প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ৬ ঘরের মধ্যে সীতাকুণ্ড ইউএনও-এসিল্যান্ডের স্বজনপ্রীতি !

প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ৬ ঘরের মধ্যে সীতাকুণ্ড ইউএনও-এসিল্যান্ডের স্বজনপ্রীতি !
প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ৬ ঘরের মধ্যে সীতাকুণ্ড ইউএনও-এসিল্যান্ডের স্বজনপ্রীতি !

মেজবাহ খালেদ ।।

নিজের ভূমি আছে, থাকার ঘরও আছে, তাছাড়া আছে দোকান এরপরও ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য বরাদ্দকৃত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর পেয়েছেন সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোঃ শাহাদাত হোসেনের গাড়ী চালক বেলাল হোসেন সম্রাটের স্ত্রী তাসলিমা আক্তার ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোঃ আশরাফুল আলমের গৃহপরিচারিকা পারভীন আক্তার।

সীতাকুণ্ড উপজেলার পৌর এলাকায় মাত্র ৬ টি ঘর বরাদ্দ দিতে গিয়ে ইউএনও-এসিল্যান্ডের ঘর নিয়ে এমন স্বজনপ্রীতি নজিরবিহীন দাবী এলাকাবাসীর ।

স্থানীয় সুত্রে জানা যায় , গত ২১ জুলাই সারাদেশে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ২৬ হাজার ২২৯ টি ভূমিহীন, গৃহহীন পরিবারকে জমিসহ গৃহ হস্তান্তর কার্যক্রম উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই তালিকায় সীতাকুণ্ড উপজেলার পৌরসভার মহাদেবপুর এলাকায় জমিসহ ৬ টি সেমিপাকা ঘর ৬টি পরিবারকে বুঝিয়ে দেয়া হয়। এই ৬টি ঘরের মধ্যে একটি ইউএনও মোঃ শাহাদাত হোসেন এর ব্যক্তিগত গাড়ি চালক বেলাল হোসেন সম্রাটের স্ত্রী তাসলিমা আক্তার, একটি এসিল্যান্ড মোঃ আশরাফুল আলম এর গৃহকর্মী পারভিন আক্তার ও একটি নন্দ রাণী দাসকে দেয়া হয়। অপর ৩ টি ঘর দেয়া হয় রোসন আরা বেগম, হাসিনা আক্তার ও নাছিমা বেগমকে। শেষের তিনজন পূর্ব থেকেই ওই খাসজমিতে দখলসূত্রে অবস্হান করে আসছিলেন।

এদিকে ইউএনও'র গাড়ি চালক বেলাল হোসেন সম্রাটের স্ত্রীর নামে ঘর বরাদ্দের বিষয়টি প্রকাশ্যে এলে এলাকায় নানান সমালোচনার জন্ম দেয়। কারণ বেলালের যেমন পৈতৃক বাড়ি রয়েছে তেমনি তার স্ত্রী তাসলিমারও পৈতৃক সূত্রে রয়েছে অঢেল সম্পত্তি।

এছাড়া গত কয়েক মাস পূর্বে বেলালের সহোদর দুই ভাইকে প্রতিষ্ঠিত করতে সীতাকুণ্ড উপজেলা গেইটের মতো জমজমাট ব্যবসায়িক কেন্দ্রে সড়ক ও জনপদের জায়গা দখল করে একটি দোকান নির্মাণেরও সুযোগ করে দেন ইউএনও মোঃ শাহাদাত হোসেন যা শুভ হোটেল নামে চলছে। এছাড়া ইউএনও তার অস্থায়ী গাড়ি চালক বেলালকে স্ত্রী-পরিজনসহ বসবাসের স্থান করে দিয়েছেন উপজেলা পরিষদের ভিতরে অবস্থিত সরকারি কর্মকর্তার জন্য বরাদ্দকৃত বাসায়। এ নিয়েও উপজেলার সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে চলছে কানাঘুষা ।

একদিকে সড়ক ও জনপদের জায়গা দখল করে ভাইদের জন্য দোকান অন্যদিকে স্ত্রীর নামে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বরাদ্দ। এ যেন বেলাল ও বেলালের পরিবারকে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়ার অঘোষিত এজেন্ডা। অথচ আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী বেলালের সীতাকুণ্ডের মুরাদপুরের দোয়াজি পাড়া এলাকায় নিজস্ব জমিতে রয়েছে সেমিপাকা প্রশস্ত পৈতৃক বাড়ি, আছে দোকান, গাড়িসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

অপরদিকে আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর পাওয়া সীতাকুণ্ডের এসিল্যান্ড মোঃ আশরাফুল আলমের গৃহপরিচারিকা পারভীন আক্তারের সীতাকুণ্ড উপজেলার মুরাদপুর ইউনিয়নে রয়েছে পৈতৃক সম্পত্তি। আছে স্বামীর বাড়ীও। বড় কর্তার গৃহপরিচারিকা হওয়ার সুবাধে সেই বেলালের একই কায়দায় উপজেলার সামনে সড়ক ও জনপদের জায়গা দখল করে স্বামীকে দোকান নির্মাণ করে দিয়েছেন পারভীন আক্তার। বেলাল স্ত্রীর নামে ঘর পেয়েছেন, আর পারভীন আক্তার পেয়েছেন স্বামীর নামে দোকান। মান্নান স্টোর নামে চলছে ওই দোকানটি। অবাক করা বিষয় সড়ক ও জনপদের জায়গা দখল করে গড়ে ওঠা শুভ হোটেল ও মান্নান স্টোর নামের দোকান দুটির অবস্থানও পাশাপাশি। এমনকি আশ্রয়ণ প্রকল্পে তাদের ঘর দুটিও সর্বাধিক সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।

সরেজমিনে শুক্রবার ( ১ নভেম্বর ) সীতাকুণ্ডের মহাদেবপুর ইকোপার্ক সড়কে অবস্থিত আশ্রয়ণ প্রকল্পে গিয়ে দেখা যায়, ইউএনও'র গাড়ি চালক বেলালের স্ত্রী তাসলিমা আক্তারের নামে বরাদ্দ হওয়া ঘরটি তালাবদ্ধ এবং তারা সেখানে থাকেননা বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পাওয়া লোকজন। বেলাল তার নিজস্ব ঘর বাড়ী থাকার কথা অস্বিকার করেছেন কিন্তু স্হানীয়রা বলছেন তাঁর পৈত্রিক জমিজমাসহ সেমিপাকা প্রশ্বস্হ ঘরবাড়ী ও সম্পত্তি আছে।

আশ্রয়াণ প্রকল্পে উপস্থিত থাকা এসিল্যান্ডের গৃহপরিচারিকা পারভীন আক্তার বলেন, মুরাদপুরে তার পৈতৃক অনেক সম্পত্তি রয়েছে। তবে সেসব সম্পত্তি নিয়ে নানান ঝামেলা পোহাচ্ছেন তিনি।

এদিকে আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘরের জন্য আবেদন করে কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও ঘর না পাওয়া এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেন, ‘আমার কোন ঘর নেই, বহু বছর ভাড়া ঘরে থাকি। সীতাকুণ্ডের স্থানীয় বাসিন্দা আমি। আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘর পেতে সকল প্রক্রিয়া শেষ করেও ঘর পাইনি।’

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে আরেকজন নারী বলেন, ‘আমি অনেক আগেই ভূমিহীন সনদ উপজেলায় জমা দিয়েছি। তবুও ঘর পাইনি। ভাড়া ঘরে থেকে নিদারুণ কষ্টে জীবনযাপন করছি।’

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ও সীতাকুণ্ড উপজেলার আশ্রয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব আলমগীর হোসেনের সাথে এসব বিষয়ে কথা হয় । তিনি বলেন, ‘কয়টি ঘর বরাদ্দ হয়েছে ও কাকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, আমি এসবের কিছুই জানি না। সেসব ইউএনও স্যার দেখেন। আমি শুধু নির্মাণের দায়িত্বে।’

এসময় উদ্বোধনের ৪ মাসের মধ্যে ঘরগুলো থেকে ঘুণ পড়তে দেখা ও নিন্মমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ কথা সত্য নয়, আপনি আবার গিয়ে দেখুন।’

সীতাকুণ্ডের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোঃ আশরাফুল আলম (এসিল্যান্ড) সব দায় ইউপি চেয়ারম্যানের ঘাড়ে চাপিয়ে বলেন, চেয়ারম্যানরা আমাদেরকে যাদের ভূমিহীন সনদ দিয়েছেন তাদের মধ্য থেকে যাচাই-বাছাই করে ঘর দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে এসিল্যান্ড অফিসের সম্মুখে সড়ক ও জনপদের জায়গা দখল করে গৃহপরিচারিকার দোকান নির্মাণের বিষয়টি তাকে অবহিত করলে তিনি বলেন, এটি আমার বিষয় না।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ শাহাদাত হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জনপ্রতিনিধিদের দেয়া ভূমিহীন সনদ দেখে আমরা গৃহহীন বাছাই করেছি। সেক্ষেত্রে বেলাল এর নিজস্ব বা পৈত্রিক জায়গা নেই। তাই তাঁকে দেয়া হয়েছে।

ইউএনও বলেন, তিনি বেলালকে ঘর দিয়েছেন কিন্তু ঘর দেখা গেছে তার স্ত্রী তাসলিমা আক্তারের নামে।

যে এলাকায় এ আশ্রয়ণ প্রকল্পের অবস্থান সে পৌর এলাকার জনপ্রতিনিধি ও মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা বদিউল আলম জানিয়েছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, আমার এলাকায় ১২২ জন গৃহহীন, ভূমিহীন রয়েছে। যাদের কেউই এ প্রকল্পে ঘর পায়নি।

উপজেলার গেইটে সরকারি জায়গা দখল করে গাড়ি চালক বেলালের দোকান নির্মাণ বিষয়ে ইউএনও বলেন, কাউকে এরকম দোকান করার কোন অনুমতি আমি দিইনি। যে যেদিকে খালি পেয়েছে সে সেখানে দোকান করেছে। উপজেলায় বেলালকে দেয়া কোয়ার্টার সম্বন্ধে জানতে চাইলে ইউএনও বলেন, ওইটি পরিত্যক্ত বাড়ী।

সীতাকুণ্ডের সংসদ সদস্য দিদারুল আলম বলেন, ঘর বরাদ্দে গৃহহীনদের যাচাই-বাছাই করার দায়িত্ব আমার নয়। ইউএনও-এসিল্যান্ডের কাছে গৃহহীনদের আবেদন জমা পড়লে সেগুলো থেকে বাছাই করে যাদের নাম প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানো হয় তারাই ঘর পান।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;