দেশের গার্মেন্টস মালিকদের এত লোভ, পিপিইর আড়ালে বানাচ্ছে অন্য পণ্য

দেশের গার্মেন্টস মালিকদের এত লোভ, পিপিইর আড়ালে বানাচ্ছে অন্য পণ্য

এসএম আলমগীর ।।

দেশের গার্মেন্টস মালিকরা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়েছে। করোনা মহামারীর মধ্যে সবাই যেখানে নিরাপদে থাকার চেষ্টা করছে,  সেখানে দেশের গার্মেন্টস মালিকরা ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) তৈরির আড়ালে অন্যান্য রফতানি পণ্য উৎপাদন করছে। এ ক্ষেত্রে শ্রমিকদের কারখানায় কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জসহ গার্মেন্টস অধ্যুষিত সব এলাকাতেই এভাবে গোপনে গার্মেন্টস কারখানায় কাজ চলছে বলে বিশ^স্ত সূত্রে জানা গেছে।

তা ছাড়া গত ২৫ মার্চ গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ ঘোষণা করার পর ৪ ও ৫ এপ্রিল লাখ লাখ শ্রমিক আবার ঢাকায় ডেকে আনায় দেশে করোনাভাইরাসের ঝুঁকি আরও বেড়েছে বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে। আর এর জন্য দায়ী করা হচ্ছে বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হককে। কারণ তিনি একেকবার একেক রকম ঘোষণা দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন বলে অভিযোগ করছেন গার্মেন্টস নেতারা। তারা বলছেন, বিজিএমইএ সভাপতি কখনও বলেছেন, কারখানা বন্ধ রাখার কথা আবার কখনও বলেছেন, কারখানা খোলা রাখার কথা। আবার গোপনে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে চিঠি দিয়ে কারখানা খোলার ব্যাপারে সহযোগিতা চেয়েছেন। কখনও তিনি কারখানা খোলা রেখে শ্রমিক আনা-নেওয়ার জন্য পরিবহন চেয়ে সরকারের কাছে চিঠি দিয়েছেন। তিনি এভাবে একেকবার একেকরকম সিদ্ধান্ত নেওয়ায় মালিক-শ্রমিক উভয়েই বিভ্রান্তিতে পড়েছে। এমনটিই জানালেন শ্রমিক নেতা ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুর রহমান।

এদিকে সোমবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে যোগ দিয়ে গাজীপুরের পুলিশ সুপার প্রধানমন্ত্রীকেও বিষয়টি অবহিত করেন। তিনি জানান, গাজীপুরে অনেক পোশাক শিল্প-কারখানায় ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) বানানোর কথা বলে অন্য পণ্য বানানো হচ্ছে। শ্রমিকদের ডেকে এনে কাজ করালেও তাদের বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছে না। অনেক প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধিও মানা হচ্ছে না। আগামীতে পোশাক কারখানা চালু করতে আরও শ্রমিকদের ডেকে আনা হলে স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বাড়তে পারে। এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করতে হবে।

পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হকের বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআরটিএ) দেওয়া একটি চিঠির পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরে আলোচনার সূত্রপাত হয়। বিজিএমইএ সভাপতি আগামী ২৬ এপ্রিল গাজীপুরে বেশ কিছু রফতানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার লক্ষ্যে শ্রমিকদের আনার জন্য বাসের ব্যবস্থা করতে এই চিঠি দেন।

কনফারেন্সে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের পর গাজীপুর ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় নতুন করে শ্রমিক আনা ঠিক হবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে শ্রমিকদের থাকা ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে সীমিত পরিসরে পোশাক কারখানা খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে নির্দেশনা দেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাজীপুরের এক থেকে দেড়শ’ কারখানায় পিপিইর আড়ালে গার্মেন্টস কারখানায় অন্য কাজ করা হচ্ছে। তা ছাড়া সাভার এলাকায় শতাধিক, আশুলিয়া এলাকার ৫০টি এবং নারায়ণগঞ্জ এলাকার ৫০টির মতো গার্মেন্টস কারখানায় অন্যান্য রফতানিযোগ্য পোশাক উৎপাদন করা হচ্ছে।

বিষয়টি নিশ্চিত করে গার্মেন্টস শ্রমিক নেতা বাহারানে সুলতান বাহার  জানান, এই মহামারী করোনার মধ্যে যেখানে জীবন বাঁচাতে সবাই নিরাপদে ঘরে থাকছে, সেখানে গার্মেন্টস মালিকরা শ্রমিকদের জোর করে কারখানায় কাজ করাচ্ছে। মালিকরা আসলে এখন ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়েছেন। তারা ওপরে ওপরে দেখাচ্ছেন তাদের কারখানা বন্ধ। আসলে তাদের কারখানা বন্ধ না, যেসব শ্রমিক বাড়িতে চলে গিয়েও গত ৪ ও ৫ এপ্রিল ঢাকায় চলে এসেছিল তাদের অনেককেই আর বাড়ি যেতে দেওয়া হয়নি। তাদের বলা হয়েছে, কারখানা খোলা থাকবে, কাজ চলছে তোমরা বাড়ি যেও না। এভাবে শ্রমিকদের আটকে রেখে পিপিই বানানোর কথা বলে কারখানায় অন্য পোশাক তৈরি করা হচ্ছে। এভাবে শ্রমিকদের আটকে কাজ করানো জুলুমের পর্যায়ে পড়ে।

অবশ্য বিজিএমইএ নেতারা বলছেন, বিষয়টি তাদেও জানা নেই। এ বিষয়ে বিজিএমইএ-এর সহসভাপতি আরশাদ জামাল জানান, কিছু কিছু কারখানা পিপিই উৎপাদনের জন্য খোলা রাখা হয়েছে। এর আড়ালে কোনো কারখানায় অন্য পণ্য উৎপাদন হচ্ছে কিনা বিষয়টি আমাদের জানা নেই। তবে আমরা বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখব।

বেতন দিতে ব্যর্থ কারখানার বিরুদ্ধে নেওয়া হচ্ছে আইনি ব্যবস্থা : এদিকে ১৬ এপ্রিলের মধ্যে যেসব কারখানা মালিক মার্চ মাসের বেতন দিতে ব্যর্থ হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার প্রস্তুতি চলছে। কলকারখানা অধিদফতর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। মহামারী করোনার প্রাদুর্ভাব কমাতে সারা দেশে চলছে সরকার ঘোষিত সরকারি ছুটি। বন্ধ আছে বাস, রেল, নৌসহ সবধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা। এ ছাড়া বন্ধ রয়েছে অধিকাংশ কল-কারখানা। এমন অবস্থায় বেতন না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে কারখানার শ্রমিকরা।

দুর্যোগের এই সময়ে শ্রমিকদের মার্চ মাসের বেতন গত ১৬ এপ্রিলের মধ্যে পরিশোধের জন্য মালিকদের নির্দেশ দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান। আরেক নির্দেশনায় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ১৬ তারিখের মধ্যেই বেতন-ভাতা দিয়ে দিতে বলেন। এ ছাড়া কারখানা মালিকদের বিভিন্ন সংগঠন থেকেও একই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।

তবে কারখানা মালিকরা বারবার বলছিলেন, ১৬ তারিখের মধ্যে বেতন দেওয়া সম্ভব নয়। কেননা বেতন শিট তৈরিসহ বিভিন্ন কাজের লোকজন ছুটিতে ঢাকার বাইরে অবস্থান করছে। এ ছাড়া ব্যাংকিং জটিলতাসহ নানা কারণে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে তারা বেতন দিতে পারবেন।

তবে ১৬ এপ্রিলের মধ্যে বেতন না দেওয়া কল-কারখানার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর। জানা গেছে, ঢাকা জেলা থেকে ১২২টি, গাজীপুর থেকে ১২০টি, নারায়ণগঞ্জ থেকে ৩০টি, চট্টগ্রাম থেকে ৫৮টি, পাবনা থেকে ৩টি, নরসিংদী থেকে ৬টি, ময়মনসিংহ থেকে ১১টি, মুন্সীগঞ্জ থেকে ১টি কারখানা মজুরি দেয়নি। এ ছাড়াও দিনাজপুর জেলা থেকে ৩টি, রংপুর থেকে ২টি, কুমিল্লা থেকে ৫টি, ফরিদপুর থেকে ৪টি, রাজশাহী থেকে ২টি, খুলনা থেকে ৩টিসহ মোট ৩৭০টি কল-কারখানার মালিকরা শ্রমিকদের মজুরি ও বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

এদিকে ৯০ শতাংশ গার্মেন্টসে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হয়েছে বলে দাবি করেছে বিজেএমইএ। সংস্থাটি জানায়, গতকাল পর্যন্ত বিজিএমইএভুক্ত মোট ২ হাজার ২৭৪টি কারখানার মধ্যে ২ হাজার ৫৬টি কারখানা বেতন-ভাতা পরিশোধ করেছে।

বাকি কারখানাগুলো আগামী ২২ এপ্রিলের মধ্যে বেতন-ভাতা পরিশোধ করবে বলে সংস্থাটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। বাকি কারখানার শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে জানায় সংস্থাটি।

করোনা পরিস্থিতিতে আইনের বাইরে এক সপ্তাহের বেশি সময়ে পেয়েও শিল্প শ্রমিকদের বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধে ব্যর্থ কারখানাগুলোর মালিকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থাসহ প্রতিষ্ঠানগুলোর লাইসেন্স নবায়ন স্থগিত করা হতে পারে।

এর আগে গত ৬ এপ্রিল বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক এবং বিকেএমইএ সভাপতি সেলিম ওসমান স্বাক্ষরিত যৌথ এক ঘোষণায় ১৬ এপ্রিলের মধ্যে শ্রমিকদের মার্চ মাসের বেতন পরিশোধে সদস্যদের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়।

এ ব্যাপারে বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বলেন, দ্রুতই বাকি কারখানার বেতন পরিশোধ করা হবে। কোনো শ্রমিকের চাকরি যাবে না। গার্মেন্টস বন্ধ থাকলে লে -অফের সুবিধা প্রদান করা হবে।