ফৌজদারহাট-বায়েজিদ লিংক রোড প্রকল্পে ২২.৫ ডিগ্রি এঙ্গেলে পাহাড় কাটার প্রস্তাব সিডিএর, পরিবেশ অধিদপ্তরের ‘না’

ফৌজদারহাট-বায়েজিদ লিংক রোড প্রকল্পে ২২.৫ ডিগ্রি এঙ্গেলে পাহাড় কাটার প্রস্তাব সিডিএর, পরিবেশ অধিদপ্তরের ‘না’

ইকবাল হোসেন ।।

ফৌজদারহাট-বায়েজিদ লিংক রোডে তৈরি করা হয়েছে রাস্তা পাহাড় কেটে । অন্যদিকে কাটা ১৬ সবুজ পাহাড় নিশ্চিহ্ন করতে চাইছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। সিডিএ ২২ দশমিক পাঁচ ডিগ্রি এঙ্গেলে এসব পাহাড় কাটার প্রস্তাবনা দিলেও তা মানতে নারাজ পরিবেশ অধিদপ্তর। উপরন্তু অনুমোদনের অতিরিক্ত পাহাড় কাটার অভিযোগে ১০ কোটি টাকার জরিমানার মামলাও এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। এ চিত্র ফৌজদারহাট টোল রোড হতে বায়েজিদ বোস্তামি পর্যন্ত লিংক রোড প্রকল্পের।

পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, ২২ দশমিক পাঁচ ডিগ্রি এঙ্গেলে কাটা হলে এসব পাহাড় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। যে কারণে কাটা সবুজ পাহাড়গুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নতুন প্রস্তাবনা চাওয়া হয়েছে। জানা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট টোল রোডের মুখ থেকে বায়েজিদ বোস্তামি পর্যন্ত সংযোগ সড়কটি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয় ১৯৯৭ সালে। ওই সময়ের ৩৩ কোটি ৮১ লাখ টাকার প্রকল্পটি শেষতক ৩২০ কোটিকে ঠেকেছে। চট্টগ্রাম বাইপাস সড়ক নামের ওই প্রকল্পের জন্য ৯২০ কাঠা জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ২০১৯ সালের ১২মে পরিবেশ অধিদপ্তর প্রকল্পটির জন্য পরিবেশ ছাড়পত্র দেয়। প্রকল্পের আওতায় একটি রেলওয়ে ওভারব্রিজসহ ছয়টি ব্রিজ এবং কয়েকটি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। প্রকল্পের ৬ কি.মি. রাস্তা নির্মাণে কাটা হয় ১৬টি পাহাড়। বেপরোয়া পাহাড় কাটার অভিযোগ পেয়ে চলতি বছরের শুরুতে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে পরিবেশ অধিদপ্তর। একেবারে নতুন রাস্তাটি নির্মাণের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে সিডিএ আড়াই লাখ ঘনফুট পাহাড় কাটার অনুমোদন নিলেও বাস্তবে ১০ লাখ ৩০ হাজার ঘনফুট পাহাড় কাটার প্রমাণ পায় পরিদর্শনকারী টিম। সবমিলিয়ে ৬৯ হাজার ২১৯ দশমিক ৭০২ বর্গফুট বেশি পাহাড় কাটা হয় বলে জানায় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শনকারী টিম। এরপর ২৯ জানুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তরে ঢাকাস্থ প্রধান কার্যালয়ে শুনানীতে পাহাড় কেটে জীববৈচিত্র ধ্বংস, পাহাড়ের উপরিভাগের মাটি এবং ভূমির বাইন্ডিং ক্যাপাসিটি নষ্টসহ পরিবেশ-প্রতিবেশের ক্ষতি করা অভিযোগে সিডিএকে ১০ কোটি ৩৮ লাখ ২৯ হাজার ৫৫৩ টাকা জরিমানা করেন অধিদপ্তরের পরিচালক (মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট) রুবিনা ফেরদৌসী। এরপর ১৩ ফেব্রুয়ারি আরেক শুনানীতে ওই প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান স্পেকট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডকেও ৫ কোটি ২৩ লাখ ২০ হাজার টাকা জরিমানা করের পরিবেশ অধিদপ্তর। একই আদেশে অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী পাহাড়গুলো লেভেল ড্রেসিং করার নির্দেশনাও দেওয়া হয় ওই আদেশে। পরে পরিবেশ অধিদপ্তরে ওই জরিমানা আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করে সিডিএ। আপিল আবেদনটি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। বর্তমানে প্রকল্পটি শেষ পর্যায়ে রয়েছে।

এদিকে ওই আপিল আবেদন নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই নতুন করে পাহাড়গুলোর ঢালের স্থায়িত্বের জন্য মাটি কর্তন ও লেভেল ড্রেসিং করার লক্ষ্যে ৩ লাখ ৩২ হাজার ঘনমিটার পাহাড় কাটার অনুমতি চেয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে নতুন আবেদন করে সিডিএ। গত ২৩ মার্চ ইস্যু করা আবেদনের চিঠিটি করোনা প্রাদুর্ভাবকালীন সরকারি সাধারণ ছুটির কারণে ৩১মে পরিবেশ অধিদপ্তরের হস্তগত হয়।

‘এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর ওমেন এর বহিঃসীমানা দিয়ে লুপরোড নির্মাণসহ ঢাকা ট্রাংক রোড হতে বায়েজিদ বোস্তামি পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণ’ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক রাজীব দাশ স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, আসন্ন (চলতি) বর্ষা মৌসুমের আগে পাহাড়ের ঢালগুলোর লেভেল ড্রেসিং করা না হলে রাস্তার উপর ধ্বস ও দুর্ঘটনা ঘটার আশংকা রয়েছে। বর্ষা মৌসুম খুব সন্নিকটে হওয়ায় পাহাড়ের ঢালের স্থায়িত্বের লক্ষ্যে সংযুক্ত নকশা অনুযায়ী উত্তর পাহাড়তলী মৌজার ১৭৮, ১৯৩, ১৯৮, ২০০, ৩০১ বিএস দাগের কমবেশি ৩ লাখ ৩২ হাজার ৭১০ ঘনমিটার মাটি বর্ষার পূর্বে কর্তন করা প্রয়োজন। অন্যথায় যান চলাচলের জন্য রাস্তাটি উন্মুক্ত করা হলে পাহাড়ের ঢাল ধ্বসে জানমালের ক্ষতি হতে পারে। উল্লেখ্য যে, উক্ত মৌজায় পাহাড়গুলো খুবই যান চলাচলের জন্য রাস্তটি উন্মুক্ত করা হলে পাহাড়ের ঢাল ধসে জানমালের ক্ষতি হতে পারে। ওই মৌজায় পাহাড়গুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ আছে বিধায় ঢালগুলো কর্তন করা খুবই জরুরি বলে ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। তাছাড়া পাহাড়গুলো কেটে মাটিগুলো এলাকার বাইরে ডাম্পিং এর অনুমতি প্রদানের জন্য ওই চিঠিতে অনুরোধ করা হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, সিডিএ’র জমাকৃত নকশাতে ২২ দশমিক পাঁচ ডিগ্রি এঙ্গেলে পাহাড়গুলো কাটার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়।

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক নূরুল্লাহ নূরী বলেন, ‘সিডিএ সড়কটি অনুমোদন নেওয়ার সময় পাহাড়গুলো রক্ষার একটি ডিজাইন দিয়েছিলেন। যেখানে প্রয়োজন অনুযায়ী কোথাও গাইড ওয়াল (প্রতিরক্ষা দেওয়াল), জিও টেঙ ও ঘাসের মাধ্যমে পাহাড়গুলো ব্যবস্থাপনা করার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু প্রথম থেকে তারা পাহাড়গুলো সে অনুযায়ী কাটেনি। উপরন্তু অনুমোদনের চেয়ে অনেক বেশি পাহাড় তারা কেটেছে। যে কারণে সিডিএ’র বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, প্রায় ১০ কোটি টাকার অধিক জরিমানাও করা হয়েছে। জরিমানার ওই মামলাটি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘পাহাড়গুলো নতুন করে কাটার জন্য আমাদের কাছে আবেদন করেছে সিডিএ। তারা (সিডিএ) চায় পাহাড়গুলো ২২ দশমিক ৫ ডিগ্রি এঙ্গেলে (কোণাকৃতি) কাটতে। ২২ দশমিক ৫ ডিগ্রি এঙ্গেলে কাটা হলে পাহাড়গুলো একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। যে কারণে আমরা তাদের কাছে নতুন কিছু পর্যবেক্ষণ চেয়েছি। পাশাপাশি পাহাড়গুলো ১ঃ১ অনুপাতে লেভেল ড্রেসিং করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ কমপক্ষে ৪৫ ডিগ্রি এঙ্গেলে লেভেল ড্রেসিং করা গেলে পাহাড়গুলোকে রক্ষণাবেক্ষণ করা যাবে। আমাদের পর্যবেক্ষনগুলো ১৫ দিনের মধ্যে দেওয়ার জন্য সিডিএকে বলা হয়েছে।’

অন্যদিকে পাহাড়গুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সিডিএ, পরিবেশ অধিদপ্তর, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ অভিজ্ঞ পরিবেশবিদদের যৌথ সমন্বয়ে শক্তিশালী একটি কমিটি গঠন করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোশাররফ হোসাইন বলেন, ‘কি কারণে এতোগুলো পাহাড় কেটে সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে সেটা বোধগম্য নয়। ইতোমধ্যে যাতায়াত সুবিধা বেড়ে যাওয়ার কারণে পাহাড়গুলোর পাদদেশে ছোট ছোট বসতি তৈরি হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বায়েজিদ লিংক রোডে কাটা সবুজ পাহাড়গুলো একেবারে নিশ্চিহ্ন করা সমীচীন হবে না। আবার কাটা পাহাড়গুলো খাড়া অবস্থায় থাকাও বিপদজনক। এখন সিডিএ, পরিবেশ অধিদপ্তর, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ পরিবেশবিদদের যৌথ সমন্বয়ে একটি কমিটি করে পাহাড়গুলো কিভাবে রক্ষা করা যায় সেটার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অনেকগুলো পাহাড় রক্ষা করা গেলে পরিবেশ ও প্রতিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব রোধ করা সম্ভব হবে।’

৪৫ ডিগ্রি কিংবা তার কম এঙ্গেলে কাটা হলে পাহাড়গুলো থাকবে না উল্লেখ করে বায়েজিদ লিংক রোড প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক সিডিএ’র প্রকৌশলী রাজীব দাশ বলেন, ‘পাহাড়গুলোর লেভেল ড্রেসিং করার জন্য আমরা ৪৫ ডিগ্রি এঙ্গেলে কাটার জন্য নতুন করে আবেদন করেছি। এরপর পরিবেশ অধিদপ্তর কিছু পর্যবেক্ষণ চেয়েছে। এগুলো আমরা তৈরি করছি।’ তিনি বলেন, ‘এখন পুরো রাস্তাটি বন্ধ করে রাখা হয়েছে। অনুমোদন পেলে সুচারুভাবে লেভেল ড্রেসিং করে পাহাড়গুলোতে ঘাস লাগানো হবে।’