এবার শুদ্ধি অভিযান শুরু হতে যাচ্ছে প্রশাসনে

রফিকুল ইসলাম সবুজ , সময়ের আলো ।।

এবার শুদ্ধি অভিযান শুরু হতে যাচ্ছে প্রশাসনে
এবার শুদ্ধি অভিযান শুরু হতে যাচ্ছে প্রশাসনে
এবার শুদ্ধি অভিযান শুরু হতে যাচ্ছে প্রশাসনেও। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ক্ষমতাসীন দলের নেতারা গ্রেফতার হলেও এর সঙ্গে জড়িত সরকারি কর্মকর্তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন বলে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ ওঠার পর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই শুদ্ধি অভিযান আরও বিস্তৃত হবে।
 
টেন্ডারবাজি ও জুয়ার পর শুদ্ধি অভিযান চলবে জনপ্রশাসনেও, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

সরকারের যেসব প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে, বারবার প্রকল্প ব্যয় বাড়লেও কাজের অগ্রগতি হয়নি, কাজের উদ্বোধনের পরপরই যা নষ্ট হয়েছে গেছে এসব দুর্নীতির সঙ্গে সরকারের যেসব কর্মকর্তারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হবে। এরই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার নানা অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় গণপূর্ত অধিদফতরের ঢাকা মেট্রোপলিটন জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী উৎপল কুমার দে কে ওএসডি করার পর বুধবার তার ব্যাংক হিসাব তলব করেছে এনবিআর। এ ছাড়া দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সচিব ড. মো. খালেদকে বুধবার ওএসডি করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, কর্মকর্তাদের নানা দুর্নীতি ও নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধের কারণে প্রশাসনেই অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। প্রশাসনের দুর্নীতির কারণে সরকারের নানা অর্জন ম্লান হয়ে যাচ্ছে এবং যথাসময়ে সরকারের কাজ শেষ না হওয়ায় জনগণের সুফলের বদলে দুর্ভোগ বাড়ছে। সরকারের টাকাও নষ্ট হচ্ছে। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় প্রত্যেক মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান জোরদার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে ছাত্রলীগের শোভন-রাব্বানীকে সরিয়ে দেওয়ার পর ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবে অভিযান চলছে। অ্যাকশন নেওয়া হচ্ছে ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর অবৈধ জুয়া ও ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে ঢাকা দক্ষিণের যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। পাশাপাশি তার মালিকানাধীন রাজধানীর ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স ক্লাবে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থসহ ১৪২ জনকে আটক করেন র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। শুক্রবার রাজধানীর কলাবাগান ক্রীড়াচক্র ক্লাবে অভিযান চালিয়ে এর সভাপতি ও বাংলাদেশ কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শফিকুল আলম ফিরোজসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। একই দিন রাজধানীর গুলশানের নিকেতনের অফিসে অভিযান চালিয়ে জিকেবি অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেডের মালিক এসএম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জিকে শামীমকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। অভিযানে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া ১৬৫ কোটি টাকার ওপরে এফডিআর (স্থায়ী আমানত) পাওয়া যায়। জিকে শামীম সচিবালয়, র‌্যাব হেডকোয়ার্টার, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতালসহ বড় বড় ১৭ প্রকল্পের প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ করছেন। অভিযোগ উঠেছে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করে এসব কাজ বাগিয়েছেন শামীম। শামীমের টেন্ডারবাজির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে গণপূর্ত অধিদফতরের সাবেক এক প্রধান ও এক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে। এ ছাড়া অধিদফতরের বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী মো. সাহাদাৎ হোসেনসহ কয়েক জন তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলী ও নির্বাহী প্রকৌশলীর সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে জিকে শামীম সরকারের বিভিন্ন কাজের টেন্ডার পেয়েছেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। অভিযুক্তদের খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এটা নিয়ে তো আলাপ-আলোচনা হচ্ছে, ভাবা হচ্ছে। আমাদের তো নির্বাহী ইশতেহার রয়েছে- আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। সে হিসেবেই আমরা ব্যাপারটি দেখছি। একটা সময় নেওয়া হয়েছে, আমরা সবই দেখব ইনশাআল্লাহ।’

শুদ্ধি অভিযান কী প্রশাসনেও আসছেÑ জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, অবশ্যই, আমরা খুব শক্তভাবে এটা করব। দুর্নীতি একটা সমস্যা। এটা কারা করছে, কীভাবে করছে। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছেন। প্রত্যেকটি সেক্টরকে ধরা হবে, সেটা ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে। সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স, সেজন্য কার্যকরী ভ‚মিকা নেওয়া ইতোমধ্যে শুরু করেছে, যেটা দৃশ্যমান হয়েছে। এটা আরও ব্যাপকভাবে দেখা যাবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান নিজের ঘর থেকেই শুরু হয়েছে, এটা মহত্তে¡র পরিচয়। প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রশাসনের অনেকে মনে করতে পারেন, যা করছেন কেউ হয়তো দেখছে না। এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।’

প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, পুলিশ প্রশাসনের যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেবে সরকার। বিভিন্ন ক্লাবে অভিযানের সময় বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের যেসব নেতাদের ক্যাসিনোর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ এসেছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সঙ্গে অবৈধ ক্যাসিনোর সঙ্গে পুলিশ ও প্রশাসনের যেসব কর্মকর্তা জড়িত রয়েছে তাদেরও চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া সম্প্রতি সময়ে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নারী কেলেঙ্কারির বিষয়টিও জোরেশোরে আলোচিত হচ্ছে। অনেকের বিরুদ্ধেই নৈতিক স্খলনের অভিযোগ উঠছে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির চোখে পড়ছে না। এ অবস্থায় কেউ কেউ বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। গত আগস্ট মাসের শেষদিকে জামালপুরের ডিসি আহমেদ কবীরের আপত্তিকর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ভিডিওটিতে আহমেদ কবীরের সঙ্গে তার অফিসের এক নারীকর্মীকে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখা যায়। ওই ঘটনায় জামালপুরসহ সারা দেশের মানুষের মাঝে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। তোলপাড় চলে প্রশাসনে। এ ঘটনা পুরো প্রশাসনকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। পরে প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে আহমেদ কবীরকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তদন্ত কমিটি কবীরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে ইতোমধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এর আগে বিয়ে না করে বান্ধবীকে নিয়ে একসঙ্গে থাকার অভিযোগ ওঠে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আসিফ ইমতিয়াজের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিয়েছে প্রশাসন।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, দুর্নীতিবাজরাই শুদ্ধি অভিযানের মূল টার্গেট। শুধু ঢাকাতেই নয়, সারা দেশে এ অভিযান চলবে। অপরাধী যত বড় আর ছোটই হউক না কেন কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তিনি বলেন, লোক দেখানো নয়, সত্যিকার অর্থে দুর্নীতি-মাদক-জুয়ার বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে সরকার, সহনশীল না হওয়া পর্যন্ত এ অভিযান চলবে।