'বঙ্গবন্ধু' বিবিসির জরিপে শ্রেষ্ঠ বাঙালি

'বঙ্গবন্ধু' বিবিসির জরিপে শ্রেষ্ঠ বাঙালি

পোস্টকার্ড ডেস্ক।।

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিবিসি বাংলার জরিপ ও শ্রোতাদের মনোনয়নে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত হন । তাঁর জীবন-কথা নিয়ে একটি প্রতিবেদনও তুলে ধরেছে বিবিসি যার সংক্ষেপিত রূপ অনেকটা এ রকম -

শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। তাঁর বাবা শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন গোপালগঞ্জ দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার এবং মা সায়েরা খাতুন। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয় সন্তান। ১৯২৭ সালে শেখ মুজিব গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন তাঁর সাত বছর বয়সে। খুবই অল্প বয়সে তিনি বিয়ে করেছিলেন সম্পর্কে আত্মীয় বেগম ফজিলাতুন্নেসাকে।

গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে পড়ার সময় ১৯৩৯ সালে স্কুল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মুখ্যমন্ত্রী একে ফজলুল হক এবং পরবর্তীতে বাংলার প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। সোহরাওয়ার্দী পরবর্তীকালে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন।

১৯৪২ সালে এট্রান্স পাস করার পর শেখ মুজিব ভর্তি হন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে যেটির বর্তমান নাম মাওলানা আজাদ কলেজ। কলকাতা বিশ^বিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এই কলেজটি তখন বেশ নামকরা ছিল। এই কলেজ থেকে তিনি সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন। তিনি ১৯৪৩ সালে যোগ দেন বেঙ্গল মুসলিম লীগে এবং ১৯৪৪ সালে বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায় অনুষ্ঠিত নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সম্মেলনে যোগদানের মধ্যে দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে অভিষিক্ত হন।

শেখ মুজিব ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন ১৯৪৬ সালে এবং এ সময়েই তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সহকারী নিযুক্ত হয়েছিলেন। এ সময় তিনি পাকিস্তানে আলাদা মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে বেঙ্গল মুসলিম লীগের হয়ে সক্রিয় আন্দোলনে অংশ নেন।

কলকাতা বিশ^বিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকেই ১৯৪৭ সালে তিনি বিএ পাস করেন এবং ভারত ও পাকিস্তান পৃথক হয়ে যাওয়ার পর শেখ মুজিব পূর্ব-পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু বিশ^বিদ্যালয় কর্মীদের বিক্ষোভে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ এনে কর্তৃপক্ষ তাঁকে বিশ^বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করায় আইন পড়া তাঁর শেষ হয়নি।

তিনি ১৯৪৮ সালে জানুয়ারির ৪ তারিখে প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ যার মাধ্যমে তিনি একজন অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতায় পরিণত হন। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পূর্ব-পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেওয়ার পর এর বিরুদ্ধে যে গণআন্দোলন শুরু হয়, সে আন্দোলনে একটা অগ্রণী ভ‚মিকা ছিল শেখ মুজিবের।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মওলানা ভাসানী ১৯৪৯ সালে পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করার পর শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম লীগ ছেড়ে দিয়ে এই নতুন দলে যোগ দেন এবং তাঁকে পূর্ব-পাকিস্তান অংশের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়।

শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নামে যে বিরোধী রাজনৈতিক মঞ্চ গঠিত হয়েছিল, তার মূল দাবি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য অধিকতর স্বায়ত্তশাসন। এই জোটের টিকেটে ১৯৫৪-এর নির্বাচনে গোপালগঞ্জ আসন থেকে বিজয়ী হয়েছিলেন শেখ মুজিব। তাঁকে তখন কৃষি ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

১৯৫৫ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ আওয়ামী মুসলিম লীগের বিশেষ অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছিল। শেখ মুজিব দলের মহাসচিব নির্বাচিত হয়েছিলেন। রেসকোর্স ময়দানে ২৩ ফেব্রæয়ারি ১৯৬৯ এক বিশাল জনসভায় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে শেখ মজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়া হয়েছিল।

শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ড. কামাল হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রæয়ারি পল্টনে তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় জনগণের কত কাছাকাছি তিনি চলে এসেছেন। এই বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়ার মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠলেন জনগণের অবিসংবাদিত নেতা।’ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ এক জনসভায় শেখ মুজিব স্বাধীনতার ডাক দিলেন এবং জনগণকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহŸান জানালেন। যার মধ্যে দিয়ে শুরু হলো বাংলাদেশের ৯ মাসব্যাপী সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম।

শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হলো পশ্চিম পাকিস্তানে এবং ফয়সালাবাদের একটি জেলে কড়া নিরাপত্তায় রাখা হলো। এরপর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২-এর ১০ই জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে গেলেন শেখ মুজিবুর রহমান।

অল্পদিনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতি থাকার পর তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। শেখ মুজিব ১৯৭২ সালে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন, বলেছিলেন জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের কথা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর আগে পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের যে বাড়িটি থেকে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, যে বাড়ি থেকে পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে গ্রেফতার করেছিল ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চের রাতে, স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন ১৯৭৫ সালে ১৫ই আগস্টের রাতে সেই বাড়িতেই সেনাবাহিনীর একদল সদস্যের হাতে নিহত হয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান স্বপরিবারে।

অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, অনেক নেতাকে আমরা পেয়েছি। কিন্তু জনগণের মুখপাত্র হয়ে ওঠা, জনগণের ভাবনা, চেতনা, অভিলক্ষ্য, স্বপ্ন সব কিছুকে ধারণ করতে পেরেছিলেন একজনইÑ তিনি শেখ মুজিবুর রহমান।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মূল্যায়নে : বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্রীয় সত্তার যে উদ্ভব সেটির চ‚ড়ান্ত পর্যায়ে অনুঘটক নেতৃত্বের ভ‚মিকা পালন করেছিলেন। কাজেই তিনি ইতিহাসের সঙ্গেই লগ্ন হয়ে আছেন। বাঙালির ইতিহাসের সঙ্গে। বিবিসি বাংলার যেসব শ্রোতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির আসনে বসিয়েছিলেন, তাদের কয়েকজন বলেছিলেন কেন তারা শেখ মুজিবকে ভোট দিয়েছিলেন।

মণিকা রশিদ- নাগাসাকি, জাপান : তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণ মন্ত্রের মতো সমগ্র বাঙালি জাতিকে পৃথিবীর একটি সুপ্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে খালি হাতে লড়াইয়ে নামতে এবং সেই লড়াইয়ে জিততে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

শহীদুল হক ধানমন্ডি, ঢাকা : একটা দেশের স্রষ্টা যিনি সমগ্র দেশের মানুষকে একসূত্রে গেঁথেছিলেন।

জিনাত হুদা কভেন্ট্রি, ব্রিটেন : বাঙালি জাতি যদি হয় একটি স্বপ্নের নাম, আকাক্সক্ষার নাম, সংগ্রামের নাম এবং সফলতার নাম, তবে তার রূপকার শেখ মুজিব।

বিবিসি বাংলার জরিপে শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় দুই নম্বরে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তৃতীয় কাজী নজরুল ইসলাম, চতুর্থ একে ফজলুল হক, পঞ্চম সুভাষ চন্দ্র বসু, ষষ্ঠ বেগম রোকেয়া, সপ্তম জগদীশ চন্দ্র বসু, অষ্টম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, নবম মওলানা ভাসানী, ১০ম রামমোহন রায়, ১১তম তিতুমীর, ১২তম লালন ফকির, ১৩তম সত্যজিৎ রায়, ১৪তম অমর্ত্য সেন, ১৫তম ভাষা শহীদ, ১৬তম মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ১৭ নম্বরে বিবেকানন্দ, ১৮ নম্বরে অতীশ দীপঙ্কর, ১৯ নম্বরে জিয়াউর রহমান এবং ২০তম স্থানে সোহরাওয়ার্দী।