মানব পাচার চক্র অপ্রতিরোধ্য, মামলা হলেও নিষ্পত্তি নেই

আবদুল্লাহ আল মামুন ।।

মানব পাচার চক্র অপ্রতিরোধ্য, মামলা হলেও নিষ্পত্তি নেই
মানব পাচার চক্র অপ্রতিরোধ্য, মামলা হলেও নিষ্পত্তি নেই

মানব পাচার নানা উদ্যোগেও থামছে না । বিদেশে ভালো বেতনে চাকরি বা নানা কাজের প্রলোভনে চলছে পাচার কাজ। পুরুষের পাশাপাশি নারী ও শিশুদেরও পাচার করা হচ্ছে। এর বাইরে রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে মাঠে সক্রিয় বেশ কয়েকটি চক্র। সাগরপথ ও আকাশপথ পাচারের নিরাপদ রুট হলেও শীত মৌসুমে চক্রের প্রধান টার্গেট সাগরপথ। যদিও বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিতে গিয়ে প্রতিবছর প্রাণ হারায় বহু মানুষ। কিন্তু এসব ঘটনায় যে হারে মামলা হয় সেই হারে নিষ্পত্তি ও বিচারের ঘটনা খুবই কম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমনে আইনে দেশের সাত বিভাগে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা
থাকলেও তা কার্যকর না হওয়ায় এসব চক্রকে নির্মূল করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির এক তথ্যে দেখা যায়, ২০১২ সাল থেকে এ বছর জুলাই পর্যন্ত ৭ বছরে ৮ হাজার ৮৬১ জন মানুষ পাচারের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে পুরুষ ৫ হাজার ৫৪১, নারী ১ হাজার ৭৪৭ ও ৮৭৩ জন শিশু রয়েছে। চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ৭ বছরে পাচারের মামলা হলেও নিষ্পত্তি নেই
আইনে মামলা হয়েছে ৫ হাজার ৭১৬টি। যার মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ২৪৭টি। এ ছাড়া ৪ হাজার ৯৪টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এ ছাড়া ২০১২ থেকে ২০১৮ সালের জুলাই পর্যন্ত মানব পাচার আইনে মোট মামলা সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৪৪৬টি। যার মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ২৪৫টি। বছর শেষে মানব পাচারের মামলার সংখ্যা সোয়া ৫ হাজারের কাছাকাছি যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার জন্য সাত বিভাগে সাতটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন না করাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, ২০১২ সালে জারি হওয়া মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান থাকলেও সাত বছর শেষ হতে চললে কোথাও একটি ট্রাইব্যুনালও গঠন করা হয়নি।
এলিটফোর্স র‌্যাবের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় ২০০৪ সাল থেকে মানব পাচার চক্রের বিরুদ্ধে ২৩৩টি অভিযান পরিচালনা করেছে বাহিনীটি। এ সময় পাচার সংশ্লিষ্ট ৬৬১ জনকে গ্রেফতার ও ৮৫৬ জন ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করা হয়।
আইন সংশ্লিষ্টরা বলেন, মানব পাচার আইন অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে অভিযোগ গঠন এবং ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার কথা। কিন্তু কোনো মামলার ক্ষেত্রে এমন নজির দেখা যায়নি। এ ছাড়া এ পর্যন্ত মানব পাচার আইনে গ্রেফতার হওয়া কিছুসংখ্যক অভিযুক্ত ছাড়া বেশিরভাগই জামিনে বেরিয়ে গেছেন।
আইন মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, মানব পাচার আইনের ২১(২) ধারা অনুযায়ী, অপরাধসমূহ বিচারের জন্য দায়রা জজ কিংবা অতিরিক্ত দায়রা জজ পদমর্যাদার বিচারকের সমন্বয়ে ট্রাইব্যুনাল গঠন করার কথা ছিল। কিন্তু পাচার আইনে এত বছরেও কোনো জেলায় ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়নি। ফলে এখনও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে এই মামলার বিচার চলছে। যার কারণে পাচার আইনে নিয়মিত মামলা হলেও সেই হারে নিষ্পত্তি হচ্ছে না। বরং স্বাভাবিক গতির চেয়ে অনেক বেশি দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পগুলো ঘিরে ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে মানব পাচারকারী চক্র। ভালো কাজের প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে পাচার করা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের। বেশিরভাগ চক্র কম টাকায় সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডে কাজের কথা বলে পাচার করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র জানায়, গত দুই মাসে সমুদ্রপথসহ বিভিন্ন রুটে পাচারের সময় প্রায় ৩০০ রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে। ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। গত ১৩ নভেম্বর সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় সেন্টমার্টিনের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থেকে ১২২ জন রোহিঙ্গাবাহী একটি ট্রলার আটক করে কোস্ট গার্ড। উদ্ধার হওয়া ভুক্তভোগীদের মধ্যে ৪৮ জন পুরুষ ছাড়াও ৫৯ নারী ও ১৫ জন শিশু ছিল।
পুলিশের তথ্যমতে, চলতি বছর এ পর্যন্ত সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় ৬১৭ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময় পাচারে জড়িত ১৭ জন দালালকে আটক ও জড়িতদের বিরুদ্ধে মানব পাচার আইনে ২৮টি মামলা করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক তথ্যমতে ২০১২ থেকে ২০১৯ সালের ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮ বছরে কক্সবাজার অঞ্চলে মানব পাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ২ হাজার ৭০৬ জনকে আসামি করা হয়।
সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ ফায়জুল্লাহ বলেন, মামলার নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা, অর্থ ব্যয় এবং পাচারকারী সিন্ডিকেট অনেক সংঘবদ্ধ হওয়ায় ভুক্তভোগীরা শেষ পর্যন্ত মামলা চালাতে পারেন না। যার কারণে একটা সময় তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন।
এ বিষয়ে ব্র্যাক অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, মানব পাচার আইনে তদন্ত, শাস্তিসহ বেশ কিছু বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও সাত বিভাগে সাতটি ট্রাইবুন্যাল গঠনের কথা ছিল। কিন্ত এত বছরে কোথাও ট্রাইব্যুনাল গঠিত না হওয়া দুঃখজনক। তিনি বলেন, যেসব জেলায় মামলা জট বেশি সেখানে দ্রæততর সময়ে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে পাচার মামলার বিচার শুরু করলে এ সঙ্কট থেকে মুক্তি সম্ভব হবে। অন্যথায় অপরাধীরা আরও সুযোগ পাবে এবং বেপরোয়া হয়ে উঠবে।