা উপলক্ষে বিপুল বই প্রকাশিত হয়। বলা চলে এই মেলা উপলক্ষ করেই বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। এখন অনেক নতুন প্রকাশক এই শিল্পে এসেছেন। পাঠকেরা সংখ্যাও প্রতিবছর বাড়ছে। এই মেলা এক মাস ধরে চলে।

পৃথিবীতে আর কোনো বইমেলাই এত দিন ধরে চলে না। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি দিন ধরে চলা বইমেলা। বইমেলার পরিসর বাড়িয়ে এর একটি বড় অংশকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এর ফলে অমর একুশের স্মৃতিবাহী এই মেলাটির ঐতিহ্যের বিস্তার ঘটে।

অব্যবসায়িক কলকাতা বইমেলা
ফ্রা ঙ্কফুর্ট এবং লন্ডন বইমেলার পরের স্থানটি কলকাতা বইমেলার। সে হিসাবে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বইমেলা এটি। মেলা শুরু হয় ১৯৭৬ সাল থেকে। মেলা অনুষ্ঠিত হয় জানুয়ারির শেষ বুধবার থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম রোববার পর্যন্ত। সব মিলিয়ে মেলার মেয়াদ ১২ দিন।

তবে মেলা আয়োজনের প্রথম দিকে এর মেয়াদ ছিলো সাতদিন। জনপ্রিয়তার কারণে পরে মেলার মেয়াদ বাড়ানো হয়। বইমেলা ছাড়া কলকাতাকে কল্পনা করতে পারে না কলকাতাবাসী। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, মেলায় প্রতিবছর গড়ে প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষের সমাগম হয়।

সবদিক বিবেচনায় ২০০৫ সালে মেলার মেয়াদ সাতদিন থেকে বাড়িয়ে ১২দিন করা হয়। ফ্রাঙ্কফুর্ট এবং লন্ডন এ দুটি বইমেলার সঙ্গে কলকাতার বইমেলার পার্থক্য হল— এখানে পাঠকদের গুরুত্ব দেয়া হয় সবচেয়ে বেশি। বই ব্যবসা এ মেলার মূল উদ্দেশ্য নয়।

সেদিক থেকে কলকাতা বইমেলাকে বলা যায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় অব্যবসায়িক বইমেলা। কলকাতা বইমেলার অফিসিয়াল নাম কলকাতা বইমেলা বা কলকাতা পুস্তুকমেলা।

আরবের প্রাচীন বইমেলা
আরব বিশ্বের প্রাচীন বই মেলা এটি। মিসরীয় বুক অর্গনাইজেশন এ মেলার আয়োজক। এটি শুরু হয় ১৯৬৯ সালে। শিশু সাহিত্যে আগগ্রী লেখক ও প্রকাশক তৈরি এ মেলার অন্যতম উদ্দেশ্য।

রান্নার বইমেলা

প্যারিসে রান্না বিষয়ক বইমেলা হয়ে থাকে । রান্না বিষয়ক বইয়ের এই মেলাটিও বেশ জনপ্রিয়। ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, জার্মানি, ইতালি, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকা, আর্জেন্টিনা, চিলি, মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও চীনসহ বিভিন্ন দেশ এ মেলায় অংশ নিয়ে থাকে।

গুয়াডালাজারা বইমেলা
স্পেনের গুয়াডালাজারা আন্তর্জাতিক বইমেলাকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বইমেলা হিসেবে দাবি করা হয়। স্পেনিশ ভাষায় এ মেলাকে বলা হয় ‘ ফেরিয়া ইন্টারন্যাশনাল ডেল লিবরো দে গুয়াডালাজারা’।

এই মেলাটিও প্রকাশক, লেখক ও পরিবেশকদের প্রাধান্য দেয়া হয়। এ ছাড়া লেখকদের সঙ্গে পাঠকদের দেখা করবার জন্যও এই মেলা খুব উপযুক্ত একটি ক্ষেত্র হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। প্রতি বছরের নভেম্বরে নয়দিন ধরে চলে এ বইমেলা। যা ১৯৮৭ সাল থেকে শুরু হয়েছে।

শুধু প্রকাশকদের বইমেলা
প্র কাশনার দিক থেকে লন্ডন বইমেলা বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইমেলার অন্যতম। তবে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার মতো বড় না হলেও এ মেলার গুরুত্ব অনেক। সাধারণত বছরের মার্চ মাসে এ মেলার আয়োজন করা হয়।

তবে কখনো কখনো অক্টোবরেও মেলার তারিখ পরিবর্তন হয়, সেই সঙ্গে পাল্টে যায় মেলার স্থানও। যেমন ২০০৬ সালে মেলাটি হয়েছিল লন্ডনের অলিম্পিয়া এক্সিবিশন সেন্টারে আবার পরের বছর হয় ডকল্যান্ডের আর্ল কোট এক্সিবিশন সেন্টারে। আয়তনে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার সমান না হলেও নিজের গুরুত্ব ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠা করেছে লন্ডন বইমেলা।

গত বছর এ মেলায় বিশ্বের প্রায় একশরও বেশি দেশ থেকে ২৩ হাজার প্রকাশক, বই বিক্রেতা, সাহিত্য প্রতিনিধি, লাইব্রেরিয়ান, সংবাদমাধ্যম কর্মী অংশ নিয়েছিল। প্রকাশিতব্য বইয়ের প্রচারের জন্য, অন্য প্রকাশক থেকে বইয়ের স্বত্ব অথবা বইয়ের অনুবাদ স্বত্ব কেনা- বেচার জন্য প্রকাশকরা এ মেলায় অংশ নেয়। ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলার সঙ্গে এ মেলার বড় পার্থক্য হলো— এটি প্রকৃত অর্থে প্রকাশকদের মেলা।

সবচেয়ে পুরনো ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা
পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো ফ্র্রাঙ্কফুর্টের বইমেলা। শুরু হয়েছিল পঞ্চদশ শতকে। মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কারক ইয়োহানেস গুটেনবার্গ থাকতেন ফ্রাঙ্কফুর্টের সামান্য দূরের মেঞ্জ শহরে। তার আবিষ্কৃত ছাপাখানার যন্ত্র বইয়ের জগতে নিয়ে আসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।

তিনি নিজের ছাপাখানার যন্ত্রাংশ এবং ছাপানো বই বিক্রির জন্য ফ্রাঙ্কফুর্টে আসেন। গুটেনবার্গের দেখাদেখি ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরের স্থানীয় কিছু বই বিক্রেতাও তাদের প্রকাশিত বই নিয়ে বসতে থাকে। আর এগুলো কিনতে বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষও আসতে শুরু করে।

সেই আসা-যাওয়া থেকেই জমে উঠতে থাকে ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলা। বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলা তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে শুরু করে। ১৯৪৯ সালে এ মেলাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয় জার্মান প্রকাশক সমিতি।

আর ১৯৬৪ সাল থেকে এ মেলার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলে। বছরের অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে মেলা শুরু হয়। মেলার সময়কাল পাঁচ দিন। মেলার আয়োজক জার্মান পাবলিশার অ্যান্ড বুক সেলার অ্যাসোসিয়েশন। প্রতি বছরই বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে হাজার হাজার প্রকাশক, বিক্রেতা, লেখক, পাঠক, দর্শক ও সাংবাদিকের অংশগ্রহণে মুখরিত হয়ে ওঠে মেলা।