সাংবাদিক গোলাম সারোয়ারকে অপহরণ: ‘তথ্যগত ভুল’ দেখিয়ে পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদন

সাংবাদিক গোলাম সারোয়ারকে অপহরণ: ‘তথ্যগত ভুল’ দেখিয়ে পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদন
সাংবাদিক গোলাম সারোয়ারকে অপহরণ: ‘তথ্যগত ভুল’ দেখিয়ে পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদন

বিশেষ প্রতিবেদক ।।

সাংবাদিক গোলাম সারোয়ারকে অপহরণের মামলার অভিযোগে ‘তথ্যগত ভুল’ আছে জানিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে কোতোয়ালী থানার পুলিশ।

গত ৯ মে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা কোতোয়ালী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ধর্মেন্দু দাশ৷ এর আগে গত ৫ মে বিষয়টি লিখিতভাবে মামলার বাদি গোলাম সারোয়ারকে তিনি অবহিত করেন।

এতে এসআই ধর্মেন্দু দাশ লিখেছেন, ‘তদন্ত সমাপ্ত হয়েছে৷ সকল প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণে মামলাটি তথ্যগত ভুল মর্মে প্রতীয়মান হওয়ায় আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে।’

এ ব্যাপারে তদন্তকারী কর্মকর্তা ধর্মেন্দু দাশ বলেন, ‘মামলাটিতে তথ্যগত ভুল ছিল। তদন্তে যা পেয়েছি, তাই চূড়ান্ত প্রতিবেদনে দিয়েছি।’

গত বছরের ৪ নভেম্বর অপহরণ করে নির্যাতন করার অভিযোগে কোতোয়ালী থানায় অজ্ঞাত ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন সাংবাদিক গোলাম সারোয়ার। তিনি সাপ্তাহিক আজকের সূর্যোদয়ের চট্টগ্রাম অফিসে কর্মরত এবং সিটিনিউজবিডি নামে একটি অনলাইন পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক।

এর আগে গত বছরের ১ নভেম্বর রাত পৌনে ৮টার দিকে সীতাকুণ্ডের কুমিরা বাজারের খালের পাশে আহত অবস্থায় পাওয়া যায় সারোয়ারকে। তাকে উদ্ধারের পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

এর আগে ২৮ অক্টোবর রাতে চট্টগ্রাম শহর থেকে গ্রামের বাড়ি চন্দনাইশ যাওয়ার সময় নগরের কাজির দেউড়ি এলাকা থেকে দুর্বৃত্তরা তাকে অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালায়।

মামলার আগে সাংবাদিক সারোয়ারকে জীবিত উদ্ধার এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলে চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন। একপর্যায়ে সাংবাদিক সমাজ চট্টগ্রাম মহানগর কমিশনারের অফিস ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে।

সারোয়ারের অভিযোগ, আসামি চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে তদন্ত কর্মকর্তাকে গুরুত্বপূর্ণ আলামত সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজসহ অপহরণকারীদের সম্পর্কে সব ধরনের তথ্য দিলেও তদন্তকারী কর্মকর্তা রহস্যজনক কারণে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে সারোয়ার  বলেন, ‘ঘটনা তদন্তের এক পর্যায়ে এসআই ধর্মেন্দু দাশ আমাকে বলেন- একটি ব্যাংকের পরিচালকের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তারা খুব প্রভাবশালী। তারা কাউকে অপহরণ করলে জীবিত ফেরত আসার কথা না। এক্ষেত্রে আপনি (সারোয়ার) ভাগ্যবান।’

এ ব্যাপার জানতে চাইলে এসআই ধর্মেন্দু দাশ বলেন, ‘এটি আমার ব্যক্তিগত মতামত ছিল। প্রভাবশালীদের অপরাধের উদাহরণ দিতে গিয়ে আমি সাংবাদিক সারওয়ারকে এমনটা বলেছিলাম।’

গোলাম সারওয়ার বলেন, ‘অপহরণের পর ওরা আমাকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে দফায় দফায় পিটিয়েছে। আমার অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে কয়েকটি নিউজ করেছিলাম। এরপর আমার মোবাইলে কয়েকবার অজ্ঞাত ব্যক্তির ফোন এসেছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘নিউজগান গরি ভালা ন গরো’। এসব ফোনকল চেক করা যেতে পারে।’

‘অপহরণের পর ওরা এটাও বলেছিল, ‘আর নিউজ করবি কি না বল?’ ওদের বারবার বলেছি, নিউজ করব না, প্লিজ আমাকে ছেড়ে দেন। তারপরও পিটিয়েছে। চোখে হাত দিতে দেয়নি। ওরা বলাবলি করছিল, ‘এটাকে স্যাম্পল হিসেবে নিয়েছি। মেরে ফেলার দরকার নাই। সাইজ করো।’ বলেন সারওয়ার।

অপহরণের ঘটনার আরও বর্ণনা দিয়ে সারওয়ার জানান, ২৮ অক্টোবর রাতে, কর্মস্থল থেকে তিনি বাসায় যান। গ্রামের বাড়ি চন্দনাইশে যাওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি বাসা থেকে বের হন রাত আনুমানিক ১১টা ৫৫ মিনিটে। নগরের চট্টশ্বরী রোডে গুলশান ক্লাবের নিচ থেকে একটি মোটরসাইকেল ভাড়া করেন। মোটরসাইকেলে নতুন ব্রীজ যাওয়ার জন্য তিনি রওয়ানা দেন। কাজীর দেউড়ি এলাকার ভিআইপি টাওয়ার সামনে পৌঁছামাত্র অজ্ঞাত মোটরসাইকেল চালক সারোয়ারের মোটরসাইকেল থামিয়ে দেন। আরেকজন তার মোটরসাইকেলের সিটের পিছনে উঠে পড়েন। এক পর্যায়ে তার মুখে ও নাকে চেতনানাশক ওষুধ লাগিয়ে দেন। জ্ঞান হারান সারোয়ার। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে দেখেন যে, তার চোখ ও পা বাধা। তখন বুঝতে পারলেন তিনি অপহরণের শিকার হয়েছেন।

গত ১ নভেম্বর সন্ধ্যায় সীতাকুন্ড থানাধীন কুমিরা এলাকায় তাকে ফেলে যায় অপহরণকারীরা৷ স্থানীয়দের সহায়তায় পুলিশ তাকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করায়।

মামলা দায়েরের পর গত ১০ নভেম্বর মো. শাহীন ও মো. ইব্রাহীম নামে দুই আসামিকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। গ্রেপ্তারের পর তারা জামিন লাভ করেন। জামিন হওয়ার পর গত ২২ ডিসেম্বর ওই দুজনকে ৫ দিনের রিমান্ডে নিতে তদন্তকারী কর্মকর্তা ধর্মেন্দু দাশ আবেদন করেন।

সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার বলেন, ‘অপহরণ করে নির্মম নির্যাতনের পর আমার বিরুদ্ধে দেয়া হয়েঠে দুটি মানহানি মামলা৷ অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিচার পাওয়া তো দুরের কথা৷ নিজেই হয়ে গেলাম মামলার আসামি। আমি এবং আমার স্ত্রী, সন্তান খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছি। অপরাধ না করে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। আমি বাঁচতে চাই। সুন্দর একটি জীবন চাই।’