হারিয়ে গেছে সীতাকুণ্ডের সেই পরাগ সিনেমা 

হারিয়ে গেছে সীতাকুণ্ডের সেই পরাগ সিনেমা 
হারিয়ে গেছে সীতাকুণ্ডের সেই পরাগ সিনেমা 

এম কে মনির , সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি ।। 

সীতাকুণ্ডের শুকলাল হাঠের পরাগ সিনেমার কথা শুনেনি এমন মানুষ এ অঞ্চলে খুঁজে পাওয়া ভার। বাংলাদেশের জনপ্রিয় সিনেমা হলগুলোর মধ্যে উত্তর চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার পরাগ সিনেমা হল একটি। ৭০ এর দশক থেকে ৯০ এর দশক পর্যন্ত পরাগ সিনেমা হল ছিলো সীতাকুণ্ড-মিরসরাইয়ের একমাত্র বিনোদন কেন্দ্র। সেসময় দিন ছিলো পরাগ সিনেমার। ছিলোনা কোন টেলিভিশন কিংবা ইন্টারনেট। হলে গিয়ে বাংলা সিনেমা দেখতো গ্রাম গঞ্জের মানুষেরা। কাজ থেকে একটু অবসর পেলেই পরাগ সিনেমায় ভিড় করতো।বাড়িতে নতুন বউ তুলে আনার কদিন পরেই স্বামী-স্ত্রী রিকশার ঘোমট ফেলে পরাগ সিনেমা হলে রওয়ানা হতো।সেসময় পরাগ সিনেমা হল ছিলো বেশ জাঁকজমক।হলের দুই পাশে টিকিটের জন্য লম্বা লাইন দাঁড়ানো থাকতো।হলের একটি টিকিট তখন ছিলো সোনার হরিণ।কেননা সেসময় পরাগের টিকিট পাওয়া ছিলো সৌভাগ্যের বিষয়।অনেকেই বহুদূর থেকে এসেও টিকিট পেতো না। ভারাক্রান্ত মনে ফিরে যেতে হতো ঘরে।হলে ঢোকার জন্য নানা চেষ্টা থাকতো একটা মহলের।স্থানীয়রা আধিপত্য দেখিয়ে হলে আগে ঢুকতো।অনেকেই তখন হলে ঢোকার জন্য আধিপত্যবাধীদের দলে ভিড় করতেন।তখনকার সময় সিনেমা হলকে কেন্দ্র করে একটা অনিয়ম চলতো।একটা পক্ষ ১-২ টাকা বেশি দিয়ে সব টিকিট কিনে নিতো। পরে সেগুলো জনগণের কাছে বেশি দামে বিক্রি করতো।সব টিকিট বিক্রির পর হলের দরজা বন্ধ করা হতো।লাল -নীল আলোয় জ্বলজ্বল করতো পুরো হলঘর।পর্দা সরে গেলেই শুরু হতো বাংলা সিনেমা।

তৎকালীন সময়ের বাংলা সিনেমার অন্যতম জনপ্রিয় হিরু ছিলেন নায়ক রাজ্জাক আর নায়িকা থাকতো কবরি।এই দুজনের প্রেম কাহিনীতে উত্তেজিত হয়ে ওঠতো সিনেমা হল।কথিত আছে নায়ক রাজ্জাক যখন নায়িকা কবরিকে আলিঙ্গন করতো তখন হলে থাকা দম্পতি জোড়া প্রেমের সাগরে ভাসতো। শুধু রাজ্জাক ও কবরি নয়,শাবানা, আলমগীর, উজ্জল, ববিতা, সুচরিতা, জাফর ইকবাল, সোহেল রানা, জসিম, রোজিনা, শম্পার মনমাতানো অভিনয়ে কাঁপতো পরাগ সিনেমা হলের দর্শক গ্যালারি।

তবে কি মনে আছে ভরা যৌবনের সেই স্মৃতিময়  পরাগ সিনেমার কথা।বর্তমান প্রজন্ম  ভুলে গেলেও ভুলেনি ৭০-৯০ এর দশকের মানুষেরা।তবে তাদের সেই পরাগ সিনেমার আলো এখন আর জ্বলে না।আধুনিক ডিশের দাপটে পরাগ সিনেমা হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে।

একসময়ের বেশ জনপ্রিয় ও ব্যস্ত পরাগ সিনেমা হল এখন কেবলই জরাজীর্ণ পুরাতন ভবন। শেওলা আর আগাছায় ছেয়ে গেছে পুরো সিনেমা হল।লতাপাতা আর গাছগাছালি ঘিরে ধরেছে পরাগকে।তাই এখন আর কেউ পরাগের খোঁজ রাখেনা।পরাগ এখন নিস্তেজ ও নিস্তব্ধ। পরাগের লাল নীল জোনাকি বাতি নিভে গেছে চিরতরে।নিভে গেছে পরাগের মালিকের জীবনের আলোও।আজ থেকে ৭-৮ বছর আগে তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তবে তার প্রতিষ্ঠিত পরাগ সিনেমা হল  দেখলেই তার কথা মনে পড়ে।

অনুসন্ধানে জানা  গেছে, ১৯৭৭ সালে  মহানগর গ্রামের প্রখ্যাত মীর সিরাজুল ইসলাম পরাগ সিনেমা হল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।পরাগ সিনেমা হলের ব্যবসা বেশ ভালোই চলছিল।তৎকালীন সময়ের একমাত্র বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে পরাগ সিনেমা হল।সময়ের প্রেক্ষাপটে ২০০৮ সালে ডিশ সংযোগের আবির্ভাব হলে পরাগ সিনেমা হল আস্তে আস্তে তার জৌলুস হারাতে থাকে।ঘরে বসে সিনেমা দেখার সুযোগ যেদিন মিলেছে সেদিন পরাগ সিনেমার ভাগ্যে খরা পড়েছে।কমেছে দর্শক।ধীরে ধীরে কমতে থাকে সিনেমা হলের জাঁকজমকতা।লোকসানের একপর্যায়ে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন মালিক সিরাজুল ইসলাম। সেই থেকে পরাগ সিনেমা হল আর খুলেনি।পরাগের তালার জং মোছারও আর প্রয়োজন হয়নি।কেননা মানুষ ঘরে বসেই সিনেমা দেখার সুযোগ পাচ্ছে। আধুনিক ইন্টারনেট বিশ্বকে এনেছে হাতের মুঠোয়।

পরাগ সিনেমার বিষয়ে সীতাকুণ্ড পৌরসভার উত্তর ইদিলপুর গ্রামের ব্যবসায়ী নুর ইসলাম  বলেন, তখনকার সময়ে আমরা প্রায় সিনেমা দেখতে যেতাম।আমাদের বিনোদন মানেই ছিলো পরাগ সিনেমা হল। পরাগ সিনেমাকে নিয়ে আমাদের উৎসাহের কমতি ছিলোনা।সারাদিন কাজ করে পরাগে একবার হলেও যেতাম।

ষাটোর্ধ নুর মোহাম্মদ বলেন,আমরা তখন রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতাম।পরাগের সামনে রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম।হল ভাঙলে ভাড়া হতো।কতো যে নব দম্পতিকে ঘোমট ফেলে আনা নেওয়া করেছি তার কোন হিসাব নেই।সেগুলো এখন শুধুই স্মৃতি। সেই স্মৃতিচারণ করলে এখনো যৌবনের গল্পগুলো চোখের সামনে ভাসে।

এ বিষয়ে সীতাকুণ্ড নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সদস্য সচিব লায়ন গিয়াস উদ্দিন বলেন, বহুবার পরাগে সিনেমা দেখেছি।সকাল ৯-১২টা, বিকাল ৩-৫ টা ও রাত ৯-১২ টা সিনেমা হল চলতো।দীর্ঘ সারি থাকতো টিকিটের জন্য।৩ ও ৫ টাকা ছিলো টিকিট। পরে দাম বেড়ে তা ৭ ও ৯ টাকায়  দাঁড়ায় । নায়ক রাজ্জাক ও ববিতার সিনেমা বেশ জনপ্রিয় ছিলো।বর্তমানে সিনেমা হলটি একটি কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দিয়েছে এটির মালিক।

এ বিষয়ে পরাগ সিনেমা হলের মালিক মীর সিরাজুল ইসলামের পুত্র মীর  সুমন বলেন, আমার শ্রদ্বেয় পিতা পরাগের মূল স্বত্বাধিকারী।আমরা এটি বিক্রি করে দিয়েছি ক্লিপটন গ্রুপের কাছে ।