‘মাইন্ড এইড মাইন্ড কেয়ার ইনস্টিটিউট’ চিকিৎসার নামে টর্চার সেল

‘মাইন্ড এইড মাইন্ড কেয়ার ইনস্টিটিউট’ চিকিৎসার নামে টর্চার সেল
‘মাইন্ড এইড মাইন্ড কেয়ার ইনস্টিটিউট’ চিকিৎসার নামে টর্চার সেল

নিজস্ব প্রতিবেদক ।। 

‘মাইন্ড এইড মাইন্ড কেয়ার ইনস্টিটিউট’। রাজধানীর আদাবরের অবস্থিত এটি ছিল মূলত একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্র। কিন্তু সেটিকে হাসপাতাল বলে চালাত কর্তৃপক্ষ। গত দুবছর থেকেই চলছিল সেটির কার্যক্রম। কিন্তু কোনো অনুমোদন ছিল না। তবে গত ফেব্রুয়ারিতে অনুমোদনের আবেদন করা হলেও স্বাস্থ্য অধিদফতর তা স্থগিত করে।

কর্তৃপক্ষ মাদক নিরাময় কেন্দ্র খুলে বসলেও সেটি ছিল মূলত একটি টর্চার সেল। মানসিক রোগীদের চিকিৎসার আড়ালে হাসপাতালের তিনটি কক্ষে নিয়ে চলত মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। বিষয়টি আশপাশের লোকজনের অজানা ছিল। কারণ ওই তিনটি কক্ষে কাউকেই প্রবেশ করতে দেওয়া হতো না। এই নির্যাতনের শব্দ আশপাশের অনেকে শুনতে পেলেও তারা প্রতিবাদ করত না। কিন্তু সোমবার পুলিশের এক সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপারের মৃত্যুর ঘটনার পর অনেকে মুখ খুলতে শুরু করেছে। মূলত এটি একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্র হলেও সেটিকে ইনস্টিটিউট বলে সাইনবোর্ড ঝোলানো হয়েছিল। সে নামেই অনেকে চিনত। মঙ্গলবার সরেজমিন হাসপাতালটির কয়েকজন কর্মচারী, রোগী ও পুলিশের সঙ্গে কথা বল এসব তথ্য জানা গেছে।

সোমবার সকালে হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে এসে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্যাতনে নিহত হন পুলিশের সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিম। এ ঘটনায় আনিসুল করিমের বাবা বাদী হয়ে আদাবর থানায় হত্যা মামলা করেছেন। সেই মামলায় সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলো মারধরে জড়িত আরিফ মাহমুদ জয় (৩৫) হাসপাতালের মার্কেটিং ম্যানেজার, রেদোয়ান সাব্বির (২৩) কো-অর্ডিনেটর, মো. মাসুদ (৩৭) কিচেন শেফ, জোবায়ের হোসেন (১৯) ওয়ার্ড বয়, তানভীর হাসান (১৮) ফার্মাসিস্ট, তানিফ মোল্লা (২০) ওয়ার্ড বয়, সজীব চৌধুরী (২০) ওয়ার্ড বয়, অসীম চন্দ্র পাল (২৪) ওয়ার্ড বয়, লিটন আহাম্মদ (১৮) ওয়ার্ড বয় এবং সাইফুল ইসলাম পলাশ (৩৫) ওয়ার্ড বয়।

এদিকে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে গাজীপুর শহরের রাজবাড়ী মাঠে নিহত এএসপি আনিসুলের জানাজা অনুষ্ঠিত  হয়েছে। সকাল সোয়া ৯টার দিকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের গোরস্তানে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। এ ঘটনায় করা মামলায় ১০ আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে সাত দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। মঙ্গলবার শুনানি শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শহিদুল ইসলাম এই আদেশ দেন।

হাসপাতাল ঘুরে যা দেখা গেছে : বাইতুল আমান হাউজিং সোসাইটির মূল সড়কের পাশেই ২৮১ নম্বর বাড়িতে গড়ে ওঠে ‘মাইন্ড এইড মাইন্ড কেয়ার ইনস্টিটিউট’। তিনতলা ভবনটির প্রতিটি কক্ষ পরিপাটি করে সাজানো। প্রতিটি আছে রুমে দামি বিছানা, এসি, কাঠের আসবাবপত্রও। ৪৩ বেডের এই হাসপাতালটিতে একটি ফার্মেসি, রান্নাঘর এবং দুটি কেবিন রয়েছে। পুরো হাসপাতালে নার্স মাত্র তিনজন। প্রতিষ্ঠানটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মচারী জানায়, কোনো রোগী আসামাত্রই তাদের শব্দ নিয়ন্ত্রক রুমে নিয়ে নির্যাতন করা হতো। এরপর তার জন্য নির্দিষ্ট রুমে নিয়ে আটকে রাখা হতো। মানসিক চিকিৎসার নামে সব রোগীর ওপরই চলত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।

প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য : নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালটির এক রোগী ওই সময়ের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জানান, পুলিশের ওই কর্মকর্তাকে প্রথমে দ্বিতীয়তলার পূর্ব পাশের সাউন্ডপ্রুফ রুমে জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি ওই রুমে যেতে চাচ্ছিলেন না। এরপর কয়েকজন মিলে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলে তাকে। এ সময় তিনি অনেক চিৎকার আর আর্তনাদ করছিলেন। কিন্তু তারা কোনো কিছুর তোয়াক্কা করছিল না। তাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন তাকে বাঁধতে যোগ দেয়। এরপর দুজন হাতের কনুই দিয়ে তার ঘাড়ে আঘাত করতে থাকে। এ সময় নির্যাতিত ওই পুলিশ কর্মকর্তা চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘আল্লাহ, আমাকে বাঁচাও, বাঁচাও’। আমি মরে যাচ্ছি। এর কিছু সময় পরই তিনি নিস্তেজ হয়ে পড়েন। এ ঘটনার পর হাসপাতালটি ছেড়ে গেছে ২০ জন রোগী। মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত কক্সবাজারের আরিফুল হক নামে শুধু এক রোগী তার স্বজনদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। মঙ্গলবার সকালে গিয়ে কর্মচারীদের কাউকেই হাসপাতালে পাওয়া যায়নি। হাসপাতালে মাত্র একজন অফিস স্টাফ ছিল।

কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না ডিসি হারুন : এ ঘটনায় জড়িতদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) হারুন আর রশিদ। তিনি জানান, ঘটনায় জড়িতরা পুলিশের কাছে হত্যার দায় স্বীকার করেছে। পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তা হত্যায় যারাই জড়িত থাকুক না কেন, সবাইকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি একথা জানান। ঘটনা জানার পর থেকেই আদাবর থানা পুলিশ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ঘটনাটি তদন্ত শুরু করে বলে জানান ডিসি হারুন।

অনুমোদন ছিল না হাসপাতালটির : হাসপাতালটির অনুমোদনই ছিল না। মানসিক রোগী চিকিৎসার প্রয়োজনীয় কোনো ব্যবস্থা ছিল না হাসপাতালটিতে। মঙ্গলবার দুপুরে হাসপাতালটি পরিদর্শন করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ঢাকা জেলার সিভিল সার্জন মইনুল হোসেন সাংবাদিকদের এসব জানান। তিনি বলেছেন, মালিক চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুমোদনের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরে আবেদন করে। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত করে দেখা যায় হাসপাতাল চালানোর মতো কাগজপত্র, ব্যবস্থা, অন্যান্য সুবিধা ও জনবল পর্যাপ্ত ছিল না। এক কথায় মানসিক রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার যোগ্যতা ছিল না এই প্রতিষ্ঠানটির। তাদের অনুমোদন ছিল না, তাই সিলগালা করা হবে না বলেও জানান তিনি।

প্রসঙ্গত, সোমবার হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে গিয়ে কর্মচারীদের মারধরে মারা যান বরিশাল ট্রাফিক পুলিশের সিনিয়র এএসপি আনিসুল হক। তিনি ৩১তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পুলিশ ক্যাডারে যোগ দেন। সবশেষ আনিসুল বরিশাল মহানগর পুলিশে কর্মরত ছিলেন। তার বাড়ি গাজীপুরের কাপাসিয়ায়। তিনি এক সন্তানের জনক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের ৩৩ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন আনিসুল।

সুত্র. সময়ের আলো ।