প্রায় ২ শতাধিক গ্রেফতারের পরও জঙ্গিরা বিচ্ছিন্নভাবে নতুন কৌশলে সংগঠিত হচ্ছে 

প্রায় ২ শতাধিক গ্রেফতারের পরও জঙ্গিরা বিচ্ছিন্নভাবে নতুন কৌশলে সংগঠিত হচ্ছে 

:বাকী বিল্লাহ ও সাইফ বাবলু ।।

এখনও দেশে নির্মূল হয়নি জঙ্গি কার্যক্রম যদিও পুলিশের সাঁড়াশি অভিযানে একের পর এক জঙ্গি গ্রেফতার হয়েছে । গুলশানে হলি অ্যাটিজানে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর থেকে চলতি বছরের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত গত সাড়ে ৩ বছরে প্রায় দুই শতাধিক জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গিবিরোধী প্রায় অর্ধশত অভিযান চালানো হয়। পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট র‌্যাব, কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন নাম দিয়ে এসব অভিযানে প্রায় অর্ধশতাধিক জঙ্গি নিহত হয়েছে। ধারাবাহিক অভিযানের মধ্যেও জঙ্গিরা নতুন কৌশলে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারাই বলছেন, জঙ্গিদের একেবারেই নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। তারা বিভিন্ন সময়ে নতুন করে সংগঠিত হওয়ার পাশাপাশি একাধিকবার চেষ্টা করেছে বড় ধরনের হামলা করার জন্য। তারা পুলিশের ওপর বিভিন্নভাবে ৫ বার হামলা চালিয়েছে।

গত ২৪ অক্টোবর বিকেলে পুলিশের কাউণ্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগ গাজীপুরের জয়দেবপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে নব্য জেএমবির সদস্য শেখ সোহান শাদ ওরফে সাইফুদ্দিন, ওরফে মোহান্না তারিককে গ্রেফতার করেছে। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী গ্রেফতার হওয়া তারিক ইসলাম ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়ে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার ষড়যন্ত্র করছিল। গাজওয়াতুল হিন্দ ও জিহাদের অপব্যাখ্যা দিয়ে নানা প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে জননিরাপত্তা বিপন্ন করার অপচেষ্টা করছিল। জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উগ্র মতাদর্শে বিশ্বাসী তার সহযোগীদের পোস্ট শেয়ার করত।

গত ১৬ অক্টোবর রাতে রাজধানীর গাবতলী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অভিযান চালিয়ে নব্য জেএমবির ৩ সদস্য গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলো- আবদুল্লাহ, সফিকুল ইসলাম ওরফে মোল্লাজী ও মোস্তফা হোসেন আরিফ। পুলিশের কাউণ্টার টেরোরিজম বিভাগ থেকে জানা গেছে, জঙ্গিরা উত্তরবঙ্গের একটি জেলা থেকে বাসে ঢাকায় আসে। তারা রাষ্ট্রবিরোধী গোপন পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র করার জন্য ঢাকায় মিলিত হচ্ছিল- এমন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তাদের গ্রেফতার করা হয়। তারা জিজ্ঞাসাবাদে নাশকতার পরিকল্পনার নানা তথ্য দিয়েছে। তারা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্য হওয়ার জন্য যোগাযোগ করেছিল। তারা ২০১৭ সালের শেষদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদর হাসপাতালের পাশে মহানন্দা নদীর পাড়ে নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠন নব্য জেএমবির এক সভায় জঙ্গি মহসিন ও বদরুলের মাধ্যমে জঙ্গি সংগঠনের সদস্যপদ গ্রহণ করে। তারা গোপন বৈঠকে উপস্থিত সংগঠনের আরও কয়েকজনের নামঠিকানা প্রকাশ করে। জঙ্গিরা শুধু বাংলাদেশই নয়, তারা সংঘবদ্ধ হয়ে ভারতের ঝাড়খন্ড, কেরালাসহ বিভিন্ন রাজ্যে ভারতীয় জঙ্গিদের সঙ্গে যৌথভাবে বোমা তৈরি ও অস্ত্র পরিচালনায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে বলে গ্রেফতারকৃত কয়েকজন জঙ্গি স্বীকার করে।

পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম গত ২ অক্টোবর বিকেলে খিলক্ষেত নিকুঞ্জ-২ এলাকায় অভিযান চালিয়ে হরকাতুল জেহাদের সৌদি ফেরত শীর্ষ জঙ্গি নেতাসহ তিন জঙ্গি সদস্যকে গ্রেফতার করে। তারা হলো- আতিকুল্লাহ ওরফে আসাদুল্লাহ ওরফে জুলফিকার, বোরহান উদ্দিন রাব্বানী ও মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন ওরফে শামীম। তারা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, জঙ্গি আতিকুল্লাহ ১৯৯৬ সালে হুজ্জির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিল। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথম দিকে সে দুবাই হয়ে সৌদি আরব পালিয়ে গিয়ে আত্মগোপন করে। সে সাংগঠনিক কাজে একাধিকবার পাকিস্তান গিয়েছিল। জঙ্গি আতিকুল্লাহ আফগানফেরত যোদ্ধা ও বোমা বিশেষজ্ঞ। দীর্ঘদিন পলাতক থেকে গত মার্চ মাসে দেশে ফিরে আবার সংগঠনের হাল ধরেছিল। বিচ্ছিন্ন থাকা জঙ্গিদের সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় এবং নতুন করে সংগঠনের সদস্য সংগ্রহের প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। আফগানিস্থানে যুদ্ধের সময় এ জঙ্গি পাকিস্তান, দুবাই ও সৌদি আরবসহ অন্যান্য দেশের জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। সেখানে ওসামা বিন লাদেন, মোল্লা ওমরসহ শীর্ষ জঙ্গিদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করে। তারা কাশ্মীর সমস্যা ও রোহিঙ্গা পরিস্থিতিকে পুঁজি করে নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে। জঙ্গিরা দেশে নাশকতার নানা পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র করছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করে।

পুলিশ কর্মকর্তাদের মতে, হলি আর্টিজানে ভয়াবহ হামলার পর থেকে সোমবার (২৩ ডিসেম্বর) পর্যন্ত জঙ্গিবিরোধী ২৮টি সফল অপারেশন চালানো হয়েছে। অভিযানের সময় বোমা ও বিষ্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে। জঙ্গি দমনে উল্লেখ্যযোগ্য অভিযানের মধ্যে গুলশানে হলি আর্টিজানে অভিযান, কল্যাণপুরে অপারেশন, আজিমপুরে অভিযান, নারায়ণগঞ্জে অপারেশন, টাঙ্গাইলে অপারেশন, আশুলিয়ায় অপারেশন, গাজীপুর, সিলেট, রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও র‌্যাব সফল জঙ্গিবিরোধী অপারেশন চালিয়েছে।

গত ১০ ডিসেম্বর জঙ্গিবিরোধী এক জাতীয় সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, সরকারের জঙ্গিবিরোধী ‘অলআউট’ প্রচেষ্টার কারণে বর্তমানে দেশে জঙ্গিবাদ একটা পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। জঙ্গিবিরোধী ওই সম্মেলনে পুলিশের আইজি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারি বলেন, আমরা উগ্রবাদীদের চিহ্নিত করি, মামলা দেই, গ্রেফতার করে জেলে দেই। কিন্তু কারাগারে তাদের সংশোধন হচ্ছে না। এ জায়গায় আমাদের কিছু কাজ করতে হবে। সরকারি-বেসরকারিভাবে কারাগারে জঙ্গিদের ডি-রেডিকালাইজড করা দরকার। আইজিপি বলেন, যারা জঙ্গিবাদের অভিযোগে কারাগারে যাচ্ছে এবং জামিনে ফিরে আসছে তাদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করতে হবে। জঙ্গিবাদ নির্মূলে মোটিভেশনাল কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।