বিদায় হজের ভাষণ, মহানবী (সা.) এর বার্তা

বিদায় হজের ভাষণ, মহানবী (সা.) এর বার্তা
বিদায় হজের ভাষণ, মহানবী (সা.) এর বার্তা

মুফতি গোলাম রাজ্জাক কাসেমী

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিদায় হজ অনুষ্ঠিত হয় দশম হিজরি সালে। লক্ষাধিক সাহাবি উপস্থিত ছিলেন পবিত্র মক্কা নগরী, মিনা ও আরাফাতের ময়দানে। যেকোনো আদর্শিক নেতার জীবনের সর্বশেষ কর্মী-সম্মেলনের ভাষণ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে থাকে। আর মুহাম্মাদ (সা.) তো কেবল নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন সারা মানবজাতির মুক্তিদাতা। বিদায় হজের ভাষণে তিনি মানুষের মধ্যে বৈষম্য দূর করে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা, জান-মালের নিরাপত্তা, নারী অধিকারসহ নানা বিষয় আলোকপাত করেছেন। বিশ্বব্যাপী চলমান নানা সংকট ও সমস্যা থেকে উত্তরণে বিদায় হজের সেই অবিস্মরণীয় ভাষণে পাওয়া যাবে আলোকিত পথ। ঐতিহাসিক সেই ভাষণে মৌলিকভাবে আলোচিত হয়েছিল-

বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা
সাম্যের ভিত্তিতে শ্রেণিবৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতি, ধর্ম ও বর্ণবৈষম্যের ঊর্ধ্বে থেকে মানবিক মূল্যবোধকে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। মানবিক মূল্যবোধের অভাবে শুরু হয় মানুষের মধ্যে হানাহানি, কাটাকাটি ও মারামারি, যা এখন নিত্যদিনের ঘটনা। এর সমাধানের জন্য সাম্যের ভিত্তিতে শ্রেণিবৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) বিদায় হজের ভাষণে বলেন, ‘হে মানবজাতি! তোমাদের রব একজন। তোমাদের আদি পিতা একজন। প্রত্যেকেই আদমের সন্তান। আর আদম মাটির তৈরি। আল্লাহ তায়ালা পারস্পরিক পরিচিতির সুবিধার্থে বিভিন্ন সমাজ ও গোত্রে তোমাদের বিভক্ত করেছেন।’ আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মানবজাতি! আমি তোমাদিগকে একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যেন তোমরা পরস্পরে পরিচিত হতে পারো। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্মানিত, যে সর্বাধিক পরহেজগার।’ অতএব আরবের ওপর যেমন অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, তেমনি অনারবের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব নেই আরবের। একইভাবে শে^তাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের আর কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব বা মর্যাদা নেই। শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার একমাত্র ভিত্তি হলো তাকওয়া বা আল্লাহভীতি।’

জান-মালের নিরাপত্তা
বাহ্যিক চাকচিক্য ও চোখ-ধাঁধানো উন্নতিতে এখন পৃথিবী ভাসছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে সভ্যতার বহুমাত্রিক পরিবর্তন হয়েছে। বিজ্ঞান ঘুচিয়ে দিয়েছে দূর-দূরান্তের ব্যবধান, মানুষকে দিয়েছে অনিঃশেষ সম্ভাবনা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশে বৈষয়িক উন্নয়ন বেড়েছে। কিন্তু মানুষের ভেতরের অবস্থা ক্রমেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। পৃথিবীর সর্বত্র আজ হত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই এবং ত্রাসের রাজত্ব চলছে। মানুষের জান-মালের কোনো নিরাপত্তা নেই। চতুর্দিকে আজ মানবতা ভূলুণ্ঠিত। প্রতিটি মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা ও মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ পুনরুজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে মহানবি (সা.) বলেন, ‘হে লোক সব! তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্মান, তোমাদের সম্পদ পরস্পরের জন্য হারাম করা হলো। যেমন-আজকের এই দিন, এই মাস, এই শহরে রক্তপাত করা হারাম বা নিষিদ্ধ।’

ইনসাফভিত্তিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা
ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া পৃথিবীতে শান্তি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। ঘুসের বিনিময়ে অথবা স্বজনপ্রীতি করে নিরীহ ব্যক্তির ওপর দোষ চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা আমাদের সমাজে বেড়ে গেছে। দুর্বলের ওপর শক্তিধররা চাপিয়ে দেয় নানা অবিচার ও অনাচার। একজনের অপরাধের কারণে তার পরিবার, বংশ ও পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের ওপর নির্বিচারে নির্যাতন করা হয়। এ মর্মে রাসুল (সা.) বলেন, ‘শুনে রেখো। অপরাধীর দায়িত্ব কেবল তার ওপরই বর্তাবে। পিতা তার পুত্রের অপরাধের জন্য অথবা পুত্র তার পিতার অপরাধের জন্য দায়ী হবে না।’

নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা
বর্তমান পৃথিবীর ঘরে ঘরে নারীরা নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার। পাশ্চাত্যের তাবিজ গলায় ঝুলিয়ে যারা নারী অধিকারের বুলি আওড়ায়, তাদের কাছেই আজ নারীরা মূল্যহীন। নারীরা এখন সমাজের ভোগ্যপণ্যে পরিণত হয়েছে। হয়েছে সম্মান ও অধিকারবঞ্চিত। ইসলামের আগে জাহেলি যুগে আরবের অবস্থাও ছিল এমন। নারী হওয়ায় সেখানে নারীজাতি ছিল বড় অবহেলিত। তাদেরকে পরিবার ও সমাজের বোঝা মনে করা হতো এবং প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হতো। রাসুল (সা.) বিদায় হজের ভাষণে এ বিষয়ে সতর্ক করে বলেন, ‘নারীদের ব্যাপারে তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। কারণ তোমরা তাদেরকে আল্লাহর আমানত হিসেবে গ্রহণ করেছ, আর আল্লাহর বাণীর দ্বারাই তোমরা তাদের হালাল করেছ। স্ত্রীদের দায়িত্ব হলো, স্ত্রীরা খেয়াল রাখবে-যেন তোমাদের বিছানায় এমন কোনো লোক অবস্থান না করে-যাকে তোমরা অপছন্দ করো। আর তাদেরকে উত্তমরূপে রিজিক ও ভরণপোষণ দেওয়া তোমাদের দায়িত্ব।’ 

শ্রেষ্ঠতম শ্রমনীতি প্রণয়ন
বর্তমান বিশ্বে শ্রমিক বঞ্চনা সবচেয়ে আলোচিত সমস্যা। গার্মেন্ট, কৃষি থেকে শুরু করে সর্বস্তরের শ্রমিক এখনও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ ও ন্যায্য মজুরির বঞ্চনা নিয়েই কাজ করছেন। কিন্তু শ্রমিকের সংকটের সমাধান যেন কোনোভাবেই হচ্ছে না। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, স্বাস্থ্যসমস্যা, বকেয়া মজুরি, সাধ্যাতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেওয়াসহ ঘাটে ঘাটে সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। রাসুল (সা.) যে শ্রমনীতি ঘোষণা করেছেন, নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে তাকালে দেখা যাবে-এটাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম শ্রমনীতি। তিনি বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের অধীনস্থ সম্পর্কে সতর্ক হও। তারা তোমাদের ভাই। তোমরা নিজেরা যা খাও, তা তাদের খাওয়াবে। তোমরা নিজেরা যা পরিধান করো, তা তাদের পরিধান করাবে। তাদের ওপর সাধ্যাতিরিক্ত শ্রমের বোঝা চাপিয়ে দেবে না। যদি কোনো কারণে চাপিয়ে দিতে হয়, তবে তুমিও তাতে অংশীদার হও।’

রক্তপাত বন্ধ করে ভ্রাতৃত্বের নির্দেশনা
ঈমানকে বুকে ধারণ করে আমরা মুমিন পরিচয় লাভ করেছি। সেই ঈমানের দাবিকে পূর্ণ করতে হলে পরস্পর মারামারি, হানাহানি বন্ধ করে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে সুসংহত করতে হবে। কোথাও বিপরীত কিছু দেখা গেলে তা দূর করে পারস্পরিক ভালোবাসা-সম্প্রীতি কায়েম করা জরুরি। শান্তির সমাজ পেতে চাইলে এই ভ্রাতৃত্বের বিকল্প নেই। মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ ও ঐক্যের ভিত মজবুত করতে এবং নিরপরাধ মানুষ হত্যা বন্ধের নির্দেশ দিয়ে মহানবী (সা.) বলেন, ‘হে লোক সব! শুনে রেখো, মুসলমান জাতি পরস্পর ভাই ভাই। আমার অবর্তমানে তোমরা পরস্পর মারামারি ও হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত হয়ে কাফের হয়ে যেও না। মনে রেখো! শয়তান এ বিষয়ে নিরাশ হয়ে গেছে, যারা নামাজ আদায় করে তারা শয়তানের পূজারি হবে না। তবে হ্যাঁ, সে তোমাদের বিভিন্ন রকমের চক্রান্তের উসকানি দেবে।’

মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ
মানবতা ও নৈতিকতাবিরোধী সব অন্যায় প্রথা, অপরাধ, বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসার আগুনে আজ জ্বলছে পৃথিবী। অশান্তির এই আগুন চিরতরে নির্বাপণ করার জন্য মহানবি (সা.) ঘোষণা দেন, ‘শুনে রেখো, জাহেলি ও বর্বর যুগের সব ভ্রান্ত প্রথা আজ বাতিল করা হলো। জাহেলি যুগের রক্তের দাবিও আজ থেকে রহিত করা হলো।’

সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা নিষিদ্ধ
সুদ একটি ভয়াবহ ব্যাধি। এর ধ্বংসাত্মক প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এটি সামাজ ও ব্যক্তিজীবনে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি ডেকে আনে। এর ফলে চারিত্রিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসে। ঋণের পরিবর্তে যে অতিরিক্ত অর্থ চুক্তির ভিত্তিতে আদান-প্রদান করা হয়, তা-ই সুদ। চাই তা পরিমাণে কম হোক বা বেশি। সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থার জাঁতাকলে আজকের মানবসমাজের চরম বেহাল দশা। সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা চিরতরে মূলোৎপাটন করে জাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মহানবী (সা.) বলেন, ‘জাহেলি যুগের সুদব্যবস্থা রহিত করা হলো। এ পর্যায়ে সর্বপ্রথম আমি আমার চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের সুদ মাফ করে দিলাম, আর সেই সঙ্গে গোটা সুদব্যবস্থা আজ থেকে রহিত করা হলো।’

জুলুম-নির্যাতন ও আত্মসাৎ নিষিদ্ধ
জুলুম-অত্যাচার, চাঁদাবাজি, আত্মসাৎ, অপহরণ, জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেওয়া বা জবরদখল-এসব জঘন্যতম সামাজিক অপরাধ। এতে মানবসমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা, সুখ-সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও অগ্রগতি সব বিনষ্ট হয়। ঘরে-বাইরে, রাস্তাঘাটে, যানবাহনে কোথাও জনগণের জান-মাল, ধন-সম্পদ, মান-সম্মান ইত্যাদির পূর্ণ নিরাপত্তা থাকে না। ছিনতাইকারী ও চাঁদাবাজদের ভয়ে মানুষ প্রাত্যহিক জীবনে নির্ভয়ে চলাচল করতে পারে না। নিশ্চিন্তে ব্যবসা-বাণিজ্য, লেনদেন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পাদন করা সম্ভব হয় না। আঁধার-আলো, রৌদ্র-ছায়া, রাত-দিন, সবল-দুর্বল এসব নিয়েই বৈচিত্র্যময় এ পৃথিবী। তাই শক্তিমত্তা ও ক্ষমতার দাপটে কারো সম্পদ গ্রাস করা ও কারো প্রতি জুলুম করা যাবে না। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সাবধান! তোমরা জুলুম করবে না। আর কোনো মুসলমানের ধন-সম্পত্তি তার সম্মতি ছাড়া গ্রহণ করা তোমাদের জন্য বৈধ নয়।’

ধর্মীয় বিষয়ে পরমতসহিষ্ণু হতে হবে 
ধর্মের ব্যাপারে কোনোরূপ সীমা লঙ্ঘন কিংবা বাড়াবাড়ির পরিণাম ভয়াবহ। এর মাধ্যমে বিদ্বেষ ও বৈরিতা তৈরি হয়। অন্য কেউ যদি ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করেও ফেলে, তবে ভুলেও কোনো ঈমানদারের জন্য এ ধরনের হীন ও জঘন্য কাজের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করা ঠিক নয়। কারণ প্রত্যেক জাতি ও ধর্মাবলম্বীর রয়েছে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও আদর্শ। একটি সমাজব্যবস্থায় বহু দল-উপদল ও নানা মতের মানুষ থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে সংঘাত ও বাড়াবাড়ির কোনো সুযোগ নেই। মহানবী (সা.) বলেন, ‘সাবধান! ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি ও সংঘাতের পথ বেছে নিও না। এই বাড়াবাড়ির ফলেই অতীতে বহু জাতি ধ্বংস হয়েছে।’

জীবনপথের পাথেয়
রাসুল (সা.) যেহেতু সর্বশেষ নবী, আর সমস্যাসঙ্কুল পৃথিবীতে ইসলাম নতুন নতুন যুগ জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হওয়াটাই স্বভাবিক। এরই সমাধানে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা এ দুটো জিনিস আঁকড়ে থাকবে, ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। তা হলো-আল্লাহর কিতাব ও রাসুলের সুন্নাহ। (মুসলিম : ১২১৮; ইবনে মাজাহ : ৩০৫৫)।

বিশ্ব শান্তির এমন কোনো দিক নেই, যার দোলা এই মূল্যবান ভাষণে লাগেনি। মূলত বিদায় হজের ভাষণ মহানবী (সা.)-এর ২৩ বছরের নবুওয়াতি জীবনের কর্মপন্থা ও প্রজ্ঞার নির্যাস। তা ছাড়া এ ভাষণটি হলো মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের পর থেকে কিয়ামত অবধি বিপদসঙ্কুল পৃথিবীর উদ্ভূত পরিস্থিতি ও সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান এবং মানবজীবনের চিরন্তন কল্যাণের দিশারি।

বিভাগীয় প্রধান, আরবি ভাষা ও সাহিত্য
মদিনাতুল উলুম মাহমুদিয়া, নারায়ণগঞ্জ

খালেদ / পোস্টকার্ড