বুয়েট আবরার হত্যা : ছাত্রলীগের ৯ নেতা আটক , চকবাজার থানায় মামলা ১৯ জনের বিরুদ্ধে

পোস্টকার্ড প্রতিবেদক ।।

বুয়েট আবরার হত্যা : ছাত্রলীগের ৯ নেতা আটক ,  চকবাজার থানায় মামলা ১৯ জনের বিরুদ্ধে
আবরার ফাহাদ
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিস্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেছে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এই হত্যায় বুয়েট ছাত্রলীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সাধারণ সম্পাদকসহ নেতাকর্মীরা সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছে। আটক করা হয়েছে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ নয়জনকে। তারা হলোÑ বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল, সহসভাপতি মুস্তাকিম ফুয়াদ, সহসম্পাদক আশিকুল ইসলাম বিটু, উপ-দফতর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ, উপ-সমাজকল্যাণ সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল, উপ-আইন সম্পাদক অমিত সাহা, ক্রীড়া সম্পাদক সেফায়েতুল ইসলাম জিয়ন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার, গ্রন্থনা ও গবেষণা সম্পাদক ইশতিয়াক মুন্না। তারা সবাই বুয়েট ছাত্রলীগের নেতা মেহেদী হাসান রাসেলের অনুসারী। রোববার রাতে আবরারকে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর হলের সিঁড়ির নিচে তার লাশ ফেলে রাখা হয়। তার শরীরে আঘাতের অনেক চিহ্ন রয়েছে। ঘটনার পর থেকে ওই কক্ষে থাকা ছাত্রলীগের চার নেতা পলাতক। সোমবার সকালে সিঁড়ির পাশ থেকে আবরারের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

আবরার ফাহাদ বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের (১৭তম ব্যাচ) শিক্ষার্থী ছিলেন। আবরার থাকতেন শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষে। তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে। কুষ্টিয়া জেলা স্কুল থেকে এসএসসি ও ঢাকা নটর ডেম কলেজে থেকে এইচএসসি পাস করেন আবরার ফাহাদ। তার ডাক নাম মুজাহিদ। মৃত্যুর আগে আবরার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাক্ষরিত একটি চুক্তির সমালোচনা করে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। সেই স্ট্যাটাস দেখে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা তাকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। পরে বিষয়টি ভিন্নখাতে নিতে আবরারকে শিবির সমর্থক চালিয়ে দেওয়ারও চেষ্টা চালায় হত্যাকারীরা।

এ ঘটনায় চকবাজার থানায় ১৯ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেছেন আবরারের বাবা। বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। প্রাথমিক তদন্তে এই প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে জানান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়। সোমবার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে শেরেবাংলা হলের ওই কক্ষ পরিদর্শন শেষে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার জানান, এটি যে হত্যাকাণ্ড সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সিসিটিভি ফুটেজ আমাদের কাছে রয়েছে।

বুয়েটের শেরেবাংলা হলের শিক্ষার্থী ও পুলিশ সূত্রে জানিয়েছে, রোববার রাতে আবরারকে কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। তার আগে আবরার টিউশনি করে রুমে ফেরেন। তিনি ওই সময় কাপড় বদল করে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এ সময় তাকে হলের ২০১১ নং কক্ষে ডেকে নেয় ছাত্রলীগ কর্মীরা। এরপর তিনি সেই কক্ষে গেলে তার মোবাইল চেক করা হয়। ফেসবুকের স্ট্যাটাস নিয়েও ব্যাপক গালাগাল করা হয় তাকে। পরে তাকে পেটাতে শুরু করে কক্ষটিতে থাকা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। আবরারকে জেরা ও পেটানোর সময় ওই কক্ষে বিশ^বিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আইন বিষয়ক উপসম্পাদক ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র অমিত সাহা, উপদফতর সম্পাদক ও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র মুজতাবা রাফিদ, সমাজসেবা বিষয়ক উপসম্পাদক ও বায়ো-মেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ইফতি মোশাররফ ওরফে সকালসহ তৃতীয় বর্ষের আরও কয়েক শিক্ষার্থী ছিলেন। ওই কক্ষে এসে দ্বিতীয় দফায় আবরারকে পেটায় বিশ^বিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী অনিক সরকার, ক্রীড়া সম্পাদক ও নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একই বর্ষের মেফতাহুল ইসলাম জিয়নসহ কয়েকজন।

মারধরের এক পর্যায় আবরার নিস্তেজ হয়ে পড়েন। তার মৃত্যু হয়েছে জেনে হলের কয়েকটি কক্ষের ছাত্রলীগ কর্মীদের ডেকে লাশটি সিঁড়ির নিচে রাখতে বলা হয়। এরপর থেকে পলাতক ছিল কক্ষটিতে থাকা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। সকালের দিকে পুলিশ খবর পেয়ে আবরারের লাশটি সিঁড়ির নিচ থেকে উদ্ধার করে। গতকাল ঢামেকের ফরেনসিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ লাশের ময়নাতদন্ত করেন। ময়নাতদন্ত শেষে তিনি জানান, আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এদিকে শেরেবাংলা হলের ওই কক্ষে যায় আবরারের ঢাকায় বসবাসরত স্বজনরা। সেখানে গিয়ে তারা স্টাম্প, চাপাতিসদৃশ স্টিলের চাকু এবং মদের বোতল দেখেছেন বলে জানান। সকালে পুলিশ অভিযান চালালে কয়েকটি মদের বোতল উদ্ধার করা হয় ওই কক্ষ থেকে। একই সঙ্গে পাঁচ-ছয়টি স্টাম্পও উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনার পর গতকাল সকালের দিকে হলের সিসিটিভি ফুটেজ উদ্ধারের দাবিতে প্রভোস্টের অফিস ঘেরাও করে শিক্ষার্থীরা। সেই ফুটেজ বুয়েট কর্তৃপক্ষের কাছে শিক্ষার্থীরা চাইতে গেলে বাকবিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে ফুটেজ দেওয়া হয়। তবে প্রথমদিকে ফুটেজ দিতে অস্বীকৃতি ও তা গায়েব করার চেষ্টা করা হয় বলে শিক্ষার্থীরা জানায়। উদ্ধার হওয়া ফুটেজে দেখা গেছে, রাত ২টা ৬ মিনিটের পর তাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাচ্ছে কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মী এবং তাদের পেছনে ছুটছে বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক।

আবরারের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার পিটিআই সড়কে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের বাসার পাশে। তার বাবার নাম বরকতুল্লাহ। তিনি বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের নিরীক্ষক কর্মকর্তা ছিলেন। মা রোকেয়া খাতুন একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষক। দুই ভাইয়ের মধ্যে আবরার ফাহাদ বড় ছিলেন। ছোটভাই আবরার ফায়াজ ঢাকা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। এ ঘটনার পর থেকে কুষ্টিয়ায় তার গ্রামের বাড়িতে শোকের মাতম চলছে। এছাড়াও ঘটনার পর থেকে পুরো দেশসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জড়িতদের বিচার ও ফাঁসির দাবিতে তোলপাড় চলছে।

পরিবারের বক্তব্য : আবরার শিবির ছিলেন ছাত্রলীগের এমন অপপ্রচার একেবারেই সঠিক নয় বলে দাবি করে আবরারের পরিবার। আবরারের চাচা মিজানুর রহমান জানান, সে (আবরার) শিবিরকর্মী, এমন কথা রটাচ্ছে সবাই। এটা বানোয়াট, আমরা সবাই আওয়ামী লীগের সমর্থক। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল হানিফ সাহেবের বাড়ির পাশে আমাদের বাড়ি। তিনি জানান, তার ভাতিজা তাবলিগ জামায়াতে যেত। বুয়েটে ভর্তির পর দু-তিনবার সে তাবলিগে গিয়েছিল। রোববার সকালে তাকে তার মা নিজ হাতে বাসে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হওয়ার জন্য তুলে দিয়েছিল। বিকালে তার সঙ্গে কথাও হয় তার মায়ের। কিন্তু রাত থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পায়নি পরিবার। গতকাল সকালের দিকে তারা তার মৃত্যুর খবর পায়।

যা ছিল আবরারের ফেসবুক স্ট্যাটাসে : ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি নিয়ে আবরার একটি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। স্ট্যাটাসে ফাহাদ লেখেন, ‘১৯৪৭-এ দেশভাগের পর দেশের পশ্চিমাংশে কোনো সমুদ্রবন্দর ছিল না। তৎকালীন সরকার ছয় মাসের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ করল। কিন্তু দাদারা নিজেদের রাস্তা নিজেদের মাপার পরামর্শ দিল। বাধ্য হয়ে দুর্ভিক্ষ দমনে উদ্বোধনের আগেই মোংলাবন্দর খুলে দেওয়া হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আজ ইন্ডিয়াকে সেই মোংলাবন্দর ব্যবহারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে। তিনি আরও লেখেন, কাবেরি নদীর পানি ছাড়াছাড়ি নিয়ে কানাড়ি আর তামিলদের কামড়াকামড়ি কয়েক বছর আগে শিরোনাম হয়েছিল। যে দেশের এক রাজ্যই অন্যকে পানি দিতে চায় না, সেখানে আমরা বিনিময় ছাড়া দিনে দেড় লাখ কিউসেক মিটার পানি দেব।’ ভারতকে গ্যাস দেওয়ার সমালোচনা করে আবরার লেখেন, ‘কয়েক বছর আগে নিজেদের সম্পদ রক্ষার দোহাই দিয়ে উত্তর ভারত কয়লা-পাথর রফতানি বন্ধ করেছে অথচ আমরা তাদের গ্যাস দেব। যেখানে গ্যাসের অভাবে নিজেদের কারখানা বন্ধ করা লাগে, সেখানে নিজের সম্পদ দিয়ে বন্ধুর বাতি জ্বালাব।’ স্ট্যাটাসের শেষে তিনি কবি কামিনী রায়ের একটি কবিতা জুড়ে দিয়ে শেষ করেন।

পুলিশের বক্তব্য : চকবাজার থানার এসআই দেলোয়ার হোসেন জানান, রাত পৌনে ৩টার দিকে তারা খবর পান শেরেবাংলা হলের বাইরে নিচতলায় একটি ছেলে পড়ে আছে। তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তবে আঘাত কোনো অস্ত্রের নয়। কোনো কিছু দিয়ে বাড়ি দেওয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম জানান, ‘আবরারের পায়ে ও ঊরুতে আঘাতের চিহ্ন ছিল। বিষয়টি তদন্ত করা করা হচ্ছে।’ বুয়েটের শেরেবাংলা হলের প্রভোস্ট মো. জাফর ইকবাল খান জানান, ‘রাত পৌনে ৩টার দিকে খবর পাই এক শিক্ষার্থী হলের সামনে পড়ে আছে। পরে পুলিশকে খবর দিই। পুলিশ এসে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।’
সুত্র - সময়ের আলো ।