পবিত্র কুরআনের প্রথম সুরার নাম ‘ফাতেহা’ , গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য

পবিত্র কুরআনের প্রথম সুরার নাম ‘ফাতেহা’ , গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য
পবিত্র কুরআনের প্রথম সুরার নাম ‘ফাতেহা’ , গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য

নূর মুহাম্মদ রাহমানী।। 

মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআন দিয়েছেন মানবজাতির হেদায়েতের জন্য । মোট ১১৪টি সুরা বা শিরোনামে আলোচনা করা হয়েছে মানবজীবনের সব বিষয়। পবিত্র কুরআনের প্রথম সুরার নাম হচ্ছে ‘ফাতেহা’ অর্থাৎ উদ্বোধনী। পবিত্র কুরআনের পূর্ণাঙ্গ সুরা হিসেবে এটিই প্রথম অবতীর্ণ হয়েছে। এই সুরার আয়াত সংখ্যা ৭। ফাতেহা শব্দের অর্থ আরম্ভ, শুরু, উদ্বোধন, উদঘাটন প্রভৃতি। 

ধারাবাহিকতার ভিত্তিতে এ সুরার নামকরণ করা হয়েছে সুরা ফাতেহা। এটি এ সুরার সর্বাধিক পরিচিত নাম। তারপরও সুরা ফাতেহার স্থান, মর্যাদা, বিষয়বস্তু, ভাবভাষা, প্রতিপাদ্য বিষয় ইত্যাদির বিচারে এর আরও কিছু নাম রয়েছে এবং প্রত্যেক নামের সঙ্গেই সুরাটির সামঞ্জস্য বিদ্যমান। 

সুরা ফাতেহার প্রসিদ্ধ নামগুলো হলো-১. ফাতেহাতুল কিতাব, ২. সালাত, ৩. আল হামদ, ৪. উম্মুল কিতাব, ৫. উম্মুল কুরআন, ৬. আসসাবউল মাসানি, ৭. আল কুরআনুল আজিম, ৮. আশশিফা, ৯. আল আসাস, ১০. আল ওয়াফিয়া, ১১. আল কাফিয়া। ১২. আদদোয়া, ১৩. আল কানয, ১৪. আল মোনাজাত, ১৫. আত-তাফভিজ প্রভৃতি।

কুরআনের সারসংক্ষেপ
সুরা ফাতেহাকে কুরআনের সার সংক্ষেপ বলা হয়। এ সুরায় কুরআনের সারমর্ম সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ভাব ও অর্থের সাগরের বিশাল জলরাশিকে ছোট আয়তনের চৌবাচ্চায় ভরে দিয়েছেন। কুরআনের বাকি ১১৩টি সুরা প্রকারান্তরে সুরা ফাতেহারই বিস্তৃত ব্যাখ্যা। কারণ কুরআনে মূলত তিনটি বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। যেমন-আল্লাহ তায়ালার পরিচয়, আল্লাহ পাকের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি লাভের জন্য মানুষের করণীয় ও বর্জনীয়। সুরা ফাতেহাতে এ তিনটি বিষয় খুব সংক্ষেপে বলে দেওয়া হয়েছে। তাই রূপক অর্থে সুরা ফাতেহা পবিত্র কুরআনের জননী বলে খ্যাত।

সুরা ফাতেহার বিষয়বস্তু
সুরা ফাতেহার সাতটি আয়াতের প্রথম চারটি আয়াতে আল্লাহর প্রশংসা এবং শেষ তিনটি আয়াতে বান্দার প্রার্থনার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে, সব প্রশংসা জগতের প্রতিপালক আল্লাহর। দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে, তিনি দয়াময়, পরম দয়ালু। তৃতীয় আয়াতে বলা হয়েছে, তিনি কর্মফল দিবসের মালিক। চতুর্থ আয়াতে বলা হয়েছে, আমরা শুধু তোমারই ইবাদত করি, শুধু তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি। পঞ্চম আয়াতে বলা হয়েছে, আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন করুন। ষষ্ঠ আয়াতে বলা হয়েছে, তাদের পথ আমাদের দেখাও যাদেরকে তুমি অনুগ্রহ দান করেছ। সপ্তম আয়াতে বলা হয়েছে, তাদের পথ আমাদের দেখিও না, যারা ক্রোধ-নিপতিত ও পথভ্রষ্ট।

সুরা ফাতেহার বৈশিষ্ট্য
সুরা ফাতেহা পূর্ণ কুরআনুল কারিমের জ্ঞান-ভান্ডারে সমৃদ্ধ। এতে আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা করা হয়েছে। ইবাদত এবং একনিষ্ঠতার জন্য বান্দাদের পক্ষ থেকে স্বীকারোক্তি দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ থেকে হেদায়েত প্রার্থনা, নিজের অক্ষমতা স্বীকার করা এবং ওই নিয়ামত প্রতিষ্ঠার ঈমান-সমৃদ্ধ বর্ণনা বান্দাদের জবানে এই সুরার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে এই সুরায় পুনরুত্থান দিবস সংঘটিত হওয়ার বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কুরআনের একটি হরফ পাঠ করলে ১০টি নেকি লাভ হয়। সুরা ফাতেহায় ১২৫টি হরফ রয়েছে। ১২৫ হরফ যিনি পাঠ করবেন তার আমলনামায় ১২৫ নেকি দান করা হবে। 

ইমাম কুরতুবি (রহ.) বলেছেন, সুরা ফাতেহার বিশেষ মর্যাদা হলো, আল্লাহ এটিকে নিজের ও নিজের বান্দার মধ্যে ভাগ করে নিয়েছেন। একে বাদ দিয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সম্ভব নয়। সে জন্যই এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘উম্মুল কুরআন’। পবিত্র কুরআন মূলত তিনটি বিষয়ে বিন্যস্ত। তাওহিদ, আহকাম ও নসিহত। সুরা ইখলাসে ‘তাওহিদ’ পূর্ণাঙ্গভাবে থাকার কারণে তা কুরআনের এক-তৃতীয়াংশের মর্যাদা পেয়েছে। কিন্তু সুরা ফাতেহায় তিনটি বিষয় একত্রে থাকার কারণে তা ‘উম্মুল কুরআন’ হওয়ার মহত্তম মর্যাদা লাভে ধন্য হয়েছে। (তাফসিরে কুরতুবি : ১৪৮)

আল্লাহর সঙ্গে প্রেমের সংলাপ
সুরা ফাতেহার বৈশিষ্ট্য বলে শেষ করা যাবে না। নামাজে এ সুরা পড়া মানে আল্লাহর সঙ্গে প্রেমালাপ করা। বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আবু হুরাইরা (রা.) বলেছেন, ‘তোমরা সুরা ফাতেহা পড়ো। কোনো বান্দা যখন বলে, আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন, তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমার প্রশংসা করেছে। যখন বলে, আর-রাহমানির রাহিম, তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমার গুণ বর্ণনা করেছে। বান্দা যখন বলে, মালিকি ইয়াউমিদ্দীন। আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমার মর্যাদা বর্ণনা করেছে। বান্দা যখন বলে, ইয়্যাকানা’বুদু ওয়া ইয়্যাকানাস্তাইন, আল্লাহ বলেন, এ হচ্ছে আমার ও আমার বান্দার মাঝের কথা। আমার বান্দার জন্য তাই রয়েছে, যা সে চায়। বান্দা যখন বলে, ইহদিনাস সিরাতাল মুস্তাকিম... শেষ পর্যন্ত)। আল্লাহ বলেন, এসব হচ্ছে আমার বান্দার জন্য। আমার বান্দার জন্য তাই রয়েছে, যা সে চায়। (মুসলিম, হাদিস : ৩৯৫)

রোগ নিরাময়কারী সুরা
হজরত আবদুল মালেক ইবনে ওমায়ের (রা.) থেকে বর্ণিত-রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সুরা ফাতেহা সব রোগের মহৌষধ’ (দারেমি, হাদিস : ৩৪১৩; মিশকাত, হাদিস : ২১৭০)। মিশকাত ব্যাখ্যাকার আল্লামা মোল্লা আলী কারী (রহ.) স্বীয় ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘মিরকাতুল মাফাতিহ’-এ উল্লিখিত হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘সুরা ফাতেহার অক্ষর, শব্দ পড়াতে যেমন উপকার, তেমনি লেখাতেও উপকার। যেকোনো রকমের রোগ-দ্বীনি হোক বা পার্থিব, অনুভবযোগ্য হোক বা না হোক সবকিছু এ সুরা পড়া বা লেখার বরকতে আরোগ্য হবে ইনশাআল্লাহ। যেকোনো রোগের জন্য সুরা ফাতেহা পড়ে রোগীর ওপর দম করা যায়। নিশ্চিত এতে আরোগ্য হাসিল হবে। এ জন্যই তো এই সুরাকে সুরাতুর রুকইয়া এবং সুরাতুশ শিফা বলা হয়।’ 

হজরত আবু সাঈদ ইবনে মুয়াল্লা (রা.) হতে বর্ণিত-একটি হাদিসে আছে, ‘নবী কারিম (সা.)-এর কিছু সাহাবি এক এলাকায় আগমন করার পর তাদের সরদারকে সাপে কাটল। তারপর সাহাবিদের একজন সুরা ফাতেহা পড়ে তাদের সরদারকে ঝাড়ফুঁক করলে সে সুস্থ হয়ে ওঠে। এর বিনিময়ে সাহাবিরা বিনিময়স্বরূপ কিছু বকরির পালও লাভ করেন। নবীজি (সা.) এটাকে সমর্থন করেন। আর বললেন, ঠিক আছে বকরিগুলো নিয়ে যাও এবং তাতে আমার জন্যও এক অংশ রেখে দিও’ (বুখারি, হাদিস : ৫০০৬)। আর হ্যাঁ, অবশ্যই এ সুরা পড়ার দ্বারা রোগ মুক্তি মিলবে। তবে গভীর বিশ্বাস প্রধান শর্ত। সহিহ আকিদা এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান ছাড়া কিছুই অর্জন হবে না।

এ সুরায় আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি এবং সব রকমের সাহায্য আল্লাহর কাছে চাওয়ার যে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে এর ওপরও আমল এবং বিশ্বাস অত্যন্ত জরুরি। যারা মহান রবের সঙ্গে পীর, ফকির, জীবিত বা মৃত বুজুর্গ, নবী-রাসুল, দেব-দেবীকে শরিক করে তারা এ সুরার আলোকে প্রকৃতপক্ষে এক অদ্বিতীয় আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়নকারী এবং সে সত্তার প্রতি ঈমান এবং আকিদা পোষণকারী সাব্যস্ত হবে না। মহান আল্লাহ সবাইকে বোঝার ও আমল করার তওফিক দিন।

লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম 
বাগে জান্নাত নারায়ণগঞ্জ

খালেদ / পোস্টকার্ড ;