ফেনীর নুসরাত হত্যায় অধ্যক্ষসহ ১৬ জনের ফাঁসির আদেশ

ফেনীর নুসরাত হত্যায় অধ্যক্ষসহ ১৬ জনের ফাঁসির আদেশ
ফেনীর নুসরাত হত্যায় অধ্যক্ষসহ ১৬ জনের ফাঁসির আদেশ
মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফী'র বহুল আলোচিত হত্যা মামলার রায়ে অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা ও আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিনসহ চার্জশিটভুক্ত ১৬ আসামির সবাইকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
 
বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার পরপরই ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের জনাকীর্ণ এজলাসে বিচারক মো. মামুনুর রশিদ দৃষ্টান্ত স্থাপনের এই রায় ঘোষণা করেন। এ সময় এজলাসে উপস্থিত  করা হয় সব আসামিকেই। রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই উপস্থিত আসামিদের কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়ে। কেউবা আল্লাহকে ডাকে, গণমাধ্যমকে দোষারোপ করতে থাকে। মাত্র ১২ মিনিটে নীল রঙের তিন পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্ত রায় পাঠ করেন বিচারক মামুনুর রশিদ।
 
 
অন্যদিকে আলোচিত এ রায়ে আদালত তার বক্তব্যে রাফী হত্যার ঘটনা বিশ্ববিবেককে জাগিয়ে তুলেছিল বলে উল্লেখ করেন। এ সময় আদালত রাফী হত্যার পর গণমাধ্যমের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন। একই সঙ্গে পুলিশ তথা পিবিআইসহ সংশ্লিষ্ট সবার আন্তরিকতার জন্য ধন্যবাদ জানান। তবে এই রায়ে রাষ্ট্রপক্ষ ও বাদীপক্ষের আইনজীবীসহ হাজার হাজার সাধারণ মানুষ ব্যাপক সন্তোষ প্রকাশ করলেও এর বিরুদ্ধে আপিল করার কথা জানান আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।
 
সারা দেশ তাকিয়ে ছিল এই রায়ের দিকে। নানা জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ঘটনার ২০২ দিনের (প্রায় সাড়ে ছয় মাস) মাথায় ৬১ কার্যদিবসে প্রতীক্ষিত রায় পেলেন স্বজনসহ দেশবাসী। এতে শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেল না বর্বরোচিত রাফী হত্যায় জড়িতরা। সব আসামির সর্বোচ্চ রায়ে সারা দেশেই স্বস্তি বিরাজ করছে। বিশেষ করে ফেনী ও সোনাগাজীসহ পুরো জেলায় রাফী হত্যার রায়ের পর ব্যাপক উচ্ছ্বাস-প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। ফেনী শহরের মোড়ে মোড়ে মানুষকে জটলা পাকিয়ে সরগরম আলোচনায় মেতে থাকতে দেখা যায়।
 
ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত যারা : নুসরাত জাহান রাফী হত্যা মামলায় চার্জশিটভুক্ত ১৬ আসামির সবাইকেই মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তরা হলো সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার বরখাস্তকৃত অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা, সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি রুহুল আমিন, সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলম, মাদ্রাসার শিক্ষক হাফেজ আবদুল কাদের, প্রভাষক আফসার উদ্দিন, মাদ্রাসার ছাত্র নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, কামরুন নাহার মনি, উম্মে সুলতানা পপি ওরফে তুহিন ওরফে চম্পা ওরফে শম্পা, আবদুর রহিম শরিফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন মামুন, মোহাম্মদ শামীম ও মহিউদ্দিন শাকিল।
 
আসামিদের যেভাবে আদালতে হাজির করা হয় : সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে ফেনীর আদালত চত্বরে প্রবেশ করে রাফী হত্যা মামলার আসামিবাহী প্রিজন ভ্যান। এ সময় আদালত চত্বরসহ আশপাশের এলাকায় কঠোর নিরাপত্তায় মোতায়েন ছিল বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও র‌্যাবসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। প্রথমেই প্রিজন ভ্যান থেকে নুর উদ্দিন, এরপর সিরাজসহ একে একে ১৬ আসামিকে নামিয়ে কড়া পাহারায় নেওয়া হয় আদালতের এজলাসে। ১০টা ৫৫ মিনিটে আসামিদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের এজলাসের কাঠগড়ায় আনা হয়। এর আগেই ফেনীর পুরো শহর জুড়েই ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয় জেলা পুলিশ।
 
যেভাবে আদালত পরিচালিত হয় : এজলাসের টাঙানো ঘড়ির কাঁটা যখন ঠিক ১১টা পুরো এজলাসকক্ষে তখন তিলধারণের ঠাঁই নেই। আইনজীবী ও সাংবাদিকদের ব্যাপক ভিড়। তখনই বিচারক মামুনুর রশিদ এসে এজলাসে তার নির্ধারিত চেয়ারে বসে রায়ের কপি পাঠ করা শুরু করেন। মাত্র সাড়ে ১২ মিনিট সংক্ষিপ্ত রায়ের একটানা পাঠ করার শেষভাগে বিচারক মামুনুর রশিদ চার্জশিটভুক্ত ১৬ আসামির সবার বিরুদ্ধেই মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। এ সময় তিনি পরিষ্কারভাবে বলেন, ‘এই ১৬ আসামির সবাইকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নির্দেশ দেওয়া হলো।’ এ ছাড়া প্রত্যেক আসামিকে এক লাখ টাকা করে জরিমানাও করেন আদালত। সেই টাকা রাফীর পরিবারকে দিতে বলা হয়। রায়ের মাঝে ও আগে-পরে রাফী হত্যাকাণ্ডের এ বিষয় থেকে নানা পর্যবেক্ষণও তুলে ধরেন বিচারক মামুনুর রশিদ। রায় ঘোষণা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কাঠগড়ায় থাকা আসামিরা কান্নায় ভেঙে পড়ে। কেউ কেউ জানায়, উচ্চ আদালতে আপিল করবে তারা। আসামিরা এ সময় বাদীপক্ষের আইনজীবীদের অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করে। সাংবাদিকদের দোষারোপ করে নানা অভিশাপ দিতে থাকে। পরে পুলিশ পাহারায় এক এক করে আসামিদের প্রিজন ভ্যানে উঠিয়ে পৌনে ১২টার দিকে কারাগারে নেওয়া হয়।
 
আদালত চত্বরে কঠোর নিরাপত্তা : রাফী হত্যা মামলার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আদালত প্রাঙ্গণে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। র‌্যাব, পুলিশ ও সাদা পোশাকের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে ছিল এজলাস ও আদালত প্রাঙ্গণ। পাশাপাশি ফেনী শহরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতেও বাড়তি পুলিশ মোতায়েন ছিল।
 
রায় ঘিরে উৎসুক মানুষের ব্যাপক ভিড় : বহুল আলোচিত রাফী হত্যা মামলার রায়কে ঘিরে আদালত প্রাঙ্গণ এলাকায় ছিল হাজার হাজার মানুষের ভিড়। কৌত‚হলী মানুষের ভিড় সামলাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা হিমশিম খাচ্ছিলেন। উৎসুক জনতাও আদালত চত্বরে গিয়ে মোবাইল ফোনে সেলফি ও ভিডিও ধারণ বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘লাইভ’ সম্প্রচারে ব্যস্ত ছিল।
মামলার তদন্ত-চার্জশিট ও পিবিআইয়ের ভূমিকা : গত ৬ এপ্রিল আগুনে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার পর দগ্ধ রাফী মারা যান ১০ এপ্রিল রাতে। এর আগেই ৮ এপ্রিল রাফীর বড়ভাই নোমান সোনাগাজী মডেল থানায় আটজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেন। রাফীর মৃত্যুর পর এই মামলা হত্যা মামলায় রূপান্তর হয়। প্রথমে পুলিশ এবং পরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পিবিআই ব্যাপক দক্ষতা ও সততার সঙ্গে দ্রূততম সময়ে তদন্ত ও জড়িত আসামিদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। আলোচিত এ মামলায় বিভিন্ন সময় এজাহারভুক্ত আসামিসহ ২১ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ ও পিবিআই। এই ২১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ড হয়েছে।
গ্রেফতারকৃত আসামিদের মধ্যে ১২ জনই রাফী হত্যাকাণ্ডে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। গত ২৮ মে ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইনের আদালতে অধ্যক্ষ সিরাজ, তার সহযোগী নুর উদ্দিনসহ ১৬ জনকে অভিযুক্ত আসামি করে ৮০৮ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দাখিল করেন পিবিআই তদন্ত কর্মকর্তা। একই সঙ্গে পিবিআই ঘটনার নৃশংসতা বোঝাতে একটি ছায়াচিত্র বা সচিত্র প্রতিবেদন দাখিল করে। এরপর ৩০ মে বিচারিক হাকিম জাকির হোসাইন অভিযোগপত্রসহ মামলার নথি ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদের আদালতে পাঠিয়ে দেন। গত ১০ জুন মামলাটির অভিযোগপত্র আদালতে গ্রহণ হয়। ২০ জুন একই আদালতে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়।
২৭ জুন মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। মামলার ৯২ সাক্ষীর মধ্যে ৮৭ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ, আসামিদের বক্তব্য গ্রহণ, উভয়পক্ষে যুক্তিতর্কসহ যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। এরপর ৩০ সেপ্টেম্বর যুক্তিতর্কের ওপর রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের প্রতিউত্তর শেষে ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ বৃহস্পতিবার আলোচিত রাফী হত্যা মামলার রায়ের তারিখ ধার্য করেছিলেন।

প্রসঙ্গত, চলতি বছরের গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় আলিম পরীক্ষার্থী নুসারত জাহান রাফীকে নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা যৌন নিপীড়নের চেষ্টা চালায়। এ ঘটনায় অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে রাফীর পরিবার মামলা দায়ের করে। এরপর মামলা তুলে নিতে রাফীর পরিবারকে হুমকি দেয় সিরাজের ক্যাডার বাহিনী। একপর্যায়ে স্থানীয় পর্যায়ে এ নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হলে পুলিশ অধ্যক্ষ সিরাজকে গ্রেফতারে বাধ্য হয়। এই মামলায় সিরাজউদ্দৌলা কারাগারে থাকা অবস্থায় ৬ এপ্রিল রাফী নিজ মাদ্রাসার কেন্দ্রে আলিম পরীক্ষা দিতে গেলে কৌশলে ছাদে ডেকে নিয়ে হাত পেছনে বেঁধে তার শরীরে আগুন জ্বালিয়ে দেয় মুখোশধারীরা। মারাত্মক দগ্ধ রাফীকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হলে গত ১০ এপ্রিল মারা যান সাহসী কন্যা রাফী।