বন্দর কর্তৃপক্ষের চোখ ফাঁকি দিয়ে একাধিক সক্রিয় জালিয়াত চক্র পণ্য খালাস করছে জাল সিল-স্বাক্ষরে

বন্দর কর্তৃপক্ষের চোখ ফাঁকি দিয়ে একাধিক সক্রিয় জালিয়াত চক্র পণ্য খালাস করছে জাল  সিল-স্বাক্ষরে

পোস্টকার্ড প্রতিবেদক ।।
একাধিক জালিয়াত চক্র চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চোখ ফাঁকি দিতে কাস্টম কর্মকর্তাদের সিল-স্বাক্ষর জাল, ভুয়া আমদানি নথি উপস্থাপনের মাধ্যমে পণ্য খালাস নিয়ে যাচ্ছে । এতে কাস্টম ও বন্দর কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত থাকার অভিযোগ বহু পুরনো। প্রায় সব ঘটনায়ই থাকে ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং (সিঅ্যান্ডএফ) প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশ। মাঝে মধ্যে সেচেষ্টা প্রতিহত করলেও জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তেমন তৎপরতানেই সংস্থা দুটিতে। ফলে নানা উদ্যোগের পরও রহস্যজনক কারণে থামছে না সিঅ্যান্ডএফ মালিকদের এই জালিয়াতি কারবার। জানা গেছে, প্রথম দিকে সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানগুলো নামকরা আমদানিকারকদের পণ্য খালাসের কাজ করে। এতে পণ্য আমদানির অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টের বিষয়ে ধারণা হয়। অধিকাংশক্ষেত্রে রপ্তানিকারকের সঙ্গে ও যোগাযোগ করে তারা। এতে উভয়ের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। তখন প্রতিষ্ঠানের সুনামকে পুঁজি করে জালিয়াতির আশ্রয়নেয় সংশ্লিষ্ট সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান। আবার অখ্যাত কোনো প্রতিষ্ঠানের নামেও পণ্য আমদানি করে খালাস নিয়ে যাওয়া হয়। এতে অল্প সময়ে কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা দেখে উৎসাহ পান অন্য সিঅ্যান্ডএফ মালিকরাও। এ জন্য বন্দর-কাস্টমের একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ব্যবহার করেন তারা। ফলে প্রশাসন কঠোর হলেও জালিয়াতির ঘটনা বাড়ছেই। মাঝে মধ্যে অবশ্য বিরোধী কেউ আগাম সংবাদ দিলে কাস্টম অথবা বন্দর কর্তৃপক্ষ পণ্য চালান আটকও করে। তবে এটা পাচারের তুলনায় অতিনগণ্য বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
বন্দর ও কাস্টম কর্মকর্তারা জানান, জালিয়াতির ঘটনার সঙ্গে মূলত সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের মালিকরাই জড়িত। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করলেও অধিকাংশক্ষেত্রেসেগুলোর অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। আবার সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের মালিককে ধরা হলে তারাও অস্বীকার করেন। কখনো কখনো ধরা পড়লে ভুয়া প্যাড বানিয়ে নাম ব্যবহার করেছে বলে দায় এড়িয়ে যায় আমদানিকারকরা। কোনোকোনোক্ষেত্রে সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলার পাশাপাশি লাইসেন্সও বাতিল করা হয়।
সর্বশেষ কাস্টম হাউসের রাজস্ব কর্মকর্তাদের সই নকল করায় জেপি শিটের একটি চালান আটক করে কাস্টম। ঢাকার আমানুল্লহ আয়রন ট্রেডার্সের নামে ৪৩ হাজার ৩০কেজি জাপানের এ পণ্য বন্দরে আসে। চালানটি খালাসের দায়িত্বে ছিল স্ট্যান্ডার্ডফ্রেইট নামে একটি সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান। গত রবিবার রাতে জাতীয়গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে খালাস নেওয়ার সময় এগুলো আটক করা হয়। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ওই সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের মালিকই ভুয়া নথিপত্রে চালানটি আমদানি করেছিলেন। এর আগে গত ৫ আগস্ট রাতে কাস্টম কর্মকর্তাদের সিল-স্বাক্ষর জাল করে সাত কন্টেইনার পণ্য খালাস নেওয়ার সময় আটক করে বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগ। ডাবল এট্রেড কমিউনিকেশনের নামে আমদানি করা হলেও শুল্ক পরিশোধ না করেই চালানগুলো খালাসের চেষ্টা করে সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান আদিব ইন্টারন্যাশনাল।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, জালিয়াতির ঘটনায় ধরা পড়লে সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা হয়। লাইসেন্সও বাতিল হয়। কিন্তু জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের একাধিক লাইসেন্স থাকে। ফলে একটি বাতিল করলে আরেকটি ব্যবহার করে তারা। আবার এ কাজের জন্য লাইসেন্স ভাড়ানেওয়া হয়। তবে জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কঠোর।
অবশ্য জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে চট্টগ্রাম সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা তাদের পক্ষ হয়ে তদবির করতে আসেন। কাস্টম কর্তৃপক্ষ কঠোর অবস্থানে থাকলে তাদের বিভিন্নভাবে চাপ দেওয়া হয়। অনেকক্ষেত্রে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধের হুমকিদেয় তারা। ফলে অনিয়ম করলেও অনেক সময় ব্যবস্থা নিতে পারে না কাস্টম কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে এমন নজিরও আছে, জালিয়াতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে থাকার কারণে কর্মকর্তারা সিঅ্যান্ডএফনেতাদের কাছে লাঞ্ছিত হয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে বদলি হয়েছেন অনেক কর্মকর্তা।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের উপকমিশনার নূর উদ্দিন মিলন জানান, ‘বর্তমানে কাস্টম কর্তৃপক্ষ জালিয়াতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে। আমাদের দৃঢ় পদক্ষেপের কারণে অনেক চালান আটক করেছি। তবে এর মধ্যেও কিছু অসাধু ব্যবসায়ী জালিয়াতি করে যাচ্ছে।  সিঅ্যান্ডএফ নেতাদের চাপের বিষয়ে তিনি বলেন, চাপ থাকবে, তদবির থাকবে এসব উপেক্ষা করেই আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী চাপ প্রয়োগ করে দায়মুক্তি পেতে চায়। কিন্তু আমরা কাউকে ছাড়দেয়া হবে না।