'বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতা' এক ছাদের নীচে থাকা একই আদর্শের অভিন্ন বাতিঘর

'বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতা' এক ছাদের নীচে থাকা একই আদর্শের অভিন্ন বাতিঘর
বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতা এক ছাদের নীচে থাকা একই আদর্শের অভিন্ন বাতিঘর

অধ্যাপক মালেকা আক্তার চৌধুরী ।।

পৃথিবীতে নারী পুরুষের দাম্পত্য সম্পর্ক রহস্যপূর্ণ ।  নারী পুরুষের মিথষ্ক্রিয় দাম্পত্য জীবনের রসায়ন বড়ো কৌতুহলোদ্দীপক এবং বিচিত্র মনস্তাত্বিক জাল জটিলতায় পরিপূর্ণ ।

সেই রহস্যপূর্ণ দাম্পত্য সম্পর্কের মাঝে বেগম মুজিব যার পারিবারিক নাম বেগম ফজিলাতুন নেছা এবং বঙ্গবন্ধু যিনি হাজার বছরের শ‌্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান দুজনই যেনো ছিলেন একই বৃন্তে দুটি সুরভিত প‌্রস্ফুটিত ফুলের মতো । সে ফুলের নামের ভিন্নতা থাকতে পারে কিন্ত সৌরভে , মাহাত্ম্যে , মহত্বে , সৌন্দর্যে , গুরুত্বে স্বমহিমায় সমাসীন ।

বাংলার জল রং মেঘ রং প‌্রকৃতি রংয়ের মাধুর্যে যেনো দুজনেই ছিলেন হংস মিথুন । ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট বেগম ফজিলাতুন নেছা গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় একই বাড়িতে জন্মেছিলেন বঙ্গবন্ধুর আজন্ম ছায়াসঙ্গী হয়ে । একজন আদর্শ জায়া হিসেবে, আদর্শ সংগঠক হিসেবে নিভৃত শক্তি আর সৌম্য শান্ত সুরক্ষিত প‌্রেরণার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে তিনি এনে দিয়েছিলেন জাতীয় জীবনে  হিমালয়সম উচ্চতা , এনে দিয়েছিলেন আত্মপরিচয়ের অহংকার । 

অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখছেন , আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বার তের বছর হতে পারে । রেণুর বাবা মারা যাবার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন , তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এক নাতনীর বিবাহ দিতে হবে । কারণ আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাব । বঙ্গবন্ধু বলছেন , রেণুর বয়স তখন বোধ হয় তিন বছর হবে ।  রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার মা মারা যান । দাদাও রেণুর সাত বছর বয়সে মারা যান । তারপর সে আমার মার কাছে চলে আসে । আমার ভাইবোনদের সাথেই রেণু বড় হয় (পৃ:৭-৮ ) ।

বঙ্গবন্ধু তার স্বভাবসুলভ স্বতঃস্ফূর্ততা ব্যক্ত করেই রেণুর প‌্রতি গভীর ভালোবাসা - মমত্ববোধসহ পূর্ণ মর্যাদা প‌্রদর্শন করেছেন । একই পরিবারে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা বেড়ে ওঠার সুবাদে একই আদর্শের চিন্তা ও কর্মের দীক্ষা নিয়ে প‌্রকৃতির মতোই উদার মানবিক মননশীতায় জীবনের উত্তাল পথ পাড়ি দিয়েছিলেন দুজনেই ।  

বঙ্গবন্ধুর জীবনে তার দেবসম পিতা আর মহীয়সী নারী বেগম মুজিবের অবদান অনস্বীকার্য ।  বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী আর কারাগারের রোজনামচার প‌্রতিটি পাতার ভাঁজে ভাঁজে অত্যন্ত প‌্রাসঙ্গিক এবং স্বতঃস্ফূর্ততার  মোড়কে হৃদয় গভীরের  আবেগমথিত ভালোবাসার সহজ সাধারণ কথাগুলো অসাধারণ ব্যঞ্জনায় - বাঙ্ময়তায় উঠে এসেছে ।  

বঙ্গবন্ধু নিজের অজান্তেই রেণুকে সঙ্গে নিয়ে , রেণুর ভালোবাসার শক্তিকে সম্পদ করেই দীর্ঘ আন্দোলন সংগ‌্রাম ,  জেল - জুলুম , নিপীড়ন-  নির্যাতনের পথ পাড়ি দিয়েছেন । রেণু যেনো তাঁর উত্তাল সমুদ‌্রে স্বপ্নের বৈতরণীসম এক নির্ভরতার ডিঙ্গি নৌকা ।   দুজন দুজনকে পড়তে পারতেন অত্যন্ত সাবলীল ভাষা ব্যঞ্জনার সুগঠিত ছন্দের গভীরতায় । রেণুর বিচক্ষণতা ভরা বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা বঙ্গবন্ধুকে দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের ঊষর , বন্ধুর , ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ বিপন্ন পথে পথে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে তুলতো । তাই তো অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আমরা দেখি ,  " এক এক করে সকলে যখন আমার কামরা থেকে বিদায় নিল , তখন রেণু কেঁদে ফেললো এবং বলল, তোমার চিঠি পেয়ে আমি বুঝেছিলাম , তুমি কিছু একটা করে ফেলবা । আমি তোমাকে দেখবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম । কাকে বলবো নিয়ে যেতে , আব্বাকে বলতে পারি না লজ্জায় ।  " আরও বললেন , কেন তুমি অনশন করতে গিয়েছিলে ? এদের কী দয়া মায়া আছে ? আমাদের কারও কথাও তোমার মনে ছিলো না ? কিছু একটা হলে কী উপায় হতো? আমি এই দুইটা দুধের বাচ্চা নিয়ে কি করে বাঁচতাম ? হাচিনা , কামালের কী অবস্হা হতো ?  বেগম মুজিব তখনও সচেতনভাবেই বলেছিলেন , আর তুমি মরে গেলে দেশের কাজই বা কিভাবে করতা ?"

বঙ্গবন্ধু রেণুর মনের অবস্হা বুঝতে পেরেছিলেন । তাই তিনি বললেন ," আমি তাকে কিছুই বললাম না । তাকে বলতে দিলাম । কারণ মনের কথা প‌্রকাশ করতে পারলে ব্যথাটা কিছু কমে যায় । রেণু খুব চাপা , আজ যেনো কথার  বাঁধ ভেঙ্গে গেছে । শুধু বললাম , উপায় ছিল না " । পৃ ২০৭ । 

আবাল্য স্বাধীনচেতা খোকা" মধুমতীর প‌্রবাহিত কুলুকুলু ছন্দে জীবনকে দেখেছেন প‌্রখর দূরদৃষ্টি দিয়ে । নিপীড়িত শৃঙ্খলিত জনগণকে রাজনীতির পাঠে , স্বাধীনতার বীজমন্ত্রে উজ্জীবিত করতে ছুটে বেড়িয়েছেন  অবিভক্ত ভারতের  প‌্রত্যন্ত অঞ্চলে - আনাচে - কানাচে । নব পরিণীতা রেণু তখন গোপালগঞ্জের বাড়িতেই তাঁর মায়ের সাথে স্বামীর প‌্রতিক্ষায় অধীর আগ‌্রহে পথপানে তাকিয়ে । বঙ্গবন্ধুর ভাষ্যমতে , রেণু কয়েকদিন আমাকে বেশ সেবা করল । যদিও আমাদের বিবাহ হয়েছে ছোটোবেলায় । ১৯৪২ সালে আমাদের ফুলশয্যা হয় ।" সংগঠন গোছাতে , আন্দোলন - সংগ‌্রাম আর জেল - জুলুম, শত অন্যায়  -  অত্যাচারে পালিয়ে বেড়ানোর বন্ধুর পথ পাড়ি দেয়ার ফাঁকে ফাঁকে গল্পচ্ছলে মনের অবরুদ্ধ আকুতি আর রেণুর প‌্রতি একনিষ্ঠ ভালোবাসার অদৃশ্য মোহময়তা ছড়িয়ে দিতেন নিজের অজান্তেই । রেণু যেনো "পরাগ রেণু" হয়েই তাঁকে সর্বক্ষণ - সর্বক্ষেত্রে সুরভিত করে তুলতেন ।

একবার জেলখানায় ভলিবল খেলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর হাতের কব্জি সরে গিয়েছিলো ; বাড়িতে খবর শুনে বাবা শেখ লুৎফর রহমান , মা সায়েরা খাতুন ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন । বঙ্গবন্ধু লিখলেন , রেণু তখন হাচিনাকে নিয়ে বাড়িতেই থাকে । হাচিনা তখন একটু হাঁটতে শিখেছে ।  রেণুর চিঠি জেলেই পেয়েছিলাম ।কিছু টাকাও আব্বা পাঠিয়েছিলেন । রেণু জানত আমি সিগারেট খাই । টাকা পয়সা নাও থাকতে পারে । টাকার দরকার হলে লিখতে বলেছিল ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী , পৃ ১১৮ ) ।

রেণু বঙ্গবন্ধুর কাছে প‌্রগাঢ় এক ভালোবাসার নাম । বঙ্গবন্ধুর পুরো পারিবারিক জীবন তো বটেই রাজনৈতিক জীবনের মূল চালিকাশক্তি এবং প‌্রজ্জ্বলিত এক বাতিঘর" ছিলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা । চিরায়ত এক আদর্শ বাঙালি নারীর অনুপম প‌্রতিচ্ছবি তিনি ।  স্বামীর অনিশ্চিত জীবনে কান্ডারির ভূমিকায় থেকে দৃঢ়তা ও সাহসের সাথে সামলে নিয়েছেন পরিবার,  সমাজ , সংসার থেকে শুরু করে বাঙালির স্বাধীনতা - মুক্তি সংগ‌্রামের সময়ে অগ‌্রপথিক হয়ে সময়ের নিরিখে সময়োচিত সিদ্ধান্ত তাঁকে ইতিহাসে  অমর করে রেখেছে । তাঁর সততা , চারিত্রিক দৃঢ়তা , সিদ্ধান্ত গ‌্রহণের  বলিষ্ঠতা , মেধা - মননের অসাধারণ সমন্বয়ের ফলশ‌্রুতিতেই বঙ্গবন্ধু চরম রাজনৈতিক অস্হিরতার সময়গুলিতেও সঠিক সিদ্ধান্তটি সঠিকভাবে গ‌্রহণ করতে পেরেছেন । অতি সাধারণ , বিলাসী জীবনে অনভ্যস্ত বেগম মুজিব তাঁর সন্তানদেরকেও শিখিয়েছেন কীভাবে উচ্চ আদর্শ আর সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত থেকে মানুষের জন্য কাজ করে যেতে হয় । প‌্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক  আনোয়ারা সৈয়দ হকের কলাম থেকে জানা যায় , বইটি পড়বার সময় লক্ষ্য করলাম যে , বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে প‌্রায় ৩৬ বার তাঁর স্ত্রী রেণুর কথা উল্লেখ করেছেন এবং কারাগারের রোজনামচায়  উল্লেখ করেছেন প‌্রায় ৭০ বার । এরকম উল্লেখ বইটিকে সৌন্দর্য দিয়েছে বেশি এ কারণে যে , একজন রাজবন্দীর জীবনে , যিনি দেশের জন্য নিজেকে পুরোমাত্রায় উৎসর্গ করে দিয়েছেন , জেল এবং  মৃত্যু যার জীবনে ছায়ার মতো ঘুরপাক খেয়েছে সারাটি জীবন , তাঁর এভাবে নিজেকে দেশের জন্য উৎসর্গ করবার প‌্রেরণা এমনি এমনি তৈরি হয় না ; যদি তার পেছনে দৃঢ় একটি আদর্শ , একটি আত্মবিশ্বাস না থাকে । সবচেয়ে বড়ো কথা এই আত্মবিশ্বাস এবং আদর্শের পেছনে যদি না থাকেন একজন স্ত্রী এবং সেই স্ত্রীর প‌্রতি প‌্রগাঢ় ভালোবাসা । "

পথহারা একটি জাতির পথ প‌্রদর্শকের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েও বঙ্গবন্ধুর উত্থান - পতন , জেল জুলুম হুলিয়া , আনন্দ বিষাদের জীবনে রেণু " ছিলেন অফুরন্ত প‌্রাণশক্তির অমূল্য রত্নভান্ডার । তাঁর রাজনৈতিক দর্শন ও আদর্শকে বাস্তবায়ন করতে বঙ্গমাতা একনিষ্ঠ কর্মী , বিশ্বস্ত সংগঠক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ছায়া সহচর হয়ে পাশে থেকেছেন অতন্দ‌্র প‌্রহরী হয়ে ।  ছিলো মান - অভিমান - বিরহ -বিষাদের আবেগ ভরা দহন ; অদৃশ্য বেদনায় ভালোবাসার আকুতি .... বঙ্গবন্ধু বলছেন , , রেণু আমাকে বিদায় দেওয়ার সময় নীরবে চোখের পানি ফেলছিলো । আমি ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম না । একটা চুমা দিয়ে বিদায় নিলাম । বলবার তো কিছুই আমার ছিলো না । সবই তো ওকে বলেছি ( অঃ আত্মজীবনী , পৃ: ১৬৫ ) । বঙ্গবন্ধু তাঁর আদরের রেণুর সাথে গল্প করতে করতে একসময় জেলখানার একটা প‌্রসঙ্গ টেনে  বলেছিলেন , যদি কোনোদিন পাগল হয়ে যাই তবে পাগলা গারদে বা জেলের পাগলখানায় আমাকে দিও না (কারাগারের রোজনামচা , পৃঃ ৬৪)।

বাঙালি - বাংলাদেশ - বঙ্গবন্ধু এই তিনটি নাম যেমন একইসূত্রে , একই আদর্শে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত তেমনি বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছার  নামও প‌্রচ্ছন্ন নয় বরং পরস্পরের সাথে অবিচ্ছেদ্য আত্মিক এক বন্ধনে আবদ্ধ । খোকা " থেকে বঙ্গবন্ধু , বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা হয়ে ওঠার পেছনে এই পতিব্রতা - মহীয়সী নারীর  আজন্ম আত্মত্যাগ , দৃঢ়চেতা সাহসী মনস্তাত্বিক মনোবল , প‌্রজ্ঞা -সজ্ঞার সম্মিলনে তৈরি তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ‌্রহন সার্বিকভাবে সফলতার সাথে অগ‌্রণী ভূমিকা পালন  করেছে । এর প‌্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে বাঙালির রাজনৈতিক পটভূমিতে স্বাধীনতা সংগ‌্রামের দীর্ঘ আন্দোলন সংগ‌্রামের পথে পথে ।  ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তিসনদ ছয় দফা আন্দোলনকে কেউ কেউ আট দফাতে পরিণত করার চেষ্টা করলে বেগম মুজিব সেটিকে কঠোর হস্তে দমন করেছিলেন । শেখ ফজিলাতুন নেছা আমার মা শিরোনামে শেখ হাসিনা লিখলেন , ০৭ জুনের হরতাল পালন , আমার মাকে দেখেছি , তিনি আমাদেরকে নিয়ে ছোটো ফুফুর বাসায় যেতেন , কেননা , সেখানে ফ্ল্যাট ছিল । ওখানে গিয়ে নিজে পায়ের স্যান্ডেল বদলাতেন , কাপড় বদলাতেন , বোরকা পড়তেন , একটা স্কুটারে করে আমার মামা ছিলেন ঢাকায় পড়ত তাকে নিয়ে ছাত্রনেতাদের সাথে বৈঠক করতেন ; আন্দোলন চালাবে কীভাবে তার পরামর্শ দিতেন ।"  প‌্রচারবিমুখ এই নারীর হাতেই ছাত্রলীগ গতিশীলতা পেয়েছিলো । গোয়েন্দা নজরদারি এড়িয়ে সন্তানদের নিয়ে আবার  বাসায় ফিরতেন ।  তাঁর আত্মপ‌্রত্যয়ী মনোভাব এবং অধিকতর রাজনৈতিক সচেতনতার জন্যই সে সময়কার সব অপচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় । অবশেষে বেগম মুজিবের দৃঢ়তায় মিটিংয়ে রেজুলেশন হলো যে ৬ দফা ছাড়া হবে না ।

শুধু তাই নয়, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গণমানুষের দাবির মুখে বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে লাহোরে গোলটেবিল  বৈঠকে যোগ দেয়ার আহ্বান জানালে বঙ্গমাতা সেই প‌্রস্তাব দৃঢ়তার সাথে প‌্রত্যাখ্যান করেন এবং কারাগারে কৌশলে বঙ্গবন্ধুকে খবর পাঠিয়ে প্যারোলে মুক্তি না নেয়ার জন্য অনুরোধ করেন । সে সময় দুই বাংলার অনেক বড় বড় নেতা বঙ্গমাতাকে বলেছিলেন , আপনি তো বিধবা হবেন । দেশরত্ন শেখ হাসিনার ভাষ্যমতে , " মা শুধু বলেছিলেন,  , আমি তো একা না , এখানে তো ৩৪ জন আসামী ; তারা যে বিধবা হবে এটা আপনারা চিন্তা করেন না ? আমার একার কথা চিন্তা করলে চলবে ? মামলা না তুললে উনি যাবেন না ।" জাতির পিতা সেদিন তাঁর প‌্রিয় রেণুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বৈঠকে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে প‌্রকারান্তরে সহধর্মিণীকেও সম্মানিত করেছিলেন । ফলশ‌্রুতিতে , বঙ্গবন্ধুসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সব অভিযুক্ত একসঙ্গে নিঃশর্ত মুক্তিলাভ করেন । বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিশপথের পথে বঙ্গমাতার এই সিদ্ধান্ত ছিলো যুগান্তকারী অনন্য এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ । 

৭ মার্চের ভাষণের নেপথ্যেও ছিলো বেগম মুজিবের মনস্তাত্বিক সমর্থন । বিভিন্ন পরামর্শের জটিলতায় বঙ্গবন্ধু যখন মানসিকভাবে অস্হির তখন বঙ্গমাতা দীর্ঘ দিনের চেনা সঙ্গীর চিন্তা -কর্ম- মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে যা বলেছিলেন সেটি বঙ্গবন্ধুকে সাহস জুগিয়েছিলো  , মঞ্চে নির্ভার রাখতে সহায়তা করেছিলো । যে ভাষণ আজকে সারাবিশ্বের শ‌্রেষ্ঠ ভাষণের মর্যাদা পেয়েছে । 

অদম্য সাহসিকতা সম্পন্ন এই নারী একদিকে সংসার - সন্তানবাৎসল্য অন্যদিকে দল গঠনে ,  স্বাধীনতা সংগ‌্রামে,  , আন্দোলনে নিজেকে সর্বোতভাবে সম্পৃক্ত রেখে অসহনীয় দুঃখ - কষ্ট - যন্ত্রণা ভোগ করলেও কখনও পাকিস্তানীদের সাহায্য - সহযোগিতা গ‌্রহণ করেন নাই ।

বঙ্গবন্ধু তাঁর সহধর্মিণী প‌্রাণের রেণুকে ভালোবাসতেন হৃদয়ের সবটুকু উজাড় করে।  তাঁর অদম্য প‌্রেরণা আর আন্তরিক সদিচ্ছার প‌্রতিফলনই হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী দু"টি গ‌্রন্হ ---- অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং কারাগারের রোজনামচা । একজন মহান নেতার জীবনদর্শন এবং সেই দর্শনের মনোজাগতিক বিশ্লেষণে যে মহীয়সী নারীর পবিত্র মুখাবয়বটি আমাদের সামনে প‌্রতিভাত হয় তিনি আর কেউ নন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব ।    

জেলখানাতে বসেও প‌্রেমিক মুজিব স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন নেছার জন্য অধীর আগ‌্রহে অপেক্ষা করতেন । কারাগারের রোজনামচায়  তিনি বলছেন , ভেবেছিলাম ,আজ রেণু ও ছেলেমেয়েরা দেখতে আসবে আমাকে । হিসাবে পাওয়া যায় আর রেণুও গত তারিখে দেখা করার সময় বলেছিল ২০ বা ২১ তারিখে আবার আসব। চারটা থেকে চেয়েছিলাম রাস্তার দিকে । মনে হতেছিল , এই বুঝি খবর আসে ।" (পৃ:১৭৩) ..... বঙ্গবন্ধুর রেণুর গল্প ফুরোবার নয় । জীবনের প‌্রতি পাতায় ঘুরেফিরে কতোভাবে ,কতো আবেগে বঙ্গবন্ধু মনের ক্যানভাসে ভালোবেসে রেণুকে চিত্রিত করে , তাঁর হৃদয়স্পর্শী কথাগুলোকে লালন করে বিষাদের অমসৃণ গিরিখাদে বার বার আছড়ে পড়তেন সেটির যেনো কোনো হিসেব কোনোভাবেই মেলানো সম্ভব নয় । রেণুর গভীর ভালোবাসা বুকে নিয়ে স্মৃতিচারণায় তিনি লিখলেন , রেণু স্যারিডন (ট্যাবলেট) খেতে দিতে চাইতো না । ভীষণ আপত্তি করতো , বলতো হার্ট দুর্বল হয়ে যাবে । আমি বলতাম , আমার হার্ট নাই , অনেক পূর্বেই শেষ হয়ে গেছে । বাইরে তাঁর কথা শুনি নাই কিন্ত জেলের ভেতর তার নিষেধ না শুনে পারলাম না । (কা: রো: পৃ: ১২৬) । 

টেবিলে বই নিয়ে বসে থাকলেই যে গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়া হচ্ছে এমনটি ভাবা যথার্থ নয় । অনেক সময় খোলা পাতার মধ্যে  দৃষ্টিতে কালো কালির ছাপা হিজিবিজি চোখে পড়লেও মন কিন্ত ঘুরে বেড়ায় অচিনপুরে - ভালোবাসার দূর - সুদূরে কোনো প‌্রিয়জনকে ঘিরে । তেমনি করে সহজ সরল অভিব্যক্তিতে বঙ্গবন্ধু বলছেন , মাঝে মাঝে বইয়ের দিকে চেয়ে থাকি সত্য , মনে হবে কতো মনোযোগ সহকারে পড়ছি । বোধ হয় সেই মূহুর্তে আমার মন কোথাও কোনো অজানা অচেনা দেশে চলে গিয়েছে । নতুবা কোনো আপনজনের কথা মনে পড়ছে । নতুবা যার সাথে মনের মিল রয়েছে , একজন আর একজনকে পছন্দ করি তবুও দূরে থাকতে হয় , তার কথাও চিন্তা করে চলেছি । (কা: রোজনামচা , পৃ: ১০৭) । কোনো অভিযোগ নেই , কোনো অনুযোগ নেই , হা হুতাশ নেই , ক্লান্তিকর কোনো উষ্মা নেই , জেলে আটক স্বামীর ফেলে যাওয়া কাজগুলিকে পরম নিষ্ঠা আর যত্নসহকারে বছরের পর বছর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন অভিজ্ঞ সংগঠক আর দক্ষ নাবিকের মতোন । শেখ ফজিলাতুন নেছা আমার মা : শিরোনামে  শেখ হাসিনা বলছেন , একটার পর একটা ঘাত প‌্রতিঘাত এসেছে কিন্ত একটা জিনিস আমি বলবো যে , আমার মাকে আমি কখনো ভেঙ্গে পড়তে দেখিনি । যতো কষ্টই হোক কখনো আমার বাবাকে বলেননি যে তুমি রাজনীতি ছেড়ে দাও বা চলে আসো বা সংসার কর বা সংসারের খরচ দাও , কখনো না । " বেগম মুজিব নিজেও হয়তো তাঁর জীবদ্দশায় বুঝে উঠতে পারেননি দিনের পর দিন জনমনে ,,দলের লোকজনদের নিকটে কোন উচ্চতায় তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন তবুও তাঁকে তাঁর পুরো পরিবারকে কিছু স্বার্থান্বেষী নরপিশাচরুপী ঘাতকদের হাতে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হতে হলো । পৃথিবী প‌্রত্যক্ষ করলো এক মহান নেতার নিষ্ঠুর মহাপ‌্রয়াণ ।

সভ্যতার ঊষাকাল থেকে মানবসমাজে পথের নির্দেশনা দেওয়ার জন্য অনেক জ্ঞানী - গুণী , নবী - রাসুল , পীর - ফকির , দেশপ‌্রেমী অনেক ত্যাগী নেতৃবৃন্দ - রাজনীতিকদের আবির্ভাব ঘটেছে । জীবনী বিশ্লেষণে ধর্ম বিশারদরা আছেন অনন্য উচ্চতায় । বিশেষতঃ আমাদের শেষনবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা ( সাঃ)। কিন্ত সমকালীন রাজনীতির মাঠে রাজপথ থেকে অবিভক্ত ভারতসহ , তখনকার পূর্ব বাংলা -পশ্চিম বাংলার প‌্রত্যন্ত মেঠোপথ , নৌপথ , আকাশপথ কাঁপিয়েছেন , দাপিয়ে বেড়িয়েছেন , জনগণকে সংগঠিত করেছেন গণমানুষের হৃদয়ের কাছে পৌঁছানোর অভাবনীয় প‌্রাণশক্তিতে যিনি তাঁর ৫৫ বছর জীবনের পুরোটাই উৎসর্গ করে বিশ্বনেতাদের কাতারে কোথাও বা ছাপিয়ে স্বমহিমায় সমাসীন হয়েছিলেন,  একমাত্র বাংলার মাটি ও মানুষের সন্তান হাজার বছরের শ‌্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । তিনি তাঁর আবাল্য শিশু - কৈশোর - যৌবন - মধ্যবয়সের যোগ্য সঙ্গিনী বেগম মুজিবকে পেয়েছিলেন , "মোরা আর জনমের হংস মিথুন রুপে " ।

দশভূজা দেবীর প‌্রতিমূর্তিরুপে বঙ্গমাতা এই বাংলায় বঙ্গবন্ধুর যোগ্য সহচরী,  মোহহীন যোগ্য অনুরাগী হিসেবে রেণুর আগমণ যথার্থ এবং অনিবার্য হিসেবে কালের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে । 

আমার দেখা নয়াচীনের" ভূমিকায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আবেগঘন কথাগুলো স্মরণ করতে চাই .... " সবসময়ে আমার মায়ের কথাই মনে পড়ে । আমার মা যে কত রাজনীতি সচেতন ছিলেন , কত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন , আমার আব্বাকে তিনি লেখার প‌্রেরণা দিতেন । খাতাগুলি কিনে দিতেন আবার আব্বা যখন জেল থেকে মুক্তি পেতেন তখন খাতাগুলি সংগ‌্রহ করে সযত্নে রেখে দিতেন । তিনি নিশ্চয়ই আশা করেছিলেন যে এই লেখাগুলি একসময় বই আকারে ছাপা হবে । কিন্ত তিনি তা দেখে যেতে পারলেন না । ১৯৭৫ সালের ১৫ই  আগস্ট কালরাতে বাবার সাথেই শাহাদত বরণ করেছেন । ঘাতকের বুলেটের নির্মম আঘাতে চিরদিনের মতো না ফেরার দেশে চলে গেছেন । মাকে যদি একবার বলতে  পারতাম , দেখাতে পারতাম আব্বার লেখাগুলি পুস্তক আকারে প‌্রকাশিত হয়েছে তাহলে কতো খুশি হতেন । মা, তোমার কথাই বারবার মনে পড়ে মা । "

সর্বোপরি বঙ্গমাতা শুধু বাঙালি নারী জীবনেই নয় বিশ্বনারী চিত্রণে তাঁর অসামান্য অবদান অনুকরণীয় হয়ে থাকবে । বঙ্গবন্ধুর সাথে বঙ্গমাতা একই আদর্শের অভিন্ন বাতিঘর হয়ে প‌্রজন্মের পথহারা মানুষকে পথ দেখিয়ে চলবে ।

অধ্যাপক  মালেকা আক্তার চৌধুরী, সরকারি তিতুমীর কলেজ, দর্শন বিভাগ ও সাধারণ সম্পাদক , শিক্ষক পরিষদ , সরকারি তিতুমীর কলেজ , ঢাকা ।