পুলিশের ভূমিকা করোনায় বদলে গেছে

পুলিশের ভূমিকা করোনায় বদলে গেছে
পুলিশের ভূমিকা করোনায় বদলে গেছে ,ছবি: সংগৃহীত

আলমগীর হোসেন।।

এখন যেন অন্যরকম এক পুলিশ। যে পুলিশকে নিয়ে সব সময় অতিমাত্রায় নেতিবাচক সমালোচনা হয়ে থাকে সেই পুলিশই এখন মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সবার প্রশংসায় ভাসছে পুলিশ।

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের এ ভয়ঙ্কর আপৎকালীন বদলে গেছে বাংলাদেশ পুলিশের ভ‚মিকা। অস্ত্র, গোলা, রাইফেল কিংবা লাঠি নয় হাতে তাদের এখন অসহায় মানুষদের প্রাণ বাঁচানোর সামগ্রী। এমনকি যেখানে করোনায় মৃত মানুষের দাফন করতে স্বজনসহ কেউই এগিয়ে আসছে না, সেখানে মৃত্যুঝুঁকি নিয়েই লাশের দাফন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছেন এক শ্রেণির পুলিশ সদস্য। অনেক পুলিশ কর্মকর্তা ‘আমিরুল মোমেনিনের’ আদর্শ মেনে গভীর রাতে নিজ হাতে অসহায় দরিদ্রদের ঘরে ঘরে গিয়ে খাদ্য ও অর্থ সহায়তা দিয়ে আসছেন। সবমিলে সাধারণ মানুষের কাছে সেই চিরচেনা আতঙ্কের পুলিশ এখন মানবিক পুলিশে রূপান্তর হয়েছে।

মানবিক পুলিশের প্রসঙ্গে বাংলাদেশ
পুলিশের নবনিযুক্ত মহাপরিদর্শক (আইজি) ড. বেনজীর আহমেদ বলেছেন, পুলিশকে জনগণের প্রথম ভরসার স্থল হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। জনগণের আস্থা অর্জনের সে লক্ষ্যেই পুলিশ বাহিনী কাজ করছে। করোনার কারণে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা গরিব, অসহায় মানুষদের ঘরে গিয়ে খাবারসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা। নিজেদের গাড়ি করে রোগীদের পৌঁছে দিচ্ছেন হাসপাতালে। এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্ট ঘুরে দেখা গেছে, নগরবাসীর নিরাপত্তায় নিরলসভাবে কাজ করছে পুলিশ। করোনার আতঙ্কে প্রায় সবাই যখন বাসা বাড়িতে ঠাঁই নিয়েছে সেখানে ঝুঁকি নিয়েই মাঠে কাজ করছেন পুলিশ সদস্যরা। এরই মধ্যে ৬৫ জনের মতো পুলিশ সদস্য করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানা গেছে। ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করা অনেক পুলিশ সদস্য বলেছেন, করোনার ঝুঁকি মোকাবেলা করার মতো তথা স্বাস্থ্য সুরক্ষা বজায় রাখার মতো পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সরঞ্জাম তারা পাচ্ছেন না। শুধু মানবিকতার স্বার্থেই সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়েই কাজ করছেন তারা।

সূত্রে জানা গেছে, পটুয়াখালীতে তিন দিন পানি খেয়ে কাটিয়েছেন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা অসহায় বৃদ্ধ সোবাহান হাওলাদার। খবর পেয়ে তার ঝুপড়ি ঘরে খাবার নিয়ে হাজির হন পটুয়াখালীর এসপি মোহম্মদ মইনুল হাসান। গত ১ এপ্রিল রাত সাড়ে ১১টার দিকে খাবার নিয়ে সোবহান হাওলাদারের বাড়িতে খাবার পৌঁছে দেন তিনি। এর বাইরেও রাত ৩টার দিকে যশোর শহরের বিভিন্ন বস্তিতে ঘুরে নিজ হাতে চাল, ডাল, তেল ও সাবান তুলে দিয়েছেন তিনি।

গত ৬ এপ্রিল ঝিনাইদহ জেলার কোটচাঁদপুর উপজেলায় গভীর রাতে বিভিন্ন গ্রামে চাল, ডাল, তেল, লবণ, সাবান, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাস্ক নিয়ে নিন্মআয়ের মানুষের বাড়ি গিয়ে হাজির হন জেলা পুলিশের প্রধান পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান। সন্ধ্যা থেকে মাঝ রাত পর্যন্ত তিনি নিজে প্যাকেট ভর্তি খাবার তুলে দেন নিন্মআয়ের মানুষের হাতে।

অন্যদিকে যশোরে গত ৯ এপ্রিল পরিবারের সদস্যদের ক্ষুধার জ্বালা মিটাতে দিশেহারা হয়ে অঞ্জলী রায় নামে এক গৃহবধূ ফোন দেন পুলিশকে। ফোন পেয়েই ১ ঘণ্টার মধ্যে খাবার নিয়ে হাজির হন যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (‘খ’ সার্কেল) জামাল আল নাসের ও তার সহকর্মী কয়েকজন পুলিশ সদস্য। চলমান করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সরকারি নির্দেশনা মানতে ঘরবন্দি পরিবারটি অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়ে। গত সপ্তাহে কুড়িগ্রাম জেলা শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নের বৃদ্ধা জিন্না বেগমের বাড়িতেও খাবারসামগ্রী নিয়ে হাজির হন জেলা পুলিশের এসপি। মৌলভীবাজারে নিজেদের রেশনের খাদ্যপণ্য গরিব অসহায়দের মাঝে বিতরণ করেছেন সেখানকার কিছু পুলিশ সদস্য।

কিছুদিন আগে ডিএমপির গুলশান বিভাগের ডিসি সুদীপ কুমার চক্রবর্তী নিজের ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে করোনার এ পরিস্থিতিতে যারা ঘরে থেকে খাবারের কষ্টে আছেন কিন্তু লজ্জায় বলতে পারছেন না তাদের ডিসির নম্বরে ফোন করে বাসার ঠিকানা জানাতে বলেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই আহŸানে অনেকেই সহায়তা চান এবং ডিসি সুদীপও তাদের পরিচয় গোপন রেখে প্রয়োজনমত খাদ্যসামগ্রী দিয়ে সহায়তা করেছেন।

অন্যদিকে ‘আপনি ঘরে থাকুন, দোকানই যাবে আপনার ঘরে’ এ শ্লোগানকে সামনে রেখে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) করোনাভাইরাসের ভয়াবহতায় বাসায় অবস্থান করা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। পুলিশের সেবা পেয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বাসিন্দারাও। একইভাবে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কর্মকর্তা বা সদস্যরাও প্রতিদিনই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অসহায়, দরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করছেন।

একাধিক পুলিশ সদস্য বলেন, হাফহাতা শার্টের পরিবর্তে এখন বর্তমানে ফুলহাতা শার্ট পরিধান করা প্রয়োজন। কিন্তু সরবরাহ করা হচ্ছে না। হ্যান্ড গøাভস ব্যবহার করা উচিত, কিন্তু সেটিও পর্যাপ্ত পাওয়া যাচ্ছে না। মুখে কিছু পুলিশ মাস্ক ব্যবহার করে, এ ক্ষেত্রে সব পুলিশের মুখে মাস্ক ব্যবহারের জন্য তা নিশ্চিতকরণের আদেশ জারি জরুরি। এ ছাড়া সব পুলিশ সদস্যের কাছে স্যানিটাইজার রাখা জরুরি। যাতে করে সবাই দায়িত্ব পালনকালে মাঝেমধ্যে নিজেদের জীবাণুমুক্ত করতে পারেন।

শনিবার পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেছেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে দায়িত্ব পালনকালে কোনো পুলিশ সদস্য অসুস্থ হলে তার চিকিৎসায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। পুলিশ সদস্যদের সর্বোচ্চ সুরক্ষা নিরাপত্তা নিশ্চিত করে দায়িত্ব পালন করাতে হবে।

পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা বলেন, বর্তমানে করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও পুলিশ মানবিক সহায়তা অব্যাহত রেখেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার পাশাপাশি পুলিশ সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। একই সঙ্গে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেও পুলিশ সদস্যরা সাধ্যমতো অসহায় অভুক্ত মানুষের পাশেও দাঁড়াচ্ছেন।