তাবিথের সংশয়ের লড়াই

তাবিথের সংশয়ের লড়াই
তাবিথের সংশয়ের লড়াই

সাব্বির আহমেদ ।।
 

অন্য দিনের মতো শুক্রবার দিনভর গণমাধ্যমে তেমন কথা বলেননি তাবিথ আউয়াল। ভোট নিয়ে সংশয় যে কাজ করছে, তা অনেকটাই টের পাওয়া গেছে।

তবে ভোটের প্রতিযোগিতায় সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করতে চান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ধানের শীষের এই মেয়র প্রার্থী। এ পর্যন্ত নগরীর প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার এলাকা হেঁটেছেন। পাড়া-মহল্লার অলিগলি চষে ধানের শীষে ভোট চেয়েছেন। ভয়ভীতিতেও সহজে হাল ছাড়তে চান না। ভোট থেকে সরিয়ে দেওয়ার শঙ্কা থাকলেও তাবিথ আউয়াল ভোটারদের কাছে ব্যক্ত করেছেন নগর পরিবর্তনের অঙ্গীকার।

প্রচারণা কার্যক্রমের নির্ধারিত সময় শুক্রবার সকাল ১০টার আগেই বনানী কবরস্থানে হাজির হন মেয়রপ্রার্থী তাবিথ আউয়াল। শুক্রবার ছিল বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী। মরহুমের কবর জিয়ারত করে ১৫তম দিনের নির্বাচনি প্রচারণা শুরু করেন তাবিথ। কবর জিয়ারতে যোগ দেন ঢাকা দক্ষিণের প্রার্থী ইশরাক হোসেনও। পরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের কবর জিয়ারত করেন বিএনপির এই দুই প্রার্থী। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে তাবিথ নির্বাচন করছেন উত্তর সিটিতে। ২০১৫ সালের নির্বাচনে তিনি ছিলেন আনিসুল হকের প্রতিদ্বন্দ্বী। প্রয়াত মেয়রের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর তার আত্মার মাগফিরাত কামনায় মোনাজাতেও অংশ নেন বিএনপির দুই প্রার্থী। বনানী কবরস্থানে তাবিথ তার নানা শাহজাহান ভুঁইয়া, নানি সালমা বেগম ভুঁইয়া, মামা ইশতিয়াক ফারুক ও মামি ফাহমিদা ফারুকের কবরও জিয়ারত করেন।

এর আগে কোকোর কবর জিয়ারত শেষে তাবিথ ও ইশরাককে পাশে রেখে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলগমীর বলেন, ভোট থেকে বিরত রাখার চেষ্টা চলছে। চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে নানাভাবে বিএনপির নগর বিজয়কে বাধাগ্রস্ত করার ষড়যন্ত্র করছে। তবে জনতার গণজোয়ারে ধানের শীষের বিজয় ঠেকানো সম্ভব নয়। মামলা-হামলা করেও লাভ হবে না।

তিনি বলেন, সিটি নির্বাচনে প্রতিযোগিতা থেকে সরিয়ে দিতে শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে। তাতে তাবিথ আউয়াল এবং ইশরাকের বিজয় ঠেকানো যাবে না।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক, হাবিবুর রহমান হাবিব, আবুল খায়ের ভূঁইয়া, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, হাবিব উন নবী খান সোহেল, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, ক্রীড়া সম্পাদক আমিনুল হক, নির্বাহী কমিটির সদস্য নাজিম উদ্দিন আলম, যুবদলের সভাপতি সাইফুল আলম নীরব, সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাহ উদ্দিন টুকু, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবু, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের ভুঁইয়া জুয়েল, যুবদল উত্তরের সভাপতি এসএম জাহাঙ্গীর হোসেনসহ বিএনপি ও তার অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা।

প্রায় ঘণ্টাখানেক কবরস্থানে থেকে একটি সাদা রঙের বিশাল গাড়ি (ঢাকা ১৪৫৮৬৩) নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তাবিথ আউয়াল নামেন ভোটের গণসংযোগে। তাবিথের নির্বাচনি মার্কা ধানের শীষের নামেই বাসটির নামকরণ করা। যে বাস তার ভোটের প্রচারণার কয়েকটি টিমকে বহন করে নিয়ে যায় মধ্য বাড্ডার লুৎফন শপিং কমপ্লেক্সের সামনে। যেখানে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিএনপির নেতাকর্মীরা জড়ো হন। নানা স্লোগানে মুখরিত করে তোলেন ছুটির সকালকে। এ সময় স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে দেখা গেছে অনেকটা মুক্ত উচ্ছ্বাস আর উদ্দীপনা। তারা খালেদা জিয়ার সালাম পৌঁছে দিয়ে ধানের শীষে ভোট চেয়েছেন। বন্দি নেত্রীর মুক্তিতে ক্ষণে ক্ষণে সরকারবিরোধী স্লোগান দেন।

বুক পকেটে ধানের শীষের প্রতীক সংবলিত হালকা পেস্ট রঙের পাঞ্জাবি, আর হাতে প্লাস্টিকের ধানের শীষের ছড়া নিয়ে তাবিথ পৌঁছান পথসভায়। এ সময় উপস্থিত নেতাকর্মীরা তাকে স্বাগত জানান।

পথসভার বক্তৃতায় ভোটে শঙ্কার কথা জানিয়ে বাড্ডাবাসীর কাছে ১ ফেব্রুয়ারি ধানের শীষে ভোট চান মেয়রপ্রার্থী তাবিথ।

তিনি বলেন, যত বাধাই আসুক মাঠে ছেড়ে যাব না, আমরা ধানের শীষকে বিজয়ী করতে মাঠে থাকব ইনশাআল্লাহ। কোনো বাধাই আমাদের সরাতে পারবে না। বিরোধী পক্ষ চেষ্টা করবে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দিতে, এ জন্য তারা হামলা করবে। কিন্তু ঢাকা নগরীকে সুন্দর করে সাজাতে হলে, ডেঙ্গুমুক্ত ঢাকা গড়তে হলে ধানের শীষে ভোট দিতে হবে।

নির্বাচিত হলে যেভাবেই হোক এ নগরী থেকে ডেঙ্গু রোগ নির্মূল করা হবে। ১ ফেব্রুয়ারি আমরা সবাই ভোট কেন্দ্রে যাব, ধানের শীষ প্রতীকে ভোট দেব। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে, তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে, সুন্দর-আধুনিক ঢাকা গড়তে ধানের শীষে ভোট দেওয়ার বিকল্প নেই।

বিএনপির এই প্রার্থী জানান, উত্তরের ৩২৫ কিলোমিটার হেঁটে নগরবাসীর দোয়া নিয়েছেন। মা-বোনদের কাছে ভোট চেয়েছেন।

বক্তৃতার শেষে তাবিথ উপস্থিত সবার কাছে প্রশ্ন রাখেন, ‘ঢাকাকে সুন্দর করে সাজাতে কোনো মার্কায় ভোট দেবেন? জবাবে ভোটাররা ধানের শীষে ভোট দেবেন বলে আওয়াজ তোলেন। এ সময় ২১নং ওয়ার্ডে বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থী ও তিতুমীর কলেজের সাবেক ভিপি এজিএম শামসুল হক, ৩২ নং ওয়ার্ডের দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থী মো. আলী হোসেন, ৩৮ নং ওয়ার্ডের জাহাঙ্গীর হোসেন মোল্লা, বিএনপির সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর প্রার্থী আয়েশা আক্তার মিলি ও পেয়ারা মোস্তাফা ও সালেয়া ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।

তাবিথের আগে পথসভায় বক্তব্য রাখেন জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব। তাবিথের জন্য ভোট চেয়ে তিনি বলেন, যারা মশা নিধনের টাকা মেরে খায় তাদের ব্যালটে জবাব দিতে হবে। ১ ফেব্রুয়ারি তাবিথ হবেন উত্তরের নগরপিতা।

ভোটের দিন পুলিশকে জনগণের পক্ষে কাজ করার আহ্বান জানান জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের এই শীর্ষ নেতা।

আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের বিরুদ্ধে নির্বাচনের আচরণ বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, নির্বাচন কমিশন যদি বিএনপির অভিযোগ আমলে না নেয়, তাহলে বিএনপির প্রার্থী ও নেতাকর্মীরাও একই কাজ করবে।

বক্তব্যের পরপর প্রার্থী তাবিথকে নিয়ে বাড্ডা রামপুরা মহাসড়কে নামেন আমির খসরুসহ অন্যরা। এ সময় তাবিথ হাত নেড়ে সবার কাছে ভোট চান। আর প্রচারণায় থাকা নেতাকর্মীরা সড়কের পাশের দোকানে, রিকশা-ভ্যানে ধানের শীষের লিফলেট বিলি করেন।

মধ্য বাড্ডা থেকে পুরো পথ হেঁটে তাবিথ ও তার সমর্থকরা পৌঁছান রামপুরা ব্রিজের কাছে। সড়কে প্রচারণার মিছিল চলার সময় এক সময় পুরো রাস্তা ব্লক হয়ে পড়ে। এ সময় পুলিশ সদস্যরা তাবিথের মিছিলকে এক পাশে সরিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক করেন।

প্রচারে পুরো সড়ক আটকিয়ে বিএনপি নির্বাচনি বিধি লঙ্ঘন করেছে কি না, জানতে চাইলে বনশ্রী বাস স্টপেজের সামনে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগ যা করছে, আচরণ বলতে এখন আর কিছু নেই। বিএনপি এখনও সংযত আছে।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু, বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ ও যুবদল সভাপতি সাইফুল আলম নীরবসহ অন্যরা তাবিথের মিছিলে ছিলেন।

পরে মিনিট দশেক রামপুরা ব্রিজের গোড়ায় নেতাকর্মীদের সঙ্গে খোশগল্পে মেতে উঠেন তাবিথ। অনেকের সঙ্গে সেলফি তোলেন। এ সময় তাবিথ সময়ের আলোকে বলেন, উত্তর সিটিতে অন্তর্ভুক্ত নতুন ওয়ার্ড নিয়ে আমার বেশ কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। রামপুরা ব্রিজ বাঁশেরকান্দি খালটি সংস্কার করব এবং বেদখল খালগুলোকে দখলমুক্ত করব।

পরে বনশ্রী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করেন তাবিথ আউয়াল। নামাজ শেষে মুসল্লিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় ও মুরুব্বিদের সঙ্গে কোলাকুলি করেন। কিছুক্ষণ পর মসজিদের সামনে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে কিছুটা হট্টোগোল ও ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। পরে ২২ নং ওয়ার্ডে বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী ফয়েজ আহমেদ ফারুক ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর নীলুফার নিলুফার ইয়াসমিন নিলুকে নিয়ে বনশ্রীর কয়েকটি সড়কে গণসংযোগ করেন তাবিথ। ঘণ্টা খানেক অলি-গলিতে ধানের শীষের লিফলেট বিলি করেন। প্রচার মিছিলের সামনে মাইকে তাবিথ আউয়াল ও বিএনপির বন্দনা করে ধানের শীষে ভোট চাওয়া হয়।

ধানের শীষ প্রার্থী ওপরে হাত নেড়ে ভোট চান। বাসার জানালার গ্রিলের ফাঁক থেকে অনেক নারী-পুরুষ তাতে সাড়া দেন। সি বøকের এক বাসার চার তলা থেকে ছোট্ট শিশু নাবিলা হাত নাড়লে তাবিথও হাত নেড়ে হাসি উপহার দেন। তাবিথের হাসির জবাবও দেয় নাবিলা। এ দৃশ্য সবার নজরকাড়ে।

এরপর সেখান থেকে কারওয়ান বাজার পেট্রোবাংলায় তার নিজ অফিসে মধ্যাহ্নভোজ সম্পন্ন করেন। পরে তাবিথ অফিসের সামনে সামনে থেকে বিকাল ৩টার পর আবার গণসংযোগ শুরু করেন। ২৬ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী আজিজুল রহমান মোছাব্বির ও সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ডের প্রার্থী রোকেয়া সুলতানা তামান্নাকে নিয়ে খ্রিস্টানপাড়া, তেজতুরি বাজার, ফার্মগেট হলিক্রস কলেজ রোড হয়ে তেজগাঁও রেলস্টেশন রোডের সামনে দিয়ে আবার কারওয়ান বাজারের পেট্রোবাংলা এসে পথসভা করেন।

এখানে তাবিথ আউয়াল বলেন, পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে লড়াই করে যাচ্ছি। খালেদা জিয়া যাতে এক মুহূর্তও কারাঅন্তরীণ না থাকেন, সে জন্য ভয়ভীতি উপেক্ষা করে ১ ফেব্রুয়ারি ধানের শীষে ভোট দিতে হবে।

তিনি বলেন, শহরে মানুষ চলতে ভয় পায়, এই ভয় দূর করতে হবে। কারওয়ান বাজারে চাঁদাবাজি হয়, রয়েছে মাদকের ছড়াছড়ি। এতে তরুণদের ভবিষ্যৎ বিপর্যয়ের মুখে। এসবে জড়িয়ে রেখে তরুণদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা হচ্ছে। কারওয়া বাজারে পার্কিং সমস্যা আছে। স্থায়ী ট্রাক স্ট্যান্ড নেই। তাহলে আমরা কীসের উন্নয়নের কথা বলছি। কী উন্নয়ন হয়েছে?

আর এ পথসভার মধ্য দিয়ে শেষ হয় বিএনপি প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের শুক্রবারের নির্বাচনি প্রচারণার আনুষ্ঠানিকতা। এ সময় বিএনপি নেতা হাবিবুর রহমান হাবিব, নজরুল ইসলাম মঞ্জু, শফিউল বারী বাবু, আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল, আবদুল আউয়াল খান, আহসান উদ্দিন খান শিপন ও আবদুল হালিম খোকন উপস্থিত ছিলেন।

অন্যদিকে তাবিথ আউয়ালের মা নাসরিন ফাতেমা আউয়াল দুপুর ৩টায় গুলশান-১ নম্বরের পুলিশ প্লাজা থেকে গণসংযোগ শুরু করেন। তার সঙ্গে মহিলা দলের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।