সীতাকুণ্ডে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ

সীতাকুণ্ডে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ
সীতাকুণ্ডে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ

এম. ইব্রাহিম খলিল, সীতাকুণ্ড ।।

যাদের রক্তের বিনিময়ে দুই যুগের পাকিস্তানি শাসনের অবসান ঘটেছিল, বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটেছিল বাংলাদেশের, মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের ৫১ তম বার্ষিকীতে সেই বীর সন্তানদের স্মরণ করছে সীতাকুণ্ডবাসী।

সীতাকুণ্ডে যথাযগ্য মর্যাদায় মহান বিজয় দিবস উৎযাপিত হয়েছে। ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির সূচনা হয়। শুক্রবার (১৬ ডিসেম্বর) সকালে সীতাকুণ্ড কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পন করে মহান শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।

সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রাম -৪ (সীতাকুণ্ড) আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব দিদারুল আলম , মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ড, সীতাকুণ্ড উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব এস এম আল মামুন, পৌর মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা বদিউল আলম, সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহাদাত হোসেন এর নেতৃত্বে উপজেলা প্রশাসন,ওসি মো: তোফায়েল আহম্মেদ নেতৃত্বে সীতাকুণ্ড মডেল থানা, ইউসুফ খাঁন নেতুত্বে সীতাকুণ্ড রিপোর্টার্স ক্লাব , বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন পুষ্পস্তবক অর্পন করেন ।

১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস । বাঙালি জাতির হাজার বছরের বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় গৌরবময় দিন । বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার দিন । পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের নাম জানান দেওয়ার দিন।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৪৮ সাল থেকে ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭১’র ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫ মার্চে গণহত্যা শুরু হলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন এবং রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক সেনাদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। সেই হিসাবে বিজয়ের ৫১ বছর পূর্তির দিন ।

বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

রাজনৈতিক দল গুলোর মধ্যে প্রথমে পুষ্পস্তবক অর্পন করে উপজেলা আওয়ামী লীগ, যুব লীগ ছাত্র লীগ, শ্রমিক লীগ,মৎস্যজিবী লীগ মহিলা লীগ, মিছিল শ্লোগানের মধ্যমে শহীদ মিনারে সমবেত হন ।

এ সময় সংক্ষিপ্ত সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন স্থানীয় সাংসদ আলহাজ্ব দিদারুল আলম।

উপজেলা আ. লীগের সভাপতি আবদুল্লাহ আল বাকের ভুইয়ার সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম আল মামুন।

উপস্থিত ছিলেন সহ সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম, সহ সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মনিরুল ইসলাম বাবুল, সহ সভাপতি জেলাপরিষদ সদস্য আ ম ম দিলসাদ, ইঞ্জিনিয়ার আজিজুল হক, শেখ রেজাউল করিম বাহার, বাবু কিশোর ভৌমিক, মহিউদ্দীন আহম্মেদ, জাহাঙ্গীর ভুঁইয়া, যুগ্ম সম্পাদক এইচ এম তাজুল ইসলাম, শওকত আলী জাহাঙ্গীর, সাঈদ মিয়া, আইন সম্পাদক আতিকুল মান্নান জামশেদ, কৃষি সম্পাদক শফিউল আলম মুরাদ, তথ্য সম্পাদক ফেরদৌস আলম, ত্রাণ সম্পাদক আলা উদ্দিন দপ্তর রতন কুমার মিত্র, প্রচার আসলাম হাবীব, সাংগঠনিক সম্পাদক মেজবাহ উদ্দিন, জালালা আহম্মদ,আবদীন আল মামুন, মহিলা সম্পাদক সেলিনা আক্তার, মুক্তিযোদ্ধা সম্পাদক মানিক লাল বড়ুয়া, শিক্ষা সম্পাদক আবু বক্কর, বন সম্পাদক রুহুল আমিন, কোষাধক্ষ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, সদস্য ইউসুফ খাঁন, বিজয় চক্রবর্তী প্রমুখ।

তাছাড়া বি এন পির বিশাল মিছিল সহ শহীদ মিনারে সমবেত হয় ও অঙ্গ সংগঠন শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন মিছিল নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমবেত হয়ে পুষ্পস্তবক অর্পন করেন। এরপর কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়।

দিনটি উপলক্ষে উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে সকাল সাড়ে ১০টায় উপজেলা অডিটোরিয়ামে মুক্তিযুদ্ধাদের সংবর্ধনা ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

এতে প্রধান হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম-৪ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব দিদারুল আলম।

মুক্তিযুদ্ধাদের সংবর্ধনা সভায় সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন, উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব এস এম আল মামুন, পৌর মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা বদিউল আলম, জেলা পরিষদের সদস্য আ ম ম দিলসাদ, মডেল থানার ওসি মো: তোফায়েল আমমেদ , মুক্তিযুদ্ধা সংসদের নেতৃবৃন্দ, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান জয়নব বিবি জলি।

উপস্থিত ছিলেন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন সাবেরীসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বৃন্দ, বীর মুক্তিযোদ্ধারাসহ বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ।

এ ছাড়া, সকাল সাড়ে ১০টায় সীতাকুণ্ড আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্যারেড সম্মিলিত বাহিনীর বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয় এতে অংশ গ্রহণ করে পুলিশ, আনসার, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, গ্রাম প্রতিরক্ষা দল, বি এন সিসি, র্গালস গার্ড, ক্যাডেট কোর, র্উপজেলা চেয়ারম্যান প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও সালাম গ্রহণ করেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও মডেল থানার ওসি কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি পরাধীনতার শেকল ভেঙে প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করে। ২৪ বছরের নাগপাশ ছিন্ন করে জাতির ভাগ্যাকাশে দেখা দেয় এক নতুন সূর্যোদয়। একটি ধ্বনি যেন নতুন বার্তা ছড়িয়ে দেয়, জয় বাংলা বাংলার জয়, পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল। মহামুক্তির আনন্দঘন এই দিনে এক নতুন উল্লাস জাতিকে প্রাণ সঞ্চার করে সজীবতা এনে দেয়। যুগ যুগ ধরে শোষিত বঞ্চিত বাঙালি চোখে আনন্দ অশ্রু আর ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে যায় সামনে। বিন্দু বিন্দু স্বপ্নের অবশেষে মিলিত হয় জীবনের মোহনায়।

বিশ্ব কবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, রূপে তাহার নেইকো শেষ, বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ।

প্রথম আগুন জ্বলে ‘৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারি। ফাগুণের আগুনে ভাষা আন্দোলনের দাবী। পাকিস্তানিদের সঙ্গে হিসেব-নিকেশের হালখাতার শুরুতেই রক্তের আঁচড় দিয়ে বাঙালি শুরু করে তার অস্তিত্বের লড়াই।

পলাশীর আম্রকাননে হারিয়ে যাওয়া সেই সিরাজদ্দৌলা আবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রূপে এ লড়াইয়ে সেনাপতি হিসেবে আবির্ভূত হন। ‘৫২ সালে যে আগুন জ্বলেছিল রাজধানী ঢাকা শহরে সে আগুন যেন ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে দেশের আনাচে-কানাচে । যে আগুন জ্বলেছিল মোর প্রাণে, সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে সবখানে সবখানে। বাষট্টি, ঊনসত্তর এবং সত্তর শেষ করে একাত্তরে বাঙালি জাতি হিসাব করতে বসে।

অবশেষে জেগে উঠে ৭ মার্চ একাত্তরের বিশাল জনসমুদ্র থেকে যুগের কবি, মহাকাব্যের প্রণেতা বঙ্গবন্ধু বজ্রকন্ঠ ঘোষণা দেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তি সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। রক্ত যখন দিয়েছি তখন আরও দেব,এদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।বাঙালি সত্যিকার দিক-নির্দেশনা পেয়ে যায়, চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে থাকে বাঙালি। পুরো জাতিকে স্তব্ধ করার লক্ষ্যে মারাত্মক মারণাস্ত্র নিয়ে ২৫ মার্চ একাত্তর ঘুমন্ত জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় বাঙালি নিধনযজ্ঞ।

মুক্তি পাগল বাংলার দামাল ছেলেরা স্বাধীনতার রক্ত সূর্যকে ছিনিয়ে আনবে বলে অস্ত্র কাঁধে তুলে নেয়। ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার সবাই শরিক হয়ে থাকে এ লড়াইয়ে। যতই দিন অতিবাহিত হতে থাকে আরও শাণিত হয় প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার অস্ত্র। লক্ষ্য স্থির রেখে শত্রু হননে দৃঢ়তায় এগিয়ে যায় বীর বাঙালি।

ইতোমধ্যেই বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন স্পষ্ট হয়ে উঠে। প্রতিবেশী ভারতও জড়িয়ে পড়ে বাঙালির ভাগ্য যুদ্ধে। ডিসেম্বর শেষ পর্যায়ে এসে চূড়ান্ত রূপ নেয় এই যুদ্ধের।

অবশেষে ৯ মাসের দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটিয়ে বাঙালি জাতির জীবনে এলো নতুন প্রভাত। ১৬ ডিসেম্বর সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সূচিত হলো মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্য বিজয়। এর মধ্য দিয়ে এলো হাজার বছরের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। বাঙালি জাতি এদিন অর্জন করে তার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের অধিকার। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর ২ লাখ ধর্ষিতা মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীনতা ধরা দেয় বাঙালির জীবনে।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;