নামজারিতে ঘুষ কত দিতে হবে বলে দিলেন এসিল্যান্ড !

নামজারিতে ঘুষ কত দিতে হবে বলে দিলেন এসিল্যান্ড !
নামজারিতে ঘুষ কত দিতে হবে বলে দিলেন এসিল্যান্ড !

শাহনেওয়াজ খান সুমন ।। 

জমির নামজারি করতে সরকার নির্ধারিত ফি ১ হাজার ১৭০ টাকা। অতিরিক্ত টাকা না দিলে দিনের পর দিন ঘুরলেও মেলে না সেবা। বিভিন্ন অজুহাত ও হয়রানির হুমকি দিয়ে ঘুষ আদায়ের অভিযোগ বেশ পুরোনো। এবার সরকার নির্ধারিত ফির প্রায় পাঁচগুণ টাকা ঘুষ হিসেবে নেওয়ার হার নির্ধারণ করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে এক সহকারী কমিশনারের (ভূমি) বিরুদ্ধে।

পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার ইউনিয়ন পর্যায়ের ভূমি সহকারী কর্মকর্তাদের জমির নামজারিতে ৬ হাজার টাকা করে নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন মাসুদুর রহমান নামে ওই কর্মকর্তা। তিনি নাজিরপুরের এসিল্যান্ড। ওই বৈঠকের একটি অডিও কথোপকথন এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।

জানা যায়, জমি খারিজ বা নামজারি করতে সরকার নির্ধারিত খরচ ১ হাজার ১৭০ টাকা হলেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভূমি কার্যালয়গুলোর কর্মকর্তারা দলিলভেদে নেন ৫ হাজার থেকে ১৮ হাজার টাকা পর্যন্ত। অথচ নামজারির আবেদনের জন্য কোর্ট ফি ২০ টাকা, নোটিশ জারি ফি ৫০ টাকা, রেকর্ড সংশোধন বা হালকরণ ফি ১ হাজার টাকা ও প্রতি কপি মিউটেশন খতিয়ান সরবরাহ বাবদ ১০০ টাকার বাইরে আর কোনো খরচ নেই। চাহিদা অনুযায়ী ঘুষ না দিলে ভূমি কার্যালয় থেকে জমির নামজারি করতে পারেন না নাগরিকরা।

কোনো কারণে জমি হস্তান্তর হলে খতিয়ানে পুরোনো মালিকের নাম বাদ দিয়ে নতুন মালিকের নাম প্রতিস্থাপন করানোকে বলে নামজারি। উত্তরাধিকার সূত্রে, বিক্রয়, দান, খাসজমি বন্দোবস্তসহ বিভিন্ন ধরনের হস্তান্তরের কারণে জমির মালিকানা বদল হয়। কিন্তু জমির নামজারি না করানো হলে মালিকানা দাবি করার ক্ষেত্রে অনেক জটিলতা তৈরি হয়। জমি রেজিস্ট্রেশন, জমি ক্রয়-বিক্রয়, খাজনা প্রদানসহ নানা ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় নামজারি। জমি হস্তান্তর হওয়ার পর নামজারি করা অনেকটাই বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসে নির্ধারিত আবেদনপত্রে নামজারির জন্য আবেদন করতে হয়।

অডিও কথোপকথন থেকে জানা যায়, নাজিরপুর উপজেলার ইউনিয়ন পর্যায়ের ভূমি সহকারী কর্মকর্তাদের নিয়ে গত জুলাইয়ে বৈঠক করেন উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) মাসুদুর রহমান। ওই বৈঠকের একটি অডিও ফাঁস হয়েছে। বৈঠকে তিনি ভূমি সহকারী কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘এখন আমাকে পরিষ্কার করে একটি বিষয় আপনাদের অবগত করতে হবে, আমি ইউএনও স্যারের চাপে আছি। ধরেন, আমার অফিস থেকে নামজারিতে অতিরিক্ত আদায় বন্ধ করা হলো। আপনারা পার কেইসে যে ডিল করেন। এটা আপনারা নিশ্চিত করবেন কীভাবে যে আপনারা টাকা নিচ্ছেন না। আপনাদের মতামত শুনি। আপনারা কী চান। কত করে নেওয়া হোক? খোলামেলা আলোচনা করেন, মতামত দেন—সবাই এখানে উপস্থিত আছেন। যদি বলেন স্যার, আপনি যদি না করে দেন, তাহলে নিশ্চিত করব আমরা কোনো টাকা-পয়সার লেনদেন করব না। কিন্তু বাস্তবে এটা কখনো হবে না। আপনারা মাঠপর্যায়ে কাজ করেন। কাজ করতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই মানে খরচা আছে এবং বিভিন্ন ধরনের বিষয় আছে। যেটার কারণে এটা নিতে হচ্ছে বা নিচ্ছেন। এটা কমবেশি সবাই নিচ্ছে। কিন্তু এটা যে এই অফিসে দেওয়া হইতেছে বিধায় আপনারা এটাকে বড় আকারে একটা কিছু করবেন, এই ধরনের অভিযোগ আসলে আমার জন্য বিব্রতকর।’

এ সময় ইউনিয়ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা তাদের মতামত তুলে দেন। এক ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তার কাছে এসিল্যান্ড জানতে চান, ‘ধরেন একজনের দুই একর জমি আছে, তার কাছ থেকে নামজারির ক্ষেত্রে কত টাকা নেবেন? যেহেতু তার জমি বেশি, তার কাছ থেকে বেশি টাকা নেবেন, এ রকম।’ ওই ইউনিয়ন কর্মকর্তা বলেন, ‘সবার জন্য সমান হওয়া উচিত।’ এ সময় বৈঠকে উপস্থিত আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘আগে ৫ হাজার ছিল, আপনি অনুমতি দিলে এখন ৪ হাজার নিতে পারি। আপনি স্যার যেভাবে নির্দেশনা দেবেন, আমরা সেইভাবে করব।’ এরপর এসিল্যান্ড বলেন, ‘ধরেন আমি ৪ হাজার করে নির্ধারণ করে দিলাম। আপনারা কত করে ডিল করবেন। ক্লিয়ার কথা বলেন। প্রয়োজনে কথাগুলো রেকর্ড থাকবে।’ তখন একজন ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা বলেন, ‘সর্বোচ্চ ৬-এর বেশি আমরা নেব না।’

এসিল্যান্ড মাসুদুর রহমান বলেন, ‘আপনারা সঠিকভাবে বলেন, আপনারা কত টাকা করে নিতে চান। যে স্যার এই টাকা না হলে আমাদের আসলে চলবে না। আমি আমার দিক থেকে প্রস্তাব করব আপনারা সাড়ে ৫ হাজার করে নেন। আমার এখানে ৪ হাজার দেবেন। আপনারা দেড় হাজার নেবেন।’

এরপর বৈঠকে উপস্থিত ইউনিয়ন পর্যায়ের সব কর্মকর্তা একমত হন দলিলপ্রতি ৬ হাজার টাকা করে নেওয়ার। এ সময় একজন ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা বলেন, ‘স্যার ৬ হাজার।’ তখন এসিল্যান্ড বলেন, ৬ হাজার মানে ৬ হাজারই। ৬ হাজার ১০০ টাকা হলে পরবর্তী সময়ে আমি ব্যবস্থা নেব। গত অর্থবছর পর্যন্ত যেগুলো ছিল, সেটা এ সপ্তাহের মধ্যে ক্লিয়ার করবেন। প্রতি মাসের মাস শেষ হওয়ার পর নতুন মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে হিসাব ক্লোজ করে রোববারের মধ্যে আমাকে হিসাব বুঝিয়ে দেবেন। জুলাই মাস শেষ হলে যত মামলার হিসাব হবে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে এটাকে ক্লিয়ার করে পরের রোববার উপস্থাপন করবেন। এ সামারি। এ ছাড়া একটা রেজিস্টার রাখবেন। যেটা ইন্টার্নাল ব্যবহারের জন্য।’

নাজিরপুরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাসুদুর রহমান বলেন, ‘অডিওটা শুনেছি, এটা দুঃখজনক। তাদের সঙ্গে এমন কোনো আলোচনা আমার হয়নি। আমি এখানে নতুন এসেছি। খাসজমি উদ্ধারসহ কিছু কার্যক্রম বন্ধ ছিল। সেই কার্যক্রমগুলো শুরু করতে গিয়ে দেখি যে বিভিন্ন ধরনের রোষানলের শিকার হচ্ছি। অডিওতে এখানে বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা আছে, এটা কোন জায়গায়, কোন প্রেক্ষিতে করা হয়েছে, এটাও আমি পুরোপুরি বুঝতে পারছি না। আমি সিনিয়র স্কেল পরীক্ষার জন্য এই মুহূর্তে ঢাকায় অবস্থান করছি। পরীক্ষা দিয়ে আগামী মঙ্গলবার স্টেশনে যাব। গেলে বুঝতে পারব, বিষয়টি কী হয়েছে।’

নাজিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সঞ্জীব দাশ বলেন, ‘এক দিন আগে বিষয়টি জেনেছি। অভিযোগটি খুব গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’

পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহেদুর রহমান বলেন, ‘অডিও কথোপকথনটি আমিও শুনেছি। বিষয়টি কী, তা তদন্তের জন্য দুই সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানান তিনি । কালবেলা

খালেদ / পোস্টকার্ড;