বাংলাদেশে করোনা রোগীদের সেরে ওঠার হার ‘বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম’

বাংলাদেশে করোনা রোগীদের সেরে ওঠার হার ‘বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম’
বাংলাদেশে করোনা রোগীদের সেরে ওঠার হার ‘বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম’

পোস্টকার্ড ডেস্ক।। 

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস পজেটিভ ধরা পড়েছে গত ৮ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ৮ হাজার ৯৯৮ জন । আর এ সময়ের মধ্যে মোট আক্রান্তের দুই দশমিক ২৬ শতাংশ বা মাত্র ১১৩ জন রোগী সেরে উঠছেন। সেরে ওঠার দিক থেকে যা এখনও পর্যন্ত বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম।

এ জন্য আক্রান্তদের সেরে উঠতে দীর্ঘ সময় ধরে চিকিৎসা, কম ফলো-আপ পরীক্ষা, বয়স্ক এবং অন্য ব্যক্তিদের দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, অস্বাস্থ্যকর অবস্থা এবং চিকিত্সা খাতের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, কোভিড-১৯ আক্রান্তদের সেরে ওঠার হার কম হওয়ায় উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়া কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের পুরোপুরি সুস্থ হতে অনেক সময় লাগে।

তারা আরও বলেন, কোনো করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সুস্থ হতে ধরাবাঁধা কোনো সময় নেই। আক্রান্তের লক্ষণগুলোর মাত্রা, বয়স এবং রোগীর অন্যান্য স্বাস্থ্যগত অবস্থার ওপর নির্ভর করে তাদের সেরে উঠতে দুই থেকে ছয় সপ্তাহ সময় লাগতে পারে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ কোভিড-১৯ ব্যবস্থাপনায় ভালো অবস্থানে আছে, কারণ এখানে বেশিরভাগ রোগীর মধ্যে দেখা দেয়া লক্ষণগুলো হালকা ধরনের।

ওয়ার্ল্ডোমিটারের মতে, ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী করোনা আক্রান্তদের সেরে ওঠার হার প্রায় ২৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ ছিল। যার মধ্যে সিঙ্গাপুরে এটি ৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ, ভারতে ২২ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১১ দশমিক ৭৩ শতাংশ, স্পেনে ৪২ দশমিক ৭৭ শতাংশ, ইতালিতে ৩২ দশমিক ৩১ শতাংশ, ফ্রান্সে ২৭ দশমিক ৬২ শতাংশ, জার্মানিতে ৭০ দশমিক ৬৫ শতাংশ এবং উৎপত্তিস্থল চীনে ৯৩ দশমিক ৪ শতাংশ।

অধ্যাপক ফ্লোরা বলেন, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের সেরে ওঠার হার কম হওয়ার পেছনে মূল কারণ হলো এ ক্ষেত্রে থাকা দীর্ঘ প্রক্রিয়া।

তিনি বলেন, 'যারা এ ভাইরাসে সংক্রামিত হন তাদের সেরে উঠতে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন। পরীক্ষায় নেতিবাচক ফল আসার পরেও তাদের মধ্যে লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে। পরপর দুসপ্তাহ বা তারও বেশি সময় পরে কোনো রোগীর করা টানা দুটি পরীক্ষার ফল নেতিবাচক হলে আমরা তাকে সেরে ওঠার তালিকাভুক্ত করি। তারপরও পুরোপুরি সেরে উঠতে আরও অনেক সময় লাগে।'

ফ্লোরা বলেন, বাংলাদেশের বেশিরভাগ করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে হালকা লক্ষণ দেখা যায় এবং তারা এক সপ্তাহের মধ্যে কাশি, জ্বর, শরীরে ব্যথা এবং শ্বাসকষ্ট থেকে মুক্তি পান। 'তবে পুরোপুরি সেরে উঠতে আরও অনেক সময় প্রয়োজন।'

তিনি বলেন, সাধারণত হালকা করোনার লক্ষণ রয়েছে এমন লোকদের দুই থেকে চার সপ্তাহ সময় লাগে আর মারাত্মক লক্ষণযুক্ত ব্যক্তিদের পুরোপুরি সেরে উঠতে সর্বোচ্চ ছয় সপ্তাহ সময় প্রয়োজন হয়। তবে, যাদের আগে থেকেই বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের হালকা লক্ষণ থাকলেও সেরে উঠতে বেশি সময় লাগতে পারে।

ফ্লোরা বলেন, যেসব করোনার রোগীরা হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন তাদের কঠোরভাবে সেলফ আইসোলেশন, স্বাস্থ্যবিধি এবং চিকিত্সকদের পরামর্শ মেনে চলা উচিত।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের সেরে ওঠার সাথে তাদের বয়স, আগে থেকে বিদ্যমান স্বাস্থ্য সমস্যা, দীর্ঘমেয়াদি রোগ, ফলো-আপ পরীক্ষা এবং সঠিক যত্ন নেয়ার মতো আরও অনেক বিষয় রয়েছে।

তিনি বলেন, তরুণদের যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো তারা ১৪ দিনের মধ্যে এমনকি আরও দ্রুত সেরে উঠতে পারেন। তবে, একাধিক শারীরিক সমস্যা থাকা বয়স্ক ব্যক্তিদের সেরে উঠতে বেশি সময় লাগতে পারে।

বিএসএমএমইউ উপাচার্য বলেন, অনেক রোগী পাঁচ-সাত দিন পরেই ভালো অনুভব করতে পারেন। তবে করোনাভাইরাস থেকে সেরে ওঠা শুধুমাত্র ভালো অনুভব করার ওপরই নির্ভর করে না, প্রক্রিয়াটি আরও জটিল।

ভাইরাস আক্রান্তদের সেরে উঠায় বেশি সময় লাগায় উদ্বিগ্ন না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, 'সেরে ওঠার জন্য প্যারাসিটামলের মতো অ্যান্টিহিস্টামিন সেবন করুন। কোনো ধরনের ব্যথানাশক সেবন করবেন না, কারণ এতে আরও বিপদ ডেকে আনবে।'

করোনার লক্ষণ থাকাদের গরম পানি এবং ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার, ফল এবং শাকসবজি গ্রহণের পরামর্শও দেন তিনি। 'আক্রান্তদের অবশ্যই অন্যদের থেকে আলাদা এবং সবসময় ঘরে থাকতে হবে।'

ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, সেরে ওঠার হার কম, কারণ এটি সময় সাপেক্ষ প্রক্রিয়া এবং প্রাথমিক পর্যায়ে খুব অল্প সংখ্যক লোক এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল।

তিনি বলেন, 'গত দুই সপ্তাহ ধরে দেশে ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। একজন কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীকে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে এবং তারপরে ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সেরে উঠেছেন কি না তার জন্য দুবার পরীক্ষা করা উচিত। সময়ের সাথে সাথে সেরে ওঠার হার আরও বাড়বে।'

আক্রান্তদের সময় মতো ফলো-আপ পরীক্ষা করা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে অধ্যাপক খান আরও বলেন, 'আমরা এখন পরীক্ষা করার সুবিধা বাড়ানোর মাধ্যমে নতুন রোগীদের শনাক্তকরণের দিকে বেশি নজর দিচ্ছি। তবে সময়ে সময়ে ফলো-আপ পরীক্ষাও করা উচিত।'

তিনি বলেন, করোনার লক্ষণ এক সপ্তাহ পরে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। তবুও, রোগীর মধ্যে তখনও খুব কম পরিমাণে ভাইরাস থাকতে পারে। তাই, কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের পর পর এক-দুটি পরীক্ষার ফল নেতিবাচক না পাওয়া পর্যন্ত তাদের আইসোলেশনে থাকা উচিত।

ঢামেকের অধ্যক্ষ বলেন, দেশে খুব হালকা লক্ষণ দেখা দেয়া প্রায় ৮৫ শতাংশ করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি বাড়িতে রয়েছেন এবং তারা খুব শিগগিরই সুস্থ হয়ে উঠবেন। তবে সেরে ওঠার পরেও রোগীর অবশ্যই চলাফেরা সীমিত রাখতে হবে এবং আরও কয়েক দিনের জন্য আলাদা ঘরে থাকতে হবে। -ইউএনবি।