প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর: পাওয়া না পাওয়ার কথা - এমএকে জিলানী
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে বাংলাদেশের প্রত্যাশা ছিল তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি, সীমান্ত হত্যা বন্ধ, সঙ্কট কাটাতে জ্বালানি (তেল) ও নিত্যপণ্যের চাহিদা পূরণ, রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে ভারতের নির্দিষ্ট অঙ্গীকার পাওয়া যাবে। দ্বিপক্ষীয় এসব ইস্যুতে এবার সমাধান না এলেও ভবিষ্যতে সমাধানের আশ্বাস দিয়েছে ভারত। অন্যদিকে এ সফরে বাণিজ্য সংক্রান্ত চুক্তি সেপা (কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট) এগিয়ে নিতে দুই পক্ষ সম্মত হওয়া এবং কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টনকেই ইতিবাচক ও প্রাপ্তি হিসেবে উল্লেখ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফরের অগ্রগতি মূল্যায়ন করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, যে সাতটি স্মারক সই হয়েছে তা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বহুমাত্রিকতা প্রমাণ করে। বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে এ সফরে যে অগ্রগতি হয়েছে তা ইতিবাচক। বাণিজ্য, যোগাযোগ এবং কানেক্টিভিটি নিয়ে দুই পক্ষ যেভাবে কাজ করতে সম্মত হয়েছে সেখান থেকে আমাদের স্বার্থ আদায় করতে হবে। ভারত তৃতীয় দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট কিছু স্থল, বিমান ও সমুদ্রবন্দর বিনা ট্রানজিট ফি-তে ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশকে প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু ওই বন্দরগুলোর নাম প্রকাশ করা হয়নি। বন্দরগুলোর নাম প্রকাশিত হলে বাংলাদেশ এখান থেকে কেমন সুবিধা পাবে তা নিশ্চিত হওয়া যাবে। চার দেশের মধ্যে গত ২০১৫ সালে যে গাড়ি চলাচল চুক্তি হয় (বিবিআইএন) তা বাস্তবায়নের জন্য আরও প্রত্যক্ষ উদ্যোগ এখন নেওয়া হবে বলে আশা করি।
এ অর্থনীতিবিদ বলেন, সেপা নিয়ে দুই পক্ষ একমত হয়েছে। এ চুক্তি করার জন্য এখন থেকেই কার্যক্রম শুরু হবে এবং বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণের সময় এ চুক্তি যাতে সম্পাদন হয় দুই পক্ষ সেভাবে কাজ করবে। এটা ইতিবাচক। বাংলাদেশ এখন সাফটার আওতায় ভারতে শুল্কমুক্ত পণ্যের সুবিধা পায়; কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণ ঘটার পর এ সুবিধা আর থাকবে না। তখন সেপা চুক্তি হয়ে গেলে বাংলাদেশ বাণিজ্যে সুবিধা পাবে। কিন্তু এ চুক্তির আগে বাংলাদেশকে খুব সতর্কভাবে ভারতের সঙ্গে দরকষাকষি করতে হবে। কেননা সেপা চুক্তির আওতায় ভারত বাংলাদেশকে সব পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিলেও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতকে সমানভাবে এ সুবিধা দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশও যদি ভারতকে সমান সুবিধা দেয় তবে বাণিজ্যে ভারসাম্য থাকবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফর প্রসঙ্গে সময়ের আলোকে বলেন, ‘যেকোনো দুটি দেশের প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে বসলে তার গুরুত্ব অনেক। এসব বৈঠকে অনেক চুক্তি হয়; কিন্তু সবসময়ই যে চুক্তিগুলো বড় মাপের হতে হবে, তা নয়। এমন বৈঠকে আগেই চুক্তি সংক্রান্ত কাঠামো প্রস্তুত করা থাকে। কিন্তু দুই প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে বসার পর যে আলোচনা হয় তা থেকে যেসব চুক্তিতে পরিণত হবে তা নয়। কিন্তু দুই দেশ সামনের দিনে কী করবে তা বুঝতে পারে এবং সেভাবেই তাদের ভবিষ্যৎ কাঠামো প্রস্তুত করে। এ হিসেবে আমরা জানি, জ্বালানি সঙ্কট থেকে শুরু করে নিষেধাজ্ঞা, বাণিজ্যে পেমেন্ট, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক- এগুলো শীর্ষ বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। এ আলোচনা থেকে দুই পক্ষ যেসব বিষয়ে সম্মত হয়েছে তা আমাদের আরও পর্যবেক্ষণ করতে হবে, কার্যত তারা কী করছে। সে জন্য সময় লাগবে। রোহিঙ্গা, তিস্তা ইস্যুতেও আলোচনা হয়েছে, এটাই গুরুত্বপূর্ণ। এসব ইস্যুতে চুক্তি না হলেও আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ।’
‘তিস্তা ইস্যু সমাধানে উদ্ভাবনী শক্তির ব্যবহার করতে হবে’ মন্তব্য করে অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘তিস্তার মতো দীর্ঘদিনের অমীংমাসিত ইস্যু সমাধান করার জন্য নতুনভাবে চিন্তা করা প্রয়োজন। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের ওপর সিকিমে তিস্তা নদীতে কমপক্ষে ৩০টি ড্যাম করা হয়েছে, গজলডোবায় তিস্তার পানি ধরে রাখতে জলাধার নির্মাণ করা হয়েছে। সুতরাং তিস্তা চুক্তি করতে হলে এসব ড্যাম বা জলাধার ভাঙতে হবে। কিন্তু ভারতের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। মাঝে মিডিয়ায় শুনলাম, তিস্তা অববাহিকা উন্নয়নে চীন বিনিয়োগ করতে চায়; কিন্তু ভারত এতে নাখোশ। আমি বলব, এসব ইস্যু সমাধানের জন্য দুই পক্ষকে আরও উদ্ভাবনী চিন্তাশক্তি ব্যবহার করতে হবে। চীন, ভারত, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ বহুপক্ষীয় সহযোগিতার মাধ্যমে এসব অমীমাংসিত ইস্যু সমাধান করা সম্ভব।’
এদিকে ভারত একাধিকবার সীমান্ত হত্যা বন্ধে অঙ্গীকার করলেও এখনও এ সমস্যা সমাধান হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরেও ভারত এ ইস্যুতে আবারও আশ্বাস দিয়েছে। অথচ গত আগস্টেও বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে দুই বাংলাদেশি নিহত হন। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সাল থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত পাঁচ বছর সাত মাসে সীমান্তে মোট ১৫৭ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এ সময়ে আহত হয়েছেন ১৩৭ জন, অপহৃত হয়েছেন ১১৯ জন। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রায় ৯০ শতাংশকে সীমান্তে গুলি করে হত্যা করা হয়। কিন্তু সীমান্তে মারণাস্ত্র (লেথাল উইপন) ব্যবহার না করার জন্য দুই পক্ষই অঙ্গীকার করেছে।
সীমান্ত হত্যা সম্পর্কে ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে সোনালি অধ্যায় চলমান। কিন্তু সীমান্তে হত্যা বন্ধ হচ্ছে না, এটা দুঃখজনক। বিষয়টা ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের মতো হয়ে গেছে, পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের শত্রুতা আছে; কিন্তু আমাদের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক। আবার ভারত-চীনের মধ্যে এত উত্তেজনার মধ্যেও অতীতে দুই পক্ষের সীমান্ত সংঘর্ষে যে ক’জন মারা গেছে তাদের কেউই গুলিতে মারা যায়নি। কারণ দুই পক্ষ চুক্তি করেছে, সীমান্তের দুই কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করবে না। পাকিস্তান ও চীন থেকে ভারতের সম্পর্ক বাংলাদেশে সঙ্গে অনেক উষ্ণ, আন্তরিক ও বিশ্বাসের। অথচ আমরা দুই পক্ষ এখনও সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে পারিনি।’
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সম্পর্কে সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও অধ্যাপক ড. মো. আমিনুল করিম সময়ের আলোকে বলেন, ‘এই সফরে বাংলাদেশ কিছু পেয়েছে বলে আমার মনে হয় না। আমাদের যে প্রত্যাশা তিস্তার পানি, সীমান্ত হত্যা বন্ধ, রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে কনক্রিট কিছু পাওয়া যায়নি। কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টন চুক্তিই একমাত্র পাওয়া। ভূ-রাজনৈতিক কারণে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত বাংলাদেশকে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করবে না। কারণ মিয়ানমারে তাদের বিনিয়োগ রয়েছে।’
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ভারতের কাছে তাদের রেলবন্দর ব্যবহারের সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ। ভারত বলেছে, তারা বিষয়টি যাচাই-বাছাই করে জানাবে। বাংলাদেশের এ প্রস্তাবে ভারত রাজি হলে তা আমাদের জন্য ভালো। ভারত তৃতীয় দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট কিছু স্থল, বিমান ও সমুদ্রবন্দর বিনা ট্রানজিট ফি-তে ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশকে প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু ওই বন্দরগুলোর নাম এখনও প্রকাশ করা হয়নি। তাই এ প্রস্তাব থেকে কেমন সুবিধা পাওয়া যাবে, তা বন্দরগুলোর তালিকা প্রকাশ হলে জানা যাবে। এ ছাড়া বাণিজ্য সংক্রান্ত সেপা চুক্তি এগিয়ে নিতে দুই পক্ষের সম্মতি ইতিবাচক।’
প্রধানমন্ত্রী চলমান দিল্লি সফর প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্তি সচিব ও রাষ্ট্রদূত মো, মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘এ সফরটা কনফিডেন্স বিল্ডিংয়ে কার্যকর হবে। সফরে যে অ্যাগ্রিমেন্ট সই হয়েছে সেগুলো আসলে কোনো ইস্যু নয়। অ্যাগ্রিমেন্ট সইয়ে কুশিয়ারার পানি বণ্টন চুক্তি ছাড়া বাকিগুলোর কোনো গুরুত্ব নেই। আলোচনা হয়তো সব বিষয়েই হয়েছে; কিন্তু যেগুলো ডেভেলপমেন্ট হয়েছে সেগুলোর মেজর কোনো গুরুত্ব নেই। এ ভিজিটের মেজর গুরুত্ব হচ্ছে দুই দেশ ও দুই সরকারের মধ্যে কনফিডেন্স বিল্ডিং। এ কনফিডেন্স বিল্ডিংয়ে কোনটার গুরুত্ব বেশি তা ভবিষ্যৎ বলবে। এ সফরে কী পাওয়া গেল আর পাওয়া গেল না, সে হিসাব-নিকাশের জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে। তবে দুই দেশের সরকারপ্রধানের মধ্যে এমন বৈঠক বা যোগাযোগ আরও বেশি হওয়া প্রয়োজন। এতে দুই পক্ষের অমীমাংসিত ইস্যুতে সমাধান করা সহজ হয়।’
বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএসআরএফ) আয়োজিত ‘বিএসআরএফ সংলাপ’-এ অংশ নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বুধবার বলেন, ‘তিস্তা এবার হয়নি, কুশিয়ারা হয়েছে। সাতটি সমঝোতা স্মারক ও ৫টি চুক্তি হয়েছে। আমরা খালি হাতে ফিরে আসিনি। আমি তো একটাতেই খুশি। বর্তমান সঙ্কট মোকাবিলার জন্য যা যা দরকার, যা যা আমরা চেয়েছি ভারত সবই দিয়েছে। কুশিয়ারা হয়েছে, তিস্তাও হবে।’ - দৈনিক সময়ের আলো ।
খালেদ / পোস্টকার্ড ;