আসমা চেয়েছিলেন ইমামের সঙ্গে চতুর্থ সংসার করতে, আজহারকে হত্যার লোমহর্ষক ঘটনা

আসমা চেয়েছিলেন ইমামের সঙ্গে চতুর্থ সংসার করতে, আজহারকে হত্যার লোমহর্ষক ঘটনা
আজহারকে হত্যার পর আসমা চেয়েছিলেন ইমামের সঙ্গে চতুর্থ সংসার করতে 

নিজস্ব প্রতিবেদক।। 

মসজিদের ইমামের সঙ্গে পরকীয়া প্রেমে পড়ে এই বিয়েও টিকল না আসমা আক্তারের। শেষমেষ হত্যা করেন স্বামীকেই। যদিও শেষ রক্ষা হয়নি। পরকীয়া প্রেমিকসহ র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হন তারা।

মসজিদের সেপটিক ট্যাংকে যুবকের ছয় টুকরা মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন স্ত্রী আসমা বেগম ও ইমাম মাওলানা আব্দুর রহমান। আজহারকে হত্যার পর ইমামের সঙ্গে চতুর্থ সংসার করতে চেয়েছিলেন আসমা। তাই তার পরিকল্পনায় এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। আসমা ইমাম আব্দুর রহমানকে প্রায়ই বলতেন, আজহারকে হত্যা করতে না পারলে তিনি নিজেই আত্মহত্যা করবেন অথবা ইমামকে হত্যা করবেন।

র‌্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে এসব তথ্য। বুধবার (২৬ মে) এই দুই আসামির পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আরো বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে বলে মনে করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

র‌্যাব সূত্র জানায়, গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, প্রথম বিয়ে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর নিহত আজহারের বড়ভাইয়ের সঙ্গে আসমার বিয়ে হয়েছিলো। তবে পরকীয়ার কারণে তাদের বিচ্ছেদ ঘটে বলে জানা গেছে। এরপর আজহারের সঙ্গে আসমার তৃতীয় বিয়ে হয়। তাদের সংসারে চার বছরের একটি পুত্রসন্তান রয়েছে। আজহারকে খুনের পর আসমা ইমাম আব্দুর রহমানকে বিয়ে করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

এর আগে মঙ্গলবার সকালে দক্ষিণখানের সরদার বাড়ি জামে মসজিদের সেফটিক ট্যাংক থেকে আজহারের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এই ঘটনায় ওই মসজিদের ইমাম আব্দুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। পরে আব্দুল্লাহপুর থেকে আজহারের স্ত্রী আসমা বেগমকে আটক করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে স্ত্রী আসমার সম্পৃক্ততা পায় র‌্যাব। পরে আজহার হত্যা মামলায় আসমাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। উদ্ধার করা হয় হত্যায় ব্যবহৃত তিনটি চাকু ও মোবাইল ফোন।

১৯ মে হত্যাকাণ্ডের দিন এশার নামাজের পর নিহত আজহারের সঙ্গে ইমাম আব্দুর রহমানের বাকবিতণ্ডা হয়। পরে আব্দুর রহমান ধারালো অস্ত্র দিয়ে আজহারের ঘাড়ে আঘাত করেন। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। পরে মসজিদে নিজের রুমেই ফজরের আজানের আগ পর্যন্ত আজহারকে কুপিয়ে ছয় টুকরো করেন ইমাম নিজেই। এরপর মসজিদের সেপটিক ট্যাংকে মরদেহ লুকিয়ে রাখা হয়।

বুধবার র‌্যাব সদরদপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে হত্যার ঘটনার বর্ণনা দেন এলিট ফোর্সটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

তিনি জানান, মার্চের শেষের দিকে আসমা ও মসজিদের ইমাম দুজনে মিলে আজহারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। প্রথমে তারা সিদ্ধান্ত নেন ভাড়াটে খুনির মাধ্যমে বা অন্য কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে আজহারকে হত্যা করবেন। পরবর্তী সময়ে আসমা মসজিদের ইমামকে পরামর্শ দেন, তার স্বামীকে যেন তার রুমেই (ইমামের রুমে) হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ও তাদের আলাপচারিতা বাস্তবায়ন করতে ইমাম আব্দুর রহমান তার মক্তবের এক ছাত্রের নামে সিমকার্ড ও মোবাইল ফোন কিনে আসমাকে দেন। এই ফোনেই তাদের গোপন শলা-পরামর্শ চলত।

খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তারের পর অভিযুক্তরা জানান; এবছর রোজা শুরুর সাত দিন আগে আজহারকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। তবে আজহার কলেরায় আক্রান্ত হয়ে পড়ায় হত্যার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। পরবর্তী সময়ে তিনি (আজহার) সুস্থ হলে ঈদের আগের দিন তারা টাঙ্গাইলের কালিহাতী গ্রামের বাড়িতে চলে যান। সেখানেও আসমার সঙ্গে নিয়মিত আব্দুর রহমানের যোগাযোগ চলছিলো। এসময় আসমা মোবাইলে ইমামের সঙ্গে পরামর্শ করে ১৮ মে প্ররোচনা দিয়ে আজহারকে ঢাকাতে পাঠান। পরদিন (১৯ মে) আজহারকে মোবাইলের মাধ্যমে মসজিদে ডেকে নেন আব্দুর রহমান। আজহার গার্মেন্টসে কাজ শেষে এশার নামাজের সময় সরাসরি ইমামের সঙ্গে দেখা করতে মসজিদে যান। এসময় তাকে ইমামের রুমে বিশ্রাম নিতে বলা হয়। কোনো একসময় ওই রুমেই ঘুমিয়ে যান তিনি। পরে ইমাম ওই রুমে এলে তাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে বাকবিতণ্ডা হয়।

মাওলানা আব্দুর রহমান সরদারবাড়ি জামে মসজিদে ৩৩ বছর ইমামতি করে আসছিলেন। নিহত আজহারের চার বছরের ছেলে মসজিদের মক্তবে পড়াশোনা করত। নিহত আজহারও তার কাছে কুরআন শিক্ষা গ্রহণ করতেন। এই সুবাদে তাদের মধ্যে পারিবারিক সম্পর্ক ছিলো।

র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী আব্দুর রহমান তার কাছে থাকা কোরবানির পশু জবাইয়ের ছুরি দিয়ে আজহারকে আঘাত করতে গেলে তিনি টের পেয়ে যান। এসময় তাদের দু'জনের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। আজহার রুম থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে সিঁড়িতে পড়ে যান। এসময় আব্দুর রহমান আজহারের গলার ডান দিকে হাতে থাকা ছুরি দিয়ে আঘাত করেন। মৃত্যু নিশ্চিত করতে আরো কয়েকটি আঘাত করা হয়। পরে মরদেহ টেনে-হেঁচড়ে আব্দুর রহমান নিজের রুমে নিয়ে যান। সেখানে ওই ছুরি ও ধারালো চাপাতি দিয়ে মরদেহের ছয় টুকরো করে তা ব্যাগে ভরে মসজিদের সেফটিক ট্যাংকে ফেলে দেন। এরপর ট্যাংকের মুখটি সিমেন্টের বস্তা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়।

খন্দকার মঈন বলেন, ২৫ মে আমরা জানতে পারি মসজিদের সিঁড়িতে রক্তের দাগ এবং সেফটিক ট্যাংক থেকে প্রচুর দুর্গন্ধ আসছে। পরে র‌্যাব ছায়া তদন্ত করে এবং আজহারের খোঁজ শুরু করে। এরপর মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের আগে এবং পরে মসজিদের ইমাম আব্দুর রহমান ভুক্তভোগীর স্ত্রীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেন। তখন তিনি এই হত্যাকাণ্ডটি কীভাবে সংঘটিত করেছেন, সেই বিষয়টি আসমা বেগম বর্ণনা করে জানান।

জিজ্ঞাসাবাদে ইমাম জানিয়েছেন, আজহারকে হত্যার জন্য আগে থেকেই একটি চাপাটি ও একটি ছুরি তার কক্ষে এনে রেখেছিলেন।

র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে আসমা বেগম জানান, আজহারুল ছিলেন তার তৃতীয় স্বামী। তিনি আগেও দুটি বিয়ে করেছিলেন। আসমার দ্বিতীয় স্বামী ছিলেন নিহত আজহারের বড়ভাই। ২০১৫ সালে তাদের পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছিলো। গোপনে আসমার সঙ্গে আজহারের পরকীয়া সম্পর্ক হয়। সেই সম্পর্কের কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। পরে আসমা পালিয়ে আজহারকে বিয়ে করে‌ন।

এদিকে মাওলানা আব্দুর রহমান জানান, আসমা প্রায়ই বলতেন, যদি আজহারকে হত্যা না করতে পারি তাহলে তিনি নিজেই আত্মহত্যা করবেন। না হয় আমাকে (আব্দুর রহমান) হত্যা করবেন। আসমা তাকে বিয়ে করবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আজহারকে হত্যার আগে ।